যৌন হয়রানি ঠেকাতে যে ছোট্ট ‘অস্ত্র’ ব্যবহার করেন ভারতীয় নারীরা
ভারতের প্রায় প্রতিটা নারীকেই ভিড়ের মধ্যে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। কখনও গণপরিবহনে, আবার কখনও পথের ভিড়ে। এসব হেনস্তাকারীদের পালটা জবাব দিতে নানা ধরনের কৌশলও গ্রহণ করেন তারা। অনেকে লম্বা নখ রাখেন, কেউ ছাতা, আবার অনেকে জুতার হিলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। তবে এবার যৌন হয়রানি ঠেকাতে হাতিয়ারের তালিকার শীর্ষে উঠে এসেছে সেফটি পিনের নাম।
অনেক নারী হেনেস্তাকারীতে পালটা জবাব দিতে হাতের কাছে যা থাকে সেটাই ব্যবহার করেন। বিবিসি প্রতিনিধি গীতা পান্ডে নিজের অভিজ্ঞতার উদাহরণ টেনে বলেন, ‘‘বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতার ভিড়েঠাসা বাস বা ট্রামে কলেজে যাতায়াতের সময় আমি ও আমার বন্ধুরা ছাতা ব্যবহার করতাম।
আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রদীপের নিচেই অন্ধকার
‘‘আমাদের অনেকে হাতের নখ বড় ও ধারালো করে রাখত। যাতে ভিড়ের মধ্যে শরীর হাতড়ে বেড়ানো হাতগুলো খামচে রক্তাক্ত করে ফেলা যায়। কেউ কেউ জুতার হিল দিয়ে হেনেস্তাকারীর পায় জোরে মাড়িয়ে দিত বা লাথি মারত। তবে অনেকের কাছে এর থেকেও কার্যকর অস্ত্র থাকত। সেটা হলো সেফটি পিন।”
১৮৪৯ সালে এটি উদ্ভাবনের পর থেকে নারীদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় সেফটি পিন। পোশাক সুন্দর করে পরতে বা শাড়ির ভাঁজ ঠিক রাখতে ব্যবহার হয় সেফটি পিন। কেউ কেউ হঠাৎ করে পোশাক ছিঁড়ে, ফেটে বা খুলে গেলে দ্রুত ব্যবস্থা হিসেবে সেফটি পিন লাগিয়ে নেন।
তবে শুধু পোশাকের নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং নারীরা নিজের নিরাপত্তার জন্যও সেফটি পিনকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
আরও পড়ুন: যৌন হয়রানির অভিযোগ করে উল্টো শাস্তি পেলেন বাউবির নারী কর্মকর্তা
ভারতের বেশ কয়েকজন নারী টুইটারে জানান, তারা সবসময় তাদের হ্যান্ডব্যাগ বা গায়ে একটি পিন বহন করেন। জনাকীর্ণ জায়গায় বিকৃতদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এটি তাদের পছন্দের অস্ত্র।
দীপিকা শেরগিল নামে এক নারী এ বিষয়ে বিবিসি-কে নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘‘আমি যে বাসে প্রতিদিন অফিসে যেতাম সেটার মধ্যেই আমার সঙ্গে এমন কাণ্ড হয়। দশক পুরোনো আগের ঘটনা হলেও সব কিছু আমার স্পষ্ট মনে আছে।
‘‘আমার বয়স তখন কুড়ির কোটায়। যে লোকটা আমার সঙ্গে অসভ্যতা করেছিল তার বয়স ছিল মধ্য চল্লিশে। তিনি সব সময় ধূসর রঙের সাফারি পরতেন। তিনি প্রতিদিন আমার পাশে এসে দাঁড়াতেন, ঝুঁকে পড়তেন, আমার পিঠে তার কুঁচকি ঘষতেন এবং প্রতিবার বাস চালক ব্রেক কষলে তিনি আমার উপর ঢলে পড়তেন।”
ওই নারী জানান, তিনি ওই সময় ভীতু প্রকৃতির ছিলেন। ভিড়ের মধ্যে সবাই তাকে দেখুক তা তিনি চাইতেন না। তাই মাসের পর মাস ওই নিপীড়ন তিনি মুখবুজে সহ্য করেছেন।
আরও পড়ুন: রুমে ডেকে নিয়ে বিএসএমএমইউয়ের অধ্যাপকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ
কিন্তু একদিন ওই লোক বাসের মধ্যেই এক অপ্রীতিকর কাণ্ড করে বসে। যা ওই নারীকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে।
তিনি আরও জানান ‘‘আমার নিজেকে খুব নোংরা মনে হচ্ছিল। বাড়িতে ফিরে অনেকক্ষণ গোসল করলাম। সেদিন আমার সঙ্গে কি হয়েছে সেটা আমি আমার মাকেও বলতে পারিনি। সে রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। এমনকি, আমি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবছিলাম। তারপরই আমি প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা শুরু করলাম।
‘‘আমি তাকে আঘাত করতে চাইছিলাম, রক্তাক্ত করতে এবং এমন শিক্ষা দিতে যাতে সে পুনরায় আর আমার সঙ্গে এমন করার সাহস না পায়।”
পরদিন তিনি চটি না পরে হিলযুক্ত জুতা পরলেন এবং সেফটি পিন নিয়ে বাসে উঠলেন।
