শ্রীলঙ্কায় স্বৈরশাসনের পতন, জাতির প্রত্যাশা

মো. নিজাম উদ্দিন
মো. নিজাম উদ্দিন  © টিডিসি ফটো

এক.

ব্রিটিশদের কাছ থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর শ্রীলঙ্কা সবচেয়ে খারাপ সময় মোকাবিলা করছে। বিগত কয়েক মাসের শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরিণ রাজনৈতিক সংকট দেশটিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এমন এক পরিচিতি এনে দিয়েছে যা যেকোনো রাষ্ট্র ও সরকারের জন্যই লজ্জার। জনগণের প্রতি দায়িত্বহীন একটি সরকার কিভাবে দেউলিয়া হয়ে নিজেই নিজের চূড়ান্ত পরিনতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এই সময়ে শ্রীলঙ্কার চেয়ে ভালো উদাহরণ আর হয়তো একটিও নেই।

দক্ষিণ এশিয়ায় কিছু ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা ছিল উদাহরণ দেওয়ার মতো একটি রাষ্ট্র, শিক্ষার হার প্রায় নব্বইয়ের পার্সেন্টের উপর! এমন কী হলো সেই দেশটির ই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন কাগজের অভাবে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেয়া যাচ্ছে না? একটি রাজনৈতিক দল, একটা গোষ্ঠী, একটা পরিবারের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা একটা দেশকে কিভাবে পথে বসিয়ে দিতে পারে শ্রীলঙ্কা তার প্রতীক হয়েই থাকলো।

ভারত মহাসাগরের তীরে দক্ষিণ এশিয়ার দীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা অতীতেও নানামুখী অভ্যন্তরিণ সংকটে পড়েছে। কিন্তু সরকার দেউলিয়া হয়ে গেছে এমনটা আর ঘটেনি। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দেউলিয়ার সংবাদ পরিচিত মনে হলেও সরকার দেউলিয়া হয়ে গেছে এমনটা অবাক করার মতোই ঘটনা। চোখের সামনে একটি দেশ রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনার দরুন পথে বসে গেল। তামাম দুনিয়ায় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠলো শ্রীলঙ্কা।

শ্রীলঙ্কায় কী হচ্ছে এটাই এখন টক অব দি ওয়াল্ড। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ নতুন নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে দেশটি। বিগত ছয় মাসের আন্দোলনের যে ধারাবাহিকতা তার চূড়ান্ত পরিনতি দেখল বিশ্ব। একটা পরিবার একটা দেশকে শেষ করে দিয়ে নিজেরাও ধ্বংস হলো। দুনিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসগুলো এমনি। স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ কিংবা কর্তৃত্ববাদে-জালিম শাসক শ্রেণির উত্থান-পতনের কারণ ও পরিনতি কিন্তু একই  ভিন্ন দেশ হলেও। জালিমদের চরিত্রগত কোনো পার্থক্য নেই। শ্রীলঙ্কায় যা ঘটে গেল তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়,বরং বাস্তবতা। রাষ্ট্রকে শোষণ করে টিকে থাকার রাজনীতিতে সফল হওয়ার সংখ্যা নেহাতই কম।

আরও পড়ুন: শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ

শ্রীলঙ্কার জনগণ প্রথমে সরকারের বিরুদ্ধে নানা দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে গোটাবায়ে রাজাপক্ষে এবং মাহিন্দা রাজাপক্ষের সরকার বিরোধীদের উপর আন্দোলন দমনের নির্মম নির্যাতনের পথ বেছে নেওয়ায় বিরোধীদের বিক্ষুদ্ধ করে তুলে। মূলত দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি,জ্বালানি তেলের সংকট, বৈদেশিক ঋণের বোঝা, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া, ওষুধ সংকট, বিদ্যুৎ সংকট থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের কারণ আরো বেড়েছে।

