শ্যালক ও অভিভাবকবৃন্দ

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান  © সংগৃহীত

সারাক্ষণ রাজনীতি করে যাচ্ছেন এমন শিক্ষকরাও শিক্ষক রাজনীতিকেই সবকিছু নষ্টের জন্য দায়ী বলে ঢালাও মন্তব্য করেন। তবে সরকার বিরোধী রাজনীতি নির্দোষ, এটা জায়েজ ।

সরকারকে সমর্থন করলেই আপনি ‘দালাল’ হয়ে যাবেন‌ । আমার এক শ্রদ্ধাভাজন দার্শনিক শিক্ষক সকলের কাছে আমার প্রশংসা করতেন। বলতেন, মিজান অত্যন্ত মেধাবী, সত্যিকারের শিক্ষকের যেসব গুণাবলী থাকা দরকার সবই তার মধ্যে আছে। অনেকে ভালো ছাত্র হলেও ভালো শিক্ষক হন না। মিজান এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সে ‘জিরো ডিফেক্ট’ এ কাজ করে, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সবকিছুর পরে অতিরিক্ত এক লাইন যুক্ত করতেন, ‘তবে আওয়ামী লীগ করে।’

আরও পড়ুন: ঢাবিতে ‘সেকেন্ড টাইম’ রাখার সিদ্ধান্ত হয়নি

বাম দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হন, বাম ছাত্র সংগঠনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে অল্প সংখ্যক দর্শক-শ্রোতার সামনে আপনার ঐতিহাসিক মতাদর্শের সমর্থনে দীর্ঘ বক্তৃতা দেন তাতে আপনাকে কেউ কিছু বলবেনা। সমস্যা হবে আওয়ামী লীগ করলেই অথবা যদি আপনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করে থাকেন, তাহলে রক্ষা নেই।

বছর তিনেক আগে বড় একটা বিপদে পড়েছিলাম। মিডিয়ার খপ্পরে পড়েই এমনটি হয়েছিল। আমি তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ক্যাসিনো কাণ্ডে যুবলীগ তখন তছনছ। যেহেতু আমি দীর্ঘদিন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ছিলাম (আইনসম্মত ভাবেই) , বহুবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলাম, বিশেষ করে ওয়ান-ইলেভেনের পর। আমি তখনো এ পদ থেকে পদত্যাগও করিনি বা আমাকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়নি। যুবলীগের ওয়েবসাইটে তখনো প্রেসিডিয়ামের এক নম্বর সদস্য হিসাবে আমার নাম লেখা ছিল।

তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগদানের দিন থেকেই যুবলীগের সাথে সকল সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে সংগঠনটির সাথে কোন সম্পর্ক রাখিনি। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারিকে কথিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডার কেলেঙ্কারির কারণে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তাঁদের স্থলে যথাক্রমে এক নম্বর সহসভাপতি এবং এক নম্বর জয়েন্ট সেক্রেটারিকে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সেক্রেটারির দায়িত্ব দেয়া হয়।

আরও পড়ুন: মেয়াদহীন চবি ছাত্রলীগ, আড়াই বছরেও হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি

ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির কারণে যখন যুবলীগের চেয়ারম্যানের পদ শুন্য হলো তখন এক কৌতুহলী সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি যেহেতু যুবলীগের এখনো এক নম্বর সহ সভাপতি আপনাকে যদি নেত্রী যুবলীগের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয় তাহলে কি এই দায়িত্ব আপনি নেবেন?’ আমি বলেছিলাম, ‘নেত্রী আমাকে যখন যে দায়িত্ব দিয়েছে আমি সেটা নিষ্ঠার সাথে পালন করেছি। তবে শিক্ষকতার পেশাদারিত্বের সাথে কখনো আপস করিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগদানের পর যুবলীগের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। ভালো সময়ে আমি যুবলীগ করেছিলাম, এখন দুর্দিনে পালিয়ে যাওয়ার লোক আমি নই। আমাকে দায়িত্ব দিলে আমি নেব। তবে সেটা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ ছেড়েই নেব। একসাথে আমি দুটি কাজ করবো না।’ এই ছিল আমার কথা। বাকিটা ছিল মিডিয়ার সৃষ্টি : ‘উপাচার্যের পদ ছেড়ে যুবলীগের চেয়ারম্যান হতে চান!’ দুই সপ্তাহ জুড়ে মিডিয়ার শীর্ষ আলোচনার বিষয় ছিল এটি।

ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান এক বছরের জন্য সাসপেন্ড হলে উপাচার্যের বিষয়টি মিডিয়ায় কিছুটা চাপা পড়ে যায়। তবে আলোচনার বিষয় হিসাবে এখনো এটা জীবন্ত। বিগত দুই তিন বছর যাবত এই আলোচনা কোনো ভাবেই থামছে না। এর থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসা যাচ্ছে না।

