পান্তা-ইলিশ: বৈশাখের রীতি নাকি আধুনিক রূপকথা?

মাটির থালায় পান্তা ইলিশ
মাটির থালায় পান্তা ইলিশ  © সংগৃহীত

পহেলা বৈশাখ মানেই চারুকলায় মঙ্গল শোভাযাত্রা, লাল-সাদা পোশাকে রঙিন উৎসব, আর সবার মুখে একটাই স্বাদ—পান্তা-ইলিশ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই খাবারের সাথে বৈশাখের সম্পর্ক কতটা ঐতিহাসিক? আদৌ কি গ্রামবাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য ছিল এটি, নাকি আধুনিক শহুরে উদ্ভাবন?

পান্তার শিকড় গ্রামীণ জীবনে

পান্তা ভাত—মানে আগের রাতের পানিতে ভেজানো ভাত—গ্রামীণ জীবনে দীর্ঘদিনের চর্চিত খাদ্য। দিনের কাজের আগে সকালে ঠান্ডা পান্তা, সাথে লবণ, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, ভর্তা—এটাই ছিল সহজ ও সস্তা পুষ্টিকর খাবার। গ্রীষ্মকালে এ খাবার ছিল হজমে সহজ, শরীর ঠান্ডা রাখত।

ইলিশের যোগ, ঐতিহ্য নাকি আধুনিকতা?

গ্রামে বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার ঐতিহ্য তেমনটা ছিল না, বিশেষ করে গরীব কৃষকদের ঘরে। কারণ ইলিশ ছিল দামী মাছ, সহজপ্রাপ্যও নয়। অনেকের মতে, পান্তা-ইলিশ একসাথে খাওয়ার প্রচলন ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হতে শুরু করে ৯০ দশকের পর, বিশেষত শহরাঞ্চলে বৈশাখের উৎসবের অংশ হিসেবে।

ফোকলোর গবেষকরা বলছেন, “ইতিহাসে পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার রীতি খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা শহুরে সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে বিগত কয়েক দশকে।”

বাণিজ্যের ছোঁয়ায় উৎসবের স্বাদ

পান্তা-ইলিশ এখন একপ্রকার উৎসবের পণ্যে পরিণত হয়েছে। বৈশাখের দিনে রেস্টুরেন্টগুলোতে থাকে “বৈশাখী থালি”—যার কেন্দ্রবিন্দুতে ইলিশ ভাজা। দামও চমকপ্রদ—একটি ইলিশ থালায় হাজার টাকার ওপরে গড়মূল্য! অনেকে একে বাঙালির “খাদ্যবিলাস” বলে ব্যঙ্গও করেন।

তবু প্রশ্ন থাকে—কেন পান্তা-ইলিশ এত জনপ্রিয়? কারণ এটি আজ বাঙালি পরিচয়ের প্রতীক। শহরের মানুষ শেকড়কে স্পর্শ করতে চায়, আর পান্তা-ইলিশ সেই গ্রামীণ ঐতিহ্যের একটা ছোঁয়া দেয়। সঙ্গে থাকে সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা, মাটির টান আর কিছুটা নস্টালজিয়া।

পান্তা-ইলিশ ঐতিহাসিকভাবে বৈশাখের অবিচ্ছেদ্য অংশ না হলেও, আজ এটি হয়ে উঠেছে বাঙালির আত্মপরিচয়ের রুচিসংবলিত প্রতীক। উৎসবের সময় প্রতীকই হয়ে ওঠে বাস্তবতার চেয়েও বড়। তাই পান্তা-ইলিশ শুধু একটা খাবার নয়, বরং বৈশাখের স্বাদে মিশে থাকা সংস্কৃতির রূপ।


সর্বশেষ সংবাদ