খুব সহজ কথায় বললে শ্রীলঙ্কার সরকার মূলত ‘‘ঋণ করে ঘি খাওয়ার পরিনতি’’ ভোগ করছে। ঋণের টাকায় বিশাল বিশাল মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে বাহাদুরি দেখাতে গিয়েই সব ধ্বংস হলো। জনগণ এমন একটা শক্তি যাকে কিছু সময় দমিয়ে রাখা গেলেও সব সময় পারা যায় না। একসময় ঠিকই বিদ্রোহে জ্বলে উঠে, বিদ্রোহের আগুনে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দুঃশাসনের ইতিহাস। শ্রীলঙ্কাও এর বাইরে ছিলনা। জনগণ স্বৈরাচারকে শ্রীলঙ্কায় ক্ষমা করেনি।

দুই.

কলম্বো পোর্ট সিটি শ্রীলঙ্কা সরকারের অনেকগুলো বিলাসবহুল মেগা প্রকল্পের একটি। সমুদ্রে কৃত্রিম দীপ জাগিয়ে তার উপর একটি শহর বানানোর মতো উচ্চ বিলাসী মেগা প্রকল্প কেন ঋণ করে করতে হবে? ঋণের টাকায় সমুদ্রে কৃত্রিম দীপ জাগিয়ে সেখানে নতুন শহর বানিয়ে দুবাই, হংকং কিংবা সিঙ্গাপুরের সাথে টেক্কা দেওয়ার সরকারি পলিসি কী খুব প্রয়োজনীয়,বাস্তব সম্মত এবং জরুরী ছিল? যে প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয় শ্রীলঙ্কা যা পঁচিশ বছরে শোধ করার কথা।

এছাড়া রাজাপক্ষে পরিবারের নিজ জেলায় হাম্বানটোডা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করে সরকার। উপযুক্ত আয়ের মুখ না দেখতে পেরে চীনের কাছ থেকে ঋণের টাকায় করা এই হাম্বানটোডা গভীর সমুদ্র বন্দরকেও নিরানব্বই বছরের জন্য চীনের কাছে লিজ দিতে বাধ্য হয় শ্রীলঙ্কা। এছাড়াও রাজাপক্ষে পরিবার নিজ জেলা হাম্বানটোডায় ব্যয়বহুল বিমানবন্দর, মেগা উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে শ্রীলঙ্কা মূলত সরকার নয়, রাষ্ট্রকেই দেউলিয়া করে ছাড়লো।

বিগত বিশ বছরে অর্থাৎ রাজাপক্ষে পরিবারের শাসনামলে শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক বিনিয়োগ অনেক কমেছে।শ্রীলঙ্কায় হঠাৎ করে ভ্যাট এবং সরকারি ট্যাক্স পনের পারসেন্ট থেকে কমিয়ে আট পারসেন্ট এ নিয়ে আসলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার প্রয়োজনীয় অর্থ আয়ে ব্যর্থ হয়। বিগত কয়েক বছর যাবত কোনো ধরনের এক্সপেরিমেন্ট ছাড়াই রাসায়নিক স্যার এবং কীটনাশক আমদানি নিষিদ্ধ করে শ্রীলঙ্কা কৃষি ক্ষেত্রে অর্গানিক চাষপদ্ধতি শুরু করে।

এটাও ছিল সরকারের একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এর ফলে কৃষি উৎপাদন কমে যায়, যে শ্রীলঙ্কা চাল রপ্তানি করতো তাদেরকেই চাল আমদানির উপর নির্ভর করতে হয়েছে। অথচ করোনায় বৈদেশিক রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার পরিস্থিতিতে চাল আমদানি করা ছিল বাড়তি সংকট। চীনে করোনা প্রথম শনাক্ত হয়। চীনা পর্যটকের একটা বড় বাজার ছিল শ্রীলঙ্কা। করোনার জন্য চীন সহ বিদেশী পর্যটকরা শ্রীলঙ্কা আসেনি অথচ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির একটা বড় পার্ট পর্যটন।