অতিসম্প্রতি শাহজালাল কান্ডের সময় বিভিন্ন টকশোতে এবং লেখায় উপাচার্যরা যেসকল গর্হিত কাজ করেন তার তালিকায় এটাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কেউ বলছে না, ‘আমি এটা হতে চাইনি বরং এই পদে আমি আগেই ছিলাম।’ ওয়ান-ইলেভেনের পর জাতির ‘বিবেকরা’ যখন পালিয়ে ছিল অথবা রাজনৈতিক শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতিবিদ হওয়ার চেষ্টা করছিল তখন চরম ঝুঁকি নিয়ে বিরাজনীতিকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকা অবস্থায় সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন সেই ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেন ওই সময়ে প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ‘কথিত যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার ইচ্ছা পোষণের’ প্রসঙ্গটির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।

একজন সিনিয়র শিক্ষক যিনি সত্যিকার অর্থেই তাঁর বিষয়ে একজন প্রতিষ্ঠিত পন্ডিত, তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘জনপ্রিয় শিক্ষক হওয়ার একটা সহজ ও সস্তা বুদ্ধি হচ্ছে কম পড়ানো, ছাত্রদের কম চাপ দেয়া, সহজ প্রশ্ন করা এবং বেশি নম্বর দেয়া।’ ছাত্ররা যেহেতু অ্যাডাল্ট তারা নিজেরাই পড়ে নিবেন। তাদেরকে অবাধ সুযোগ করে দিতে হবে। আলাপ-আলোচনা এবং আড্ডার মধ্য দিয়েই তারা সবকিছু শিখে ফেলবে। সেটা ‘টিলার’ উপরে বসে হোক আর ‘টং’ এর চারপাশে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডার মাধ্যমেই হোক। বেশি পড়ানোর দরকার নেই। তবে এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের একটি বক্তৃতার অংশ মনে পড়ে গেল। স্যার বলেছিলেন ছাত্ররা শিক্ষকদের ‘শালা’ বলবেই।

ছাত্রদের যদি অতিরিক্ত পড়াশোনার জন্য চাপ দেন তখন বলবে, ‘এই শালা অনেক জ্বালাচ্ছে।’ কোনো চাপ না দেয়ার কারণে বা না পড়ানোর কারণে আপনাকে ‘শালা’ না বললেও কর্মজীবনে যখন কোনো সমস্যায় পড়বে তখন বলবে, ‘ওই শালা আমাদের ওই টপিকটা পড়ায়নি, যার কারণে এখন এই সমস্যাটি সমাধান করতে পারছিনা।’ অর্থাৎ ছাত্রদের ‘শ্যালক’ আপনাকে হতেই হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বেশি পড়িয়ে হবেন, না কম পড়িয়ে হবেন।

আরও পড়ুন: ঢাবি হলের অপরিচ্ছন্ন ও অপুষ্টিকর খাবারে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

রাজধানীর বাইরের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যিনি নিজে একজন নিবেদিত গবেষক, তার বিষয়ের পৃথিবীর সেরা জার্নালে একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন,‘আপনার যদি মহান শিক্ষাবিদ বা শিক্ষাগুরু হওয়ার আগ্রহ থাকে, তাহলে শিক্ষাবান্ধব হওয়ার দরকার নেই, শিক্ষার্থী বান্ধব হলেই চলবে।’ সব সময় ছাত্রদের আন্দোলন-সংগ্রাম, আনন্দ, বেদনা, উচ্ছ্বাস সবকিছুকে সমর্থন জানাবেন। প্রশাসনের বিপক্ষে দাঁড়াবেন। প্রশাসনের জন্যই তো ছাত্রদের যত ‘না পাওয়া’। সবকিছুর জন্য প্রশাসনেই দায়ী। এতে দুটো কাজ হবে। রাতারাতি আপনি ছাত্রদের ‘অভিভাবক’ হয়ে যাবেন। প্রশাসনও আপনাকে তোআজ করবে। আর আপনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন নিয়ম কানুন না মেনে যা খুশি তাই করতে পারবেন। কেউ বাধা দিবেনা। কোন ছুটি ছাড়াই আপনি কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবেন এবং সারা দেশে ঘুরে ঘুরে ছাত্রবান্ধব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হতে পারবেন অথবা নিদেনপক্ষে বিভিন্ন আন্দোলনে মানববন্ধনের মানব ঢাল হতে পারবেন।

নিজের বিষয়ে মৌলিক কোনো গবেষণা না করলেও বা একটিও বিশ্বমানের ভালো প্রবন্ধ বা বই না লিখলেও আপনাকে জাতির সবাই মহাজ্ঞানী ভাববে। ভুলেও কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব নিবেন না। কারণ দ্রুত আপনি জনপ্রিয়তা হারাবেন। বাংলাদেশের মত ‘টানাটানির’ দেশে দাবিকে সমর্থন করা যত সহজ, দাবি পূরণ করা তত সহজ নয়। দীর্ঘদিন শিক্ষার শান্ত পরিবেশ বজায় থাকা এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমাকে বলেছিলেন শিক্ষার্থী বান্ধব (জ্ঞান বা শিক্ষাবান্ধব নয়) তথাকথিত ‘অভিভাবকদের’ ছাত্রদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা গেলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত পরিবেশ বজায় থাকে, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত পরিবেশেই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিশ্চিত করে না।

(পাঠকদের এই লেখাটি সিরিয়াসলি না নেয়ার জন্য অনুরোধ করছি। এটি একটি রম্য রচনা)

লেখক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য


সর্বশেষ সংবাদ