০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৯

বুলি পাল্টে নতুন পরিচয়ে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতাগ্রহণের ইতিহাস

বিশ্বে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলোর উথান  © সংগৃহীত

বিশ্বের অনেক দেশে দেখা যায়, যেসব দলকে সহিংসতা, বর্ণবাদ বা স্বৈরশাসনের কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তারা নতুন নামে ও নতুন রূপে ফিরে আসে। তারা নিজেদের পরিচয় বদলায়, কথার ধরন পরিবর্তন করে এবং সাধারণ মানুষের অসন্তোষকে নিজের পক্ষে কাজে লাগায়। বিশ্বে বহু রাজনৈতিক দলকে চরমপন্থা, সহিংসতা, বর্ণবাদ বা স্বৈরাচারিতার কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখানে তাদের বিলুপ্তি, পুনরুত্থান এবং রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতাকে অনুসরণ করে গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার সামনে টিকে থাকা এক চ্যালেঞ্জকে তুলে ধরা হয়েছে।

ইতালি: মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ থেকে মেলোনির সরকার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির পরাজয়ের পর বেনিতো মুসোলিনির ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি (পিএনএফ) ভেঙে দেওয়া হয়। যুদ্ধাপরাধ, স্বৈরশাসন, নাৎসি জার্মানির সঙ্গে জোট, এবং বিরোধীদের ওপর নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ—এসবই এর নিষিদ্ধ হওয়ার প্রধান কারণ ছিল।

এই ভাঙন ছিল চূড়ান্ত। মিত্রশক্তি ও ইতালির অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পার্টির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে, শীর্ষ নেতাদের বিচার করে, আর ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তাদের শুদ্ধি অভিযান চালায়। এমনকি মুসোলিনিকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। স্কেলবা আইন (১৯৫২) ও মানচিনো আইন (১৯৯৩)-এর মতো আইন ফ্যাসিবাদী প্রতীক ও প্রচারণা নিষিদ্ধ করে, এবং সংবিধানে নতুন ধারাগুলো ফ্যাসিবাদী সংগঠন পুনর্গঠনকে নিষিদ্ধ করে।

তবুও ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ রয়ে যায়। মুসোলিনির অনুগতরা ১৯৪৬ সালে ইতালিয়ান সোশ্যাল মুভমেন্ট (এমএসআই) গঠন করে, যা গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে চলার চেষ্টা করে। ১৯৯৫ সালে এমএসআই নিজেদের নাম বদলে ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (এএন) রাখে, যাতে তারা আরও রক্ষণশীল-প্রথাগত চেহারা পায়। পরে এএন ভেঙে গিয়ে কিছু সদস্য ২০১২ সালে ব্রাদার্স অব ইতালি (এফডিআই) গঠন করে।

এফডিআই, জর্জিয়া মেলোনির নেতৃত্বে, অভিবাসন ইস্যু ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার ওপর জনঅসন্তোষকে কাজে লাগায়। ২০২২ সালের নির্বাচনে ২৬% ভোট পেয়ে তারা সরকার গঠন করে। ফ্যাসিবাদী স্যালুট দেওয়া তরুণদের মতো কেলেঙ্কারি এখনও সন্দেহ জাগায় যে অতীত কতটা প্রভাব ফেলছে, তবুও মেলোনি ২০২৫ সালেও ক্ষমতায় রয়েছেন।

আরও পড়ুন: ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না’

ইসরায়েল: কাচ থেকে ওতজমা ইহুদিত পর্যন্ত
১৯৮৮ সালে রাব্বি মেইর কাহানার কাচ দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিষিদ্ধ করা হয় এবং ১৯৯৪ সালে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। আরবদের বহিষ্কার ও সহিংসতার আহ্বান জানানোয় তাদের কর্মকাণ্ড নিন্দিত হয়। ১৯৯৪ সালে হেবরনের গুহায় কাচ সমর্থকের হামলায় ২৯ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার পর দলটির পতন ঘটে।

সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেয়—সম্পদ জব্দ, নেতাদের গ্রেপ্তার, এবং কাচকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করা হয়। ১৯৯০ সালে কাহানা নিহত হন। ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র কাচকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় যুক্ত করে।

তবুও মতাদর্শ ফিরে আসে। ২০১২ সালে ইতমার বেন-গভির প্রাক্তন কাচ সদস্যদের নিয়ে ওতজমা ইহুদিত (ইহুদি শক্তি) গঠন করেন। দলটি সামান্য নরম সুরে আরববিরোধী অবস্থান নেয়। ডানপন্থী ভোট পেতে নেতানিয়াহু তাদের সঙ্গে জোট বাঁধেন। ২০২২ সালে তারা কনেসেটে প্রবেশ করে এবং সরকারে যোগ দেয়। বেন-গভির জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী হন। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে গাজায় যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ায় ওতজমা ইহুদিত সরকার ছাড়ে, একে তারা ‘সন্ত্রাসের বিজয়’ বলে আখ্যা দেয়। বিরোধী দলে থেকেও তাদের প্রভাব প্রবল।

জার্মানি: নাৎসি থেকে আফডি পর্যন্ত
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর ১৯৪৫ সালে নাৎসি পার্টি (এনএসডিএপি) ও তাদের সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ হয়। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল, ডিনাজিফিকেশন, এবং সংবিধানে নিষিদ্ধ ধারাগুলো দিয়ে দলটিকে ধ্বংস করা হয়। কিন্তু ১৯৬৪ সালে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনপিডি) গঠিত হয়। ২০১৭ সালে এটিকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