একটা দেশের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেলে সরকার বাজারে সার্বভৌম বন্ড ছাড়ে, ব্যয় মেটাতে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে শ্রীলঙ্কাকে সেই পথেও হাটতে হয়েছে। সারে বারো বিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে এই সার্বভৌম বন্ড থেকেই। শুধু চীন থেকেই শ্রীলঙ্কা পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছে।

এছাড়া জাপান, এডিবি তো আছেই। রয়েছে দেশীয় নানা প্রতিষ্ঠান যেখান থেকে শ্রীলঙ্কা সরকার তার অপরিকল্পিত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ঋণ নিয়েছে। চীন আগ বাড়িয়ে তর্ক ছাড়াই ঋণ দিয়েছে। চীনের মাথায় রাজনীতি। ভূ রাজনীতি। ভারত মহাসাগরকে নিয়ন্ত্রণ করার রাজনীতি। শ্রীলঙ্কা এখন এতটাই ঋণ গ্রস্ত যে তেল আমদানি করার মতো,জ্বালানি আমদানি করার মতো, প্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্য কেনার মতো বৈদেশিক মুদ্রা তার হাতে নেই। অথচ প্রতিবছর এখন শ্রীলঙ্কাকে মোট ঋণের সাত বিলিয়ন পরিশোধ করার কথা।

তিন.

কথা হচ্ছে এই যে এত রাষ্ট্রীয় ঋণের বিকল্প কি শ্রীলঙ্কার হাতে আসলে কিছু ছিল? নেগেটিভ উত্তর দেওয়ার সুযোগ এই প্রশ্নের উত্তরে অসম্ভব। সুযোগ ছিল। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা, একটা পরিবারের উচ্চাবিলাস, সীমাহীন দুর্নীতি, একটা সিস্টেম। বিষয়টা এমন নয় যে এটা শুধু শ্রীলঙ্কাতেই হচ্ছে বা হবে। জুলুমবাজ, স্বৈরশাসকগুলো তার সকল অন্যায়, অবিচার, গুম, খুন, নিপীড়ন নির্যাতন জায়েজ করতে একটা ডেভেলপমেন্ট হেজিমনি দাঁড় করায়। যাতে উন্নয়নের গল্প শুনে রাষ্ট্রীয় অবিচারগুলো মানুষ ভুলে যায়।

শ্রীলঙ্কা সরকার স্রেফ স্বৈরশাসনে ঠিকে থাকার পুরনো এবং খুব কমন একটা সূত্রই প্রয়োগ করেছে। এখন ছাত্ররা কাগজের অভাবে পরীক্ষা দিতে পারছে না। সিএনজি স্টেশনে ঘন্টার পর ঘন্টা তেলের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। অজুহাত হিসাবে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এমনটা হচ্ছে- এমন যুক্তি কি যথেষ্ট? বিদ্যুৎ এর অভাবে উৎপাদন থেমে গেছে। বাসা বাড়িতে লাইট, ফ্যান,ফ্রীজ চলছে না! পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, ২০১৯ সালে যে চাল ছিল প্রতি কেজি নব্বই রুপি, এখন তা দুইশ বিশ রুপি। ডাল কেজি একশ বিশ থেকে এখন ছয়শত রুপি। কাঁচা মরিচ তিনশ বিশ থেকে নয়শ রুপি হয়ে গেল-মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে? [সূত্র -বিবিসি বাংলা, সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কা]

এরকম একটা দমবন্ধকর রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শ্রীলঙ্কার জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। লড়াই করেছে। স্বাভাবিক জীবন চেয়েছে।অধিকার চেয়েছে। সরকারের পতন হয়েছে। এমনটাই তো প্রত্যাশিত ছিল। অবশেষে তাই হয়েছে। সরকারের লজ্জা জনক পতন হয়েছে।

