জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ও কিছু পর্যবেক্ষণ
- ড. মো. রেজাউল করিম
- প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২১, ০১:২৮ PM , আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২১, ০১:২৮ PM
শেষ হলো ঢাকার অদূরে (রাজধানী থেকে মাত্র ৩২ কিলোমিটার দূরে) সাভার এলাকায় প্রায় ৬৯৭.৫৬ একর এলাকা নিয়ে ১৯৭০ সালে দেশের প্রথম ও একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ দিনব্যাপী ভর্তি পরীক্ষা।
এবার মোট ৪৬ শিফটে এই ভর্তি পরীক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে। পরিবহন ধর্মঘটের কারনে ২ দিন পরীক্ষা পেছানো এবং ১ দিন সরকারি বন্ধের কারণে এই ৯ দিনের পরীক্ষা সম্পূর্ণ হতে ৩ সপ্তাহে গড়িয়েছে। কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট সচেতন ও আন্তরিক হলে কমপক্ষে এর চেয়ে অর্ধেক কম সময়ে ভর্তি পরীক্ষা সম্পূর্ণ করা যেত।
ইনস্টিটিউটগুলো আলাদা আলদা পরীক্ষা নেওয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। যেমন ধরুন IIT Institute আলাদা পরীক্ষা না নিয়ে A unit এর সাথে পরীক্ষা নিতে পারতেন। A unit এর প্রশ্নের সাথে IIT Institute এর প্রশ্নের পার্থক্য কোথায়? একই ভাবে IBA-JU বিজনেস ফ্যাকাল্টির সাথে নিতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট, ‘ল’ ফ্যাকাল্টি (এক সাবজেক্ট নিয়ে এক ফ্যাকাল্টি) আলাদা আলাদা পরীক্ষা না নিয়ে কাছাকাছি কোন ফ্যাকাল্টির সাথে যুক্ত হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ভোগান্তি কমানো যেত।
আমরা যদি এইচএসসির সিলেবাসের উপর পরীক্ষা নিই, তবে শুধু মাত্র ৩ ইউনিটে (সাইন্স, আর্টস, কমার্স ইউনিট) পরীক্ষা নিয়ে বিভিন্ন বিভাগের রিকয়ারমেন্ট অনুযায়ী শর্তসেট করে ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার্থীদের সাবজেক্ট চয়েস এর উপর ভিত্তি করে সকল সাবজেক্টে যোগ্য শিক্ষার্থী ভর্তি করানো সম্ভব। অপ্রয়োজনীয় ভাবে এত ভাগে একই সিলেবাসের উপর আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা একধরণের গোঁড়ামি ছাড়া আর কি? বিদেশে ইনস্টিটিউটগুলোর কার্যক্রম আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউটগুলোর কার্যক্রম একদমই আলাদা। দু’একটা ইনস্টিটিউট ছাড়া বাকিগুলোর কার্যক্রম বিভাগের মতই। তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে সেভাবে সার্ভ করে না। সেক্ষেত্রে এত আলাদা আলাদা ইনস্টিটিউট না করে কাছাকাছি ফ্যাকাল্টির আন্ডারে বিভাগ হিসেবে রাখাই শ্রেয়।
ভর্তি পরীক্ষার সময় সকল ইউনিট এবং সেটের প্রশ্নের ফরম্যাট অভিন্ন হওয়া উচিৎ। সকল ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার কমিটি ভিন্ন, তাই ফরম্যাটও ভিন্ন হয়। এতে পরীক্ষার হলে ছাত্র-ছাত্রীরা ভুল বেশি করেন। যেমন: ‘ডি’ ইউনিট যে পজিশনে প্রশ্নের সেট কোড লিখা ছিল, ঠিক IIT Institute সেই পজিশনে unit কোড লিখা ছিল। এবং সেট কোড অন্য কর্নারে ছোট করে লিখা ছিল। IIT Institute এর পরীক্ষা ‘ডি’ ইউনিট পরীক্ষার ঠিক পরের দিন হওয়াতে অনেক ছাত্র-ছাত্রী ভুল করে সেট কোডের জায়গায় unit কোড লিখেছেন। সেন্ট্রাল ভর্তি কমিটি থেকে একটা কমন ফরম্যাট দেওয়া থাকলে এই ভুল হতো না। এছাড়াও কোন কোন ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা শুরুর ঠিক আগ মুহুর্তে কোন সেট প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা হবে তা Randomly সিলেক্ট করা হয় এবং সেটাই উচিৎ। এতে পরীক্ষা কমিটির কোন মেম্বারও পরীক্ষা শুরুর আগ পর্যন্ত জানেন না যে কোন সেট প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা হবে কিংবা কোন প্যাকেট কখন ডিস্ট্রিবিউশন হবে। এতে সিকিউরিটি অত্যন্ত মুজবুত হয়।
