‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি’: ফিলিস্তিনি স্লোগানটির প্রকৃত অর্থ কী?

‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি স্লোগানের প্ল্যাকার্ড
‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি স্লোগানের প্ল্যাকার্ড  © ফাইল ছবি

বর্তমানে গাজায় নির্বিচারে ফিলিস্তিনি নারী-শিশু থেকে শুরু করে গণহারে মানুষ হত্যায় নিমজ্জিত হয়েছে ইসরায়েল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট হয়ে এমন হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে জেগে উঠেছে সারাবিশ্বের মুসলিম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। সব জায়গায় প্রতিবাদের স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি, প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি’। 

তবে অনেকেই জানেন না এই ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি’ এর প্রকৃত অর্থ কী? 

স্লোগানটি মূলত জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত স্বাধীনতার দাবিকে কেন্দ্র করে একটি ফিলিস্তিনি স্লোগান। এখানে ‘রিভার’ বলতে বোঝানো হয় জর্ডান নদী, আর ‘সি’ বলতে বোঝানো হয় ভূমধ্যসাগর (Mediterranean Sea)। এই দুটি প্রাকৃতিক সীমানার মাঝখানের এলাকা হলো বর্তমান ইসরায়েল, পশ্চিম তীর (West Bank) এবং গাজা উপত্যকা (Gaza Strip)— যা ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিন হিসেবে বিবেচিত।

বৈরুত থেকে লন্ডন, তিউনিস থেকে রোম পর্যন্ত, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে উপমহাদেশের রাজপথে গাজায় ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ বন্ধের দাবিতে হওয়া বিক্ষোভে এই স্লোগানটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে।

ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে থাকা বিক্ষোভকারীদের জন্য এই স্লোগানটি ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। কিন্তু ইসরায়েল এবং এর সমর্থকরা এটিকে হামাসপন্থি ও সহিংসতার ইঙ্গিত বলে মনে করেন এবং একে ইহুদিবিদ্বেষী স্লোগান হিসেবে আখ্যা দেন।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েল আক্রমণ করে ইজরায়েলের ১৪০০ জন নাগরিককে হত্যা করে। সেসময় ইজরায়েল আবার নির্বিচারে ফিলিস্তিনি হত্যা শুরু করে। বর্তমানে নিহত ফিলিস্তিনি সংখ্যা আনুষ্ঠানিকভাবে ৫০ হাজার হারিয়েছে। অনানুষ্ঠানিক সংখ্যা আরও বেশি। 

সে সময় যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রাভারম্যান প্রো-ফিলিস্তিনি বিক্ষোভগুলোকে ‘ঘৃণার মিছিল’ আখ্যা দিয়ে বলেন, এই স্লোগান ইসরায়েলের বিলুপ্তি কামনার সহিংস ইঙ্গিত বহন করে।

২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত সোশ্যাল মিডিয়ায় এই স্লোগান ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

অস্ট্রিয়ান পুলিশও একই পদক্ষেপ গ্রহণ করে তখনকার সময়ে। স্লোগানটিকে একটি ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভ হিসেবে উল্লেখ করে এই স্লোগানকে নিষিদ্ধ করে। 

তাদের দাবি করে, পিএলও (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন) কর্তৃক সৃষ্ট এই স্লোগান পরবর্তীতে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস দ্বারা গ্রহণ করা হয়েছে। জার্মান কর্তৃপক্ষ এই স্লোগানকে আইনত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং বার্লিনের স্কুলগুলোতে ফিলিস্তিনি স্কার্ফ 'কেফিয়েহ' পরার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করে ২০২৩ সালে। 

এই স্লোগানের উৎপত্তি কোথা থেকে?

১৯৬৪ সালে নির্বাসিত ফিলিস্তিনিদের নেতৃত্বে ইয়াসির আরাফাতের মাধ্যমে গঠিত ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ এই স্লোগানটির সূচনা করে। তাদের লক্ষ্য ছিল জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত একটি ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন।

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ এই অঞ্চলে একটি ইহুদি রাষ্ট্র (তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চলের ৬২%) এবং একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা দেয়। কিন্তু আরব নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সময় ৭,৫০,০০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনিকে তাদের ঘরছাড়া করা হয়, যা ‘নাকবা’ হিসেবে পরিচিত।

পরে ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ দুই-রাষ্ট্র সমাধানের ধারণা মেনে নেয়। কিন্তু ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি এবং ২০০০ সালের ক্যাম্প ডেভিড আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার ফলে ফিলিস্তিনিদের মনোভাবে আরও কঠোরতা আসে। এই পরিস্থিতির ফলেই দ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা গণবিদ্রোহের সূচনা হয়।

এর অর্থ কী?