আরও পড়ুন: শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ

কার ভুলে শ্রীলঙ্কা এমন একটা খারাপ সময়ের মুখোমুখি হলো? এই প্রশ্নের উত্তরে একটা পরিবারের নামই চোখের সামনে ভেসে উঠে। রাজাপক্ষে পরিবার। রাজতন্ত্র না থাকার পরেও শ্রীলঙ্কায় যা হয়েছে তা জনগণের প্রতি উদাসীন রাজার নিষ্ঠুরতম শাসনের চাইতেই বেশি। শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে মাহিন্দা রাজাপক্ষে এবং গোটাবায়া রাজাপক্ষে পরিবার যা করেছে তা শুধু সরকার নয়, রাষ্ট্রকেও পথে বসিয়ে দিয়েছে। একটা পরিবারের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং উদাসীন শাসনব্যবস্থা শ্রীলঙ্কাকে এমন একটা জায়গায় এখন নিয়ে গেছে যেখান থেকে ফেরা অসম্ভবই বটে।

শ্রীলঙ্কান ফ্রিডম পার্টির নেতা মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২০০৪ সালে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতার মূল মঞ্চে চলে আসেন। সে বছর তিনি শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এক বছর পর ২০০৫ সালে মাহিন্দা রাজাপক্ষে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০০৫ থেকে ২০১৫ একাধারে এক দশক শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। সে সময় তার ভাই অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা গোটাবায়া রাজাপক্ষেকে মাহিন্দা তার প্রতিরক্ষা সচিব নিয়োগ করেন।

মাহিন্দা যতদিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন ততদিন তার ভাই গোটাবায়াও শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। ভাই,পুত্র, ভাইপোদেরকেও মন্ত্রী-এমপি বানিয়ে শ্রীলঙ্কাকে মূলত রাজাপক্ষে পরিবারের একটি পারিবারিক শাসনব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসা হয়। রাজাপক্ষে পরিবারের পরিবারতন্ত্র শ্রীলঙ্কার মানুষের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেয়, সুশাসন থেকে বঞ্চিত করে,বিরোধীদের গুম-খুনের অভয়ারণ্যে পরিণত করে এবং সর্বোপরি ভয়ংকর এক ভয়ের সংস্কৃতি চালু করে।

মেগা প্রকল্পের নামে চলেছে মেগা দুর্নীতি। রাষ্ট্রীয় তহবিল খালি হয়েছে রাজাপক্ষে পরিবারের ভুল রাজনৈতিক চালে। সুতরাং জনগণের তো ক্ষমা করার কথা না! মাহিন্দার বাবাও ছিলেন শ্রীলঙ্কার একজন এমপি। তবে দুই ছেলে মাহিন্দা ও গোটাবায়ার হাতেই রাজাপক্ষে পরিবার শ্রীলঙ্কার ক্ষমতার চরম পর্যায়ে আসীন হয়ে এক অস্বাভাবিক পরিবারতন্ত্র কায়েম করে, যার নাম দেয়া যেতে পারে রাজাপক্ষে সাম্রাজ্য!

২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতা কয়েক বছরের জন্য পরিবর্তন হয়। রাষ্ট্রপতি হন মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। এ সময় গোটাবায়া রাজাপক্ষে অবসর জীবন কাটাতে আমেরিকায় চলে যান। কিন্তু সিরিসেনার পতন হলে ২০১৯ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিতে গোটাবায়া রাজাপাকসে আমেরিকা থেকে শ্রীলঙ্কায় ফেরেন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। নতুন করে মাহিন্দা রাজাপক্ষে হন প্রধানমন্ত্রী। এভাবেই একটা পরিবারের চরম নিয়ন্ত্রণে, মাফিয়া স্টাইলের শাসনে চলে যায় একটা দেশ। যার নাম শ্রীলঙ্কা।

চার.