২০১৩ সালে গঠিত অলটারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) প্রথমে ইউরো-বিরোধী দল হলেও দ্রুত চরম দক্ষিণপন্থায় ঝুঁকে পড়ে। অভিবাসনবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী অবস্থান নেয়, যা নাৎসি যুগের কথাবার্তাকে মনে করিয়ে দেয়। জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা দলের কিছু অংশকে চরমপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০২৪ সালে এএফডি প্রথমবার কোনো রাজ্য নির্বাচন (থুরিঙ্গিয়া) জেতে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে ২০–২৫% ভোট পেয়ে তারা বৃহত্তম বিরোধী দল হয়। যদিও সম্ভাব্য জোটসঙ্গীরা তাদের এড়িয়ে চলে, তবুও তাদের প্রভাব বাড়ছে।

মলডোভা: নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট থেকে সরকারের ক্ষমতায়
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৯১ সালে মলডোভার কমিউনিস্ট পার্টি (পিসিএম) নিষিদ্ধ হয়। সোভিয়েত যুগে স্বৈরশাসন, দমননীতি ও নির্যাতনের কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকার পার্টি বিলুপ্ত করে, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে, এবং কমিউনিস্ট প্রতীক নিষিদ্ধ করে।

তবে দুই বছরের মধ্যে প্রাক্তন কমিউনিস্টরা ভ্লাদিমির ভোরোনিনের নেতৃত্বে পার্টি অব কমিউনিস্টস অব দ্য রিপাবলিক অব মলডোভা (পিসিআরএম) গঠন করে। ২০০১ সালে তারা বিপুল জয় পেয়ে সরকার গঠন করে এবং ২০০৯ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে। মলডোভা ছিল প্রথম পোস্ট-সোভিয়েত দেশ যেখানে কমিউনিস্টরা পুনরায় ক্ষমতায় আসে। ২০২৫ সালে পিসিআরএম একটি ছোট বিরোধী শক্তি হলেও এর ঐতিহাসিক প্রভাব টিকে আছে।

আরও পড়ুন: রাকসু নির্বাচনে মনোনয়নপত্র নিলেন ১২৩৩ প্রার্থী, বেশি সোহ্‌রাওয়ার্দী হলে

নেপাল: নিষিদ্ধ বিপ্লবীদের থেকে জোট সরকারের পথে
রাজতন্ত্রকালে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিএন) নিষিদ্ধ ছিল। পঞ্চায়েত যুগে তাদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ও মাওবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে দমননীতি চালানো হয়। তবুও দলটির বিভিন্ন অংশ বেড়ে ওঠে। ১৯৯৬ সালের মাওবাদী বিদ্রোহ এক দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। পরবর্তীতে বিদ্রোহীরা রাজনীতিতে প্রবেশ করে এবং ২০১৮ সালে মাওবাদী কেন্দ্র ও ইউএলএম একত্র হয়ে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (এনসিপি) গঠন করে। ২০১৮ সালে তারা বিপুল জয় পেয়ে সরকার গঠন করে, তবে ২০২১ সালে দল ভেঙে যায়। তবুও কমিউনিস্টরা নেপালের রাজনীতিতে প্রধান শক্তি। ২০২৪ সালে ইউএলএম নেতা কে.পি. শর্মা ওলি পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন।

চিলি: নাৎসি থেকে রিপাবলিকান পার্টি
১৯৩৮ সালে চিলির ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট মুভমেন্ট (এমএনএসসিএইচ) এক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করলে সেনারা গুলি চালায়—যা সেগুরো ওব্রেরো গণহত্যা নামে পরিচিত, এবং ৬০ জনেরও বেশি নিহত হয়। সহিংসতা, চরমপন্থা ও নাৎসি-জার্মান সংযোগের কারণে দলটিকে দ্রুত ভেঙে দেওয়া হয়।তবে অবশিষ্টরা নতুন নামে দল গঠন করে। এক পর্যায়ে এগুলো অগুস্তো পিনোশের স্বৈরশাসনকে সমর্থন করে। গণতন্ত্র ফেরার পর তারা ইউডিআই ও ন্যাশনাল রিনিউয়াল (আরএন) নামে রূপান্তরিত হয়। ২০১৯ সালে হোসে আন্তোনিও কাস্ত ইউডিআই ছেড়ে রিপাবলিকান পার্টি গঠন করেন। ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৪৪% ভোট পান এবং রানঅফে যান। ২০২৫ সালেও তারা সংসদে শক্তিশালী বিরোধী, যদিও নির্বাহী ক্ষমতা পায়নি।

কেন নিষিদ্ধ দলগুলো ফিরে আসে?
নিষিদ্ধ দলগুলো অনেক সময় আবার রাজনীতিতে ফিরে আসে। তাদের মতাদর্শ সমর্থকদের মধ্যে বেঁচে থাকে এবং নতুন রাজনৈতিক অসন্তোষ বা সমস্যা তাদের শক্তি জোগায়। সরাসরি নিষেধাজ্ঞা সবসময় কাজে আসে না—দলগুলো নাম বদলিয়ে, কথা নরম করে, এবং গণতান্ত্রিক অধিকার যেমন বাকস্বাধীনতা ব্যবহার করে আবার সক্রিয় হয়।

এ ধরনের পুনরুত্থান আরও সহজ হয় যখন দেশে বিভাজন, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব, অভিবাসন নিয়ে আতঙ্ক বা অর্থনৈতিক সংকট থাকে। জনপ্রিয় নেতারা এই অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে পুরনো মতাদর্শকে নতুনভাবে উপস্থাপন করে। অতএব, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি, ভালো শিক্ষা এবং শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছাড়া, গণতন্ত্র বারবার একই সমস্যার মুখোমুখি হয়।