এই স্লোগানের অর্থ নিয়ে মতপার্থক্য মূলত ‘মুক্ত’ শব্দটির ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে। লন্ডনের SOAS বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও ইসরায়েলের আরব নাগরিক নিমের সুলতানি বলেন, ‘এই শব্দটি ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের সকল অধিবাসীর সমানাধিকারের প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ করে।’

তার মতে, যারা ইসরায়েলে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব বা বর্ণবাদের পক্ষে, তাদের কাছে এই সমতার আহ্বান আপত্তিকর।

তিনি আরও বলেন, ‘ফিলিস্তিনিরা বহুদিন ধরেই তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে বঞ্চিত। ব্রিটিশদের ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ইহুদিদের জাতীয় আবাসস্থল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়ার পর থেকেই এই বঞ্চনার সূত্রপাত হয়।’

তিনি বলেন, ‘এই চিৎকার (স্লোগান), এই দাবি— এটি ইংরেজি ভাষায়, আরবিতে এর ছন্দও হয় না। এটি পশ্চিমা বিশ্বের সমাবেশে ব্যবহৃত হয়। এই বিতর্কটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন পশ্চিমে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি গঠনকে বাধা দেওয়া যায়।’

বিরোধিতামূলক প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েলপন্থি পর্যবেক্ষকরা বলেন, এই স্লোগানটি ইহুদি ইসরায়েলিদের জন্য হুমকিস্বরূপ। জেরুজালেম ভিত্তিক রাবাই ও ব্র্যান্ডেইস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইহুদাহ মিরস্কি বলেন, ‘এই বাক্যটি ইসরায়েলিদের কাছে বোঝায়— এই ভূখণ্ডে একটি মাত্র রাষ্ট্র থাকবে, তার নাম হবে ফিলিস্তিন, এবং সেখানে আর কোনো ইহুদি রাষ্ট্র থাকবে না। এতে ইহুদিদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।’

তিনি বলেন, ‘এটি মুক্তির প্রতিশ্রুতি নয়, বরং হুমকির মতো শোনায়। এই স্লোগান যারা দিচ্ছেন তারা হামাসের সমর্থক।’

যদিও সুলতানি বলেন, হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভে হামাসের সমর্থকরা ব্যতিক্রম, এবং সবাইকে সেই দৃষ্টিতে দেখা অনুচিত।

এই স্লোগানের বিতর্ক ব্রিটিশ সংসদেও পৌঁছেছিল ২০২৩ সালে। নানামুখী বিতর্ক তখন থেকে এই স্লোগানের সাথে জড়িত হয়েছে।

সুলতানি বলেন, এখানে এমন একটি প্রয়াস দেখা যায়, যেখানে ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে অস্তিত্ব ও ইহুদি শ্রেষ্ঠত্ববাদী মতবাদকে এক করে ফেলা হচ্ছে। এই ভ্রান্ত ব্যাখ্যায়, ‘সমতা প্রতিষ্ঠা ও বর্ণবাদী ব্যবস্থা ভাঙার আহ্বানও হয়ে ওঠে অস্তিত্বের হুমকি।’

ইসরায়েলি রাজনীতিতে ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি’

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি নিজেকে রক্ষণশীল ও জাতীয়তাবাদী হিসেবে বর্ণনা করে এবং ‘এরেটজ ইসরায়েল’ বা ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত ইহুদি ভূমি’ ধারণার প্রবক্তা।

ইহুদি ভার্চুয়াল লাইব্রেরি অনুযায়ী, ১৯৭৭ সালের লিকুদ পার্টির মূল ইশতেহারে লেখা ছিল ‘সমুদ্র থেকে জর্দান নদী পর্যন্ত শুধুই ইসরায়েলি সার্বভৌমত্ব থাকবে।’

তারা আরও বলেছিল, একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সৃষ্টি ইহুদি জনগণের নিরাপত্তার জন্য হুমকি এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন করবে।

পশ্চিম তীরে ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি বসতিগুলোর সম্প্রসারণ অনেকের চোখে এই অঞ্চলকে ‘নদী থেকে সমুদ্র’ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করার একটি প্রচেষ্টা। যা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ করে।

অধ্যাপক মিরস্কি বলেন, যদিও কিছু ইসরায়েলি নেতা ধর্মীয় ধারণার ভিত্তিতে এই সম্পূর্ণ ভূখণ্ডে অধিকার দাবি করছেন, তবুও এই বিষয়টি আধুনিক ইসরায়েলে বিতর্কিত।

তার মতে, ‘বিভক্তি নয়, আমাদের উচিত সমাধানের দিকে এগোনো। আমরা বসে কি এমন কিছু ভাবতে পারি না, যা ইহুদি ও আরব— উভয়ের জীবনকে আরও ভালো করে তুলবে?’

তিনি বলেন, ‘যতই অদ্ভুত শোনাক না কেন, আমি বিশ্বাস করি এই যুদ্ধ শেষে আমরা আবারও একটি সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভাবার সুযোগ পাব।’

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা


সর্বশেষ সংবাদ