ফ্যাসিবাদ চূড়ান্ত পর্যায়ে নিজেই নিজের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শ্রীলঙ্কাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া বিরোধীদের বিক্ষোভে সরকারের চূড়ান্ত পতন হলো জুলাইয়ে। রাজাপাকসে পরিবারের ক্ষমতার প্রাসাদ জনতার বিক্ষোভে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। কে ভেবেছিল রাষ্ট্রপতির সুইমিং পুলে সাতার কাটবে বিক্ষোবদ্ধ জনতা? রাষ্ট্রপতির সোফায়, বিচানায়, চেয়ারে শুয়ে বসে মনের আনন্দে বিজয় উদযাপন করছে বিপ্লবীরা? রাষ্ট্রপতির ভবন চলে যাবে আম জনতার দখলে?

প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে গেছে অজানায়, কোর্ট তাকে দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। রাষ্ট্রপতির বাড়ি দখল করে বসে আছে বিক্ষোভকারীরা। রাষ্ট্রপতি গোটাবায়াও ক্ষমতা ছেড়ে পালালেন। বিশেষ বিমানে গোটাবায়া মালদ্বীপ হয়ে এখন সিঙ্গাপুরে। অপেক্ষায় আছেন তৃতীয় কোনো দেশে যাওয়ার। প্রায় দুই দশকের মতো সময়ে শ্রীলঙ্কা রাজাপক্ষে পরিবারের নিষ্ঠুরতম শাসনে অনেক কিছুই হারালো। যারা শাসন করলো তারা নিজেরাও ধ্বংস হলো।

শ্রীলঙ্কার জাফনা দীপকে স্বাধীন করে হিন্দু তামিলরা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিল। তাদের বিদ্রোহী নেতা ভিলুপিল্লাই প্রভাকরণ তামিলদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে গঠন করে ছিলেন এলটিটিই নামক একটি স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী সংগঠন। বিশ্বে এলটিটিই-ই একমাত্র স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের সংগঠন ছিল যাদের নিজস্ব সেনা,নৌ এবং বিমান বাহিনী পর্যন্ত ছিল। সেই এলটিটিই-কে ধ্বংস করে রাজাপক্ষের সরকার। তাদের নেতা ভিলুপিল্লাই প্রভাকরণকে হত্যা করে।

২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের সামরিক বাহিনীর অভিযানে চূড়ান্ত ভাবে দমন করার অপারেশনে যায় মাহিন্দা সরকার। প্রায় চল্লিশ হাজার তামিল হত্যার শিকার হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যার অভিযোগ উঠে রাজাপক্ষের সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনো একশন হয়নি তাদের বিরুদ্ধে। রাজাপক্ষে সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রীলঙ্কার সিংহলি জনগোষ্ঠীর মানুষের কাছে তামিল বিদ্রোহীদের দমন করে রীতিমতো নায়ক, মহানায়ক বনে যায়। 

মাহিন্দাকে সিংহলি বৌদ্ধ রাজা এমনকি বৌদ্ধ সম্রাটের সাথেও তুলনা করা হত। নিষ্ঠুরতম উপায়ে তামিল বিদ্রোহীদের দমনে রাষ্ট্রপতি মাহিন্দা রাজাপক্ষে, তৎকালীন সামরিক সচিব গোটাবায়া রাজাপক্ষে এবং তৎকালীন সেনাপ্রধান সনত ফনসেকা শ্রীলঙ্কার সিংহলি জনগোষ্ঠীর কাছে বীরের মর্যাদা পান।কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা। জনগণ তাদের দুঃশাসনের প্রতিশোধ নিতে ভুল করেনি। 