আমার জানামত শুধু ‘এ’ ইউনিট এবং ‘ডি’ ইউনিট এটা করেন। অন্যেরা প্রশ্ন প্যাকেট করার আগেই Randomly সেট সিলেক্ট করেন এবং এতে করে যারা প্যাকেট করেন তারা জানেন যে কোন প্যাকেটে কোন সেট প্রশ্ন আছে এবং তা কখন পরীক্ষা হবে, কোন শিফটে হবে। এতে করে আসলে ডাবল ব্লাইন্ড হচ্ছে না এবং প্রশ্ন Randomly সিলেক্ট করার উদ্দেশ্য হাসিল হচ্ছে না।
প্রতিবারের মত এবারও জাবিতে ‘শিফট বৈষম্য’ এর শিকার হয়েছেন ভর্তিচ্ছুরা। একই ইউনিটে বিভিন্ন শিফটের প্রশ্ন ভিন্নতার কারণে কোন শিফট থেকে বেশি আবার কোন শিফট থেকে খুবই কম সংখ্যক পরীক্ষার্থী মেধা তালিকায় স্থান পাচ্ছে। ফলে বড় বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। যেমন ‘বি’ ইউনিটের মোট ৩২৬টি আসনের মধ্যে শুধুমাত্র ৫ম শিফট থেকে সর্বোচ্চ ২১৭ জন অপরপক্ষে ২য় শিফট থেকে সর্বনিম্ন ১২ জন মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছেন। এই বিতর্কিত শিফট পদ্ধতি বছরের পর বছর চলতে পারে না।
যদি আমরা শিফট পদ্ধতি রেখেই সমাধান করতে চাই, তবে প্রতি শিফট থেকে যতটি আসন থাকবে কমপক্ষে সেই সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বাচাই করে এবং সব শিফট থেকে বাচাই করা ভর্তিচ্ছুকদেরকে আবার আরেকটা রিটেন পরীক্ষা নিয়ে এই ‘শিফট বৈষম্য’ সম্পূর্ণ দূর করা সম্ভব। এমনিতে ভর্তিইচ্ছুকরা ভাইভা দিতে আসে, তখন এই পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। এছাড়াও HSC গ্রেডের উপর ভিত্তি করে সব গ্রেড (A+, A, A- সহ সব গ্রেড) থেকে অথবা SSC এবং HSC স্কোরের উপর ভিত্তি করে (মেধাক্রম অনুসারে সিস্টেমেটিক হারে অর্থাৎ ১ম পজিশন ১ম সিফটে, ২য় পজিশন ২য় সিফটে, ৩য় পজিশন ৩য় শিফটে এবং এই ভাবে সব শিফট শেষ হলে আবার ১ম শিফট থেকে বন্টন) ভর্তিচ্ছুকদেরকে সমহারে সব শিফটে Randomly ভাগ করে প্রতি শিফট থেকে নির্দিস্ট সংখ্যাক মেধাতালিকায় স্থান দিয়ে ‘শিফট বৈষম্য’ একেবারে দূর করতে না পারলেও কমানো সম্ভব। আর শিফট পদ্ধতি বাদ দিয়ে দেশের বিভিন্ন শহরে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষার আয়োজন করা গেলে সেটাই সবচেয়ে ভালো সমাধান।
আগামী ডিসেম্বরের ১ ও ২ তারিখে ভাইভা পরীক্ষা হবে এবং এর পরেই চূড়ান্ত মেধা তালিকা প্রকাশ করবে। যারা চূড়ান্ত মেধা তালিকায় স্থান পাবে, তাদেরকে অগ্রীম অভিনন্দন এবং শুভ কামনা রইল। শ্যামল পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তির সুযোগ পাবে, তাদের স্বাগত জানাতে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। নিশ্চয়ই তারা আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মেধা বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্ব পরিমন্ডলে বিস্তৃতকরণ অব্যাহত রাখবে এই প্রত্যাশায় রইলাম।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়