‘‘যখনই সে আমার পাশে এসে দাঁড়াল, আমি আমার আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তার পায়ের পাতা আমার জুতার হিল দিয়ে খুব জোরে মাড়িয়ে দিলাম। তাকে ব্যথায় হা করে চিৎকার করতে শুনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল। এরপর আমি তার বাহুতে জোরে সেফটি পিন ফুটিয়ে দিয়ে দ্রুত বাস থেকে নেমে পড়লাম।”
আরও পড়ুন: ব্র্যাক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি, ঢাবির আইবিএ শিক্ষক বরখাস্ত
ওই দিনের পর আরো এক বছর দীপিকা ওই বাসে যাতায়াত করেছেন। কিন্তু আর কখনও ওই ব্যক্তিকে দেখেননি।
দীপিকাকে যে নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে তা ভয়াবহ। কিন্তু ভারতে তিনি একমাত্র নারী নন যাকে প্রতিনিয়ত এসব সহ্য করতে হয়।
তারই একজন সহকর্মী তার সঙ্গে ঘটা একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন। ৩০ এর কোঠার ওই নারী রাতের বাসে ভারতের দক্ষিণের নগরী কোচি থেকে ব্যাঙ্গালুরু যাচ্ছিলেন। বাসে এক ব্যক্তি বার বার তার হাত ধরার চেষ্টা করছিল।
তিনি বলেন, ‘‘শুরুতে আমি তার হাত সরিয়ে দেই, ভেবেছিলাম দুর্ঘটনাবশত এটি হয়েছে। কিন্তু যখন আবারও একই কাণ্ড হল, আমি বুঝতে পারলাম সে ইচ্ছা করে এটি করছে। সেদিন আমার হিজাবে থাকা সেফটি পিন আমাকে বাঁচিয়ে দেয়।
‘‘সে বারবার হাত দেওয়ার চেষ্টা করছিল, আর আমি হাতে সেফটি পিন দিয়ে খোঁচা দিচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত সে সরে যায়।
আমার কাছে সেফটি পিন ছিল, সেটা ভেবে আমার আনন্দ হচ্ছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুব ছোট লাগছিল। মনে হচ্ছিল, কেনো আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকে কষে চড় মারতে পারিনি।
আরও পড়ুন: পরামর্শের জন্য শিক্ষকের কক্ষে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার ঢাবি ছাত্রী
‘‘কিন্তু তখন আমার বয়স কম ছিল। ভেবেছিলাম, আমি ঘুরে দাঁড়ালে আশেপাশের লোকজন হয়ত আমাকে সমর্থন দেবে না।”
অনলাইনে চালানো একটি জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালে ভারতের ১৪০টি নগরীর ৫৬ শতাংশ নারী গণপরিবহনে যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। অথচ, তাদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে গেছেন।
বেশিরভাগই বলেছেন, তারা বরং নিজেরাই প্রতিশোধ নিয়েছেন বা পরিস্থিতি আরও বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যেতে পারে আশঙ্কায় মুখবুজে সহ্য করে গেছেন।
৫২ শতাংশের বেশি নারী বলেছেন, ‘নিরাপত্তাহীনতার কারণে’ তারা লেখাপড়া বা কাজ ছেড়ে দিয়েছেন।
নারীদের জন্য জনসমাগমপূর্ণ স্থান নিরাপদ করতে প্রচার চালানো সামাজিক সংগঠন ‘সেফটিপিন’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা কল্পনা বিশ্বনাথ বলেন, ‘‘যৌন সহিংসতার ভয় নারীদের মনে এবং তাদের তৎপরতায় প্রকৃত সহিংসতার চেয়ে বেশি গভীর প্রভাব ফেলে।
আরও পড়ুন: মধ্যরাতে ছাত্রীকে চায়ের নিমন্ত্রণ নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের
‘‘নারীরা নিজেদের উপরই বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা শুরু করেন এবং এর কারণে নাগরিক হিসেবে নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠিত হয় না। যৌন নিগৃহের ঘটনাগুলো যেমন ঘটে তার থেকে অনেক ভয়ংকর রূপে নারীদের জীবনে সেগুলো প্রভাব ফেলে।”
যৌন নিগৃহের শিকার শুধু ভারতীয় নারীরাই হন না, বরং এটা পুরো বিশ্বের নারীদের সংকট।
থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, মেক্সিকো সিটি, টোকিও এবং কায়রোর এক হাজার নারীর উপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে, ‘গণপরিবহন নেটওয়ার্কগুলি যৌন শিকারিদের জন্য দারুণ আকর্ষণীয়। যেখানে তারা নিজেদের অসভ্য আচরণ লুকাতে এবং ধরা পড়লে একটি অজুহাত দেখাতে ভিড়ের সময়টিকে বেছে নেয়’। [বিবিসি]