এখন কিন্তু তামিল,সিংহলি,মুসলিমরা একসাথেই লড়াই করছে রাজাপক্ষে পরিবারের বিরুদ্ধে। রাজাপক্ষে পরিবারের পরিবারতন্ত্রের পতন হয়েছে। শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির একমাত্র এমপি রনিল বিক্রমাসিংহে এখন শ্রীলঙ্কার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাষ্ট্রপতি,প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। শ্রীলঙ্কায় এখন প্রয়োজন দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি গ্রহণ যোগ্য অংশ গ্রহণ মূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা এবং জনগণের সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।

যেকোনো বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের পরে জনগণের নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারাও বিপ্লব বা অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। সে হিসাবে শ্রীলঙ্কায় বিক্ষোবদ্ধ জনতার প্রত্যাশা কতটা পূরণ হবে তা নির্ভর করবে দ্রুততম সময়ে একটা সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ অংশ গ্রহণ মূলক নির্বাচনে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার উপর। রাজাপক্ষে পরিবারের পতনের ক্ষমতার রাজনীতি কার হাতে যায় তার উপর নির্ভর করবে জনগণের প্রত্যাশা প্রাপ্তি কতটুকু পূরণ হবে।চীন শ্রীলঙ্কায় একটা বেশ ভালো ধাক্কা খেলো বলা যায়।

পাঁচ.

শ্রীলঙ্কার বিক্ষোবদ্ধ জনতার এই লড়াই আপাতত জয়ী হলো বলেই ধরে নেয়া যায়। এটা বিপ্লব নাকি গণ অভ্যুত্থান সেই অর্থহীন তর্কের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দারুণ সাহসে জেগে উঠেছে। মানুষকে নিষ্ঠুরতম শাসনের মাধ্যমে হয়ত কিছু সময়ের জন্য দমিয়ে রাখা যায় কিন্তু পরাজিত করা যায় না। মানুষ শেষ পর্যন্ত জেগে উঠে এবং জয়ী হয়। শ্রীলঙ্কা এমন বার্তাই দিয়ে গেল। একটা রাষ্ট্র,একটা জাতির স্বপ্ন গিলে খাচ্ছিল একটা পরিবারের দুর্নীতি,উচ্চাবিলাশ ও স্বেচ্ছাচারিতা। আর সেই পরিবারটিকে জনগণ ক্ষমতার প্রসাদ থেকে সমূলে উপড়ে ফেলেছে।

মুক্তিকামী মানুষের জন্য এর থেকে ভালো সংবাদ আর হয় না। শ্রীলঙ্কায় যা ঘটলো এটা কোনো নতুন কিংবা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং যেকোনো স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার চূড়ান্ত পরিনতি, শেষ বিদায়টা এমনি হয়। শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষে পরিবারটি শুধু মাত্র একটি পরিবার নয়। দেশে দেশে স্বৈরাচার,ফ্যাসিবাদ এবং কর্তৃত্ববাদের প্রতীক হয়ে এই ধরনের অনেক রাজাপক্ষেরাই আছে। এদের সবার পরিনতি একই হয়, একই হবে কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। জনগণের চেয়ে শক্তিশালী কোনো মিলিটারি নাই।

জনগণ রাস্তায় নেমে গেলে কোনো রাজাপক্ষেদেরই রেহাই নাই।শ্রীলঙ্কা এই বার্তাটাই দিচ্ছে। শ্রীলঙ্কার ঘটনার একটা রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিবেশীদের উপর কমবেশি কিছুটা তো পড়বেই। বর্তমান ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড বর্ডারলেস,কোনো সীমানা নেই, কাটাতারের বেড়া নেই। শ্রীলঙ্কার জনগণ যে কাজটা করেছে এটা একটা অনেক বড় রাজনৈতিক  ঘটনা। এসব ঘটনা প্রমাণ করে জনগণের ঐক্যবদ্ধ লড়াই কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীর চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। রাজপথে লড়াইয়ের মাধ্যমে একটা স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানোর হিম্মত যারা রাখে নতুন ভোরের সূর্যোদয় তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকবেই।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক


সর্বশেষ সংবাদ