আমরা কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে পারি না?

২০২০ সালের মে মাসে জাপানে প্রথমবারের মতো জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল। সেই সময় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এরপর ১ জুন দেশটির ৩৫ হাজার ৮৭৪টি স্কুল পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়
২০২০ সালের মে মাসে জাপানে প্রথমবারের মতো জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল। সেই সময় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এরপর ১ জুন দেশটির ৩৫ হাজার ৮৭৪টি স্কুল পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়  © ফাইল ছবি

বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে মাঝেমধ্যে রাস্তার একটি বড় সিগন্যালে দাঁড়াতে হয়। এই রাস্তার পাশে কয়েকশ মিটারের মধ্যে তিনটি স্কুল। রেলস্ট্রেশন থেকে নেমে শিশুরাও এই সিগন্যালের আটকা পড়ে। মুখে মাস্ক, হাতে স্কুল ব্যাগ নিয়ে সারি সারি শিশুদের দেখলেই বুকটা হাহাকার দিয়ে ওঠে। চোখের সামনে স্কুলে যাওয়া শিশুদের দিকে চেয়ে থাকি আর ভাবি, আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কবে থেকে শিশুদের দেখতে পাব।

কভিডের ভয়ানক থাবায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত হলেও জাপানে ঘটেছে কিছুটা ভিন্ন। করোনার একবারে শুরুতে জাপানে মাস খানেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এরপর আর বন্ধ থাকতে দেখিনি। কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম মোটামুটি স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাচ্ছে, খেলাধুলা করছে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাবাজিও করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা হচ্ছে, পরীক্ষা হচ্ছে, ফলও দেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত করোনার অজুহাতে কোনো কিছু আটকে থাকেনি। বরং কিছু বিধিনিষেধের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগের মতো পাঠদান চলছে। কখনও অনলাইনে আবার কখনও অফলাইনে। বাংলাদেশ কী পারবে জাপানের আদলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করতে?

২০২০ সালের মে মাসে জাপানে প্রথমবারের মতো জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল। সেই সময় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এরপর ১ জুন দেশটির ৩৫ হাজার ৮৭৪টি স্কুল পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়। এসব স্কুলে ১ কোটি ২০ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেখল এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২৪২ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল, যাদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ নিজ বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের দ্বারা সংক্রমিত হয়েছিল। আক্রান্তরা সবাই সেরে উঠেছিল এবং স্কুলে ফিরেছে।

শিক্ষার্থীদের যতটা সম্ভব পড়াশোনায় ব্যস্ত রাখার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছিল জাপানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে তীক্ষষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ যেমন করা হয়েছে, তেমনি সিলেবাসও ঢেলে সাজানো হয়েছে। ছুটি কমিয়ে আনা হয়েছে যাতে তারা দীর্ঘ সময় স্কুল নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে।

নাদিম মাহমুদ

শুধু তাই নয়, সাময়িক বন্ধ থাকা স্কুলগুলোতে পড়াশোনা এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে ক্লাস সচল রাখা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে সিলেবাস শেষ করতে না পারায়, টেপট বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো পড়িয়ে বাকিগুলো পরের বছরের জন্য রাখা হয়েছে। যাতে করে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ না নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়গুলো অধ্যয়নের সুযোগ পায়।

আর স্কুলগুলোতে ভর্তি পরীক্ষাও বন্ধ ছিল না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে শিক্ষার্থীদের বিশেষ যোগ্যতা, যেমন- গান, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কনসহ বিভিন্ন এপর্টা অ্যাক্টিভিটিজে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল, তেমনি আগের বছরের ফল, ক্লাসে উপস্থিতি বিবেচনা করে ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে মৌখিক পরীক্ষা, অনলাইন ও অফলাইন কাজে দিয়েছে।

এ ছাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কভিড সংক্রমণ পর্যবেক্ষণ ও তা মোকাবিলায় করণীয় ঠিক করতে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সামাজিক দূরত্ব মানতে শ্রেণিকক্ষে ছোট ছোট গ্রুপে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে, শিক্ষকদেরও ক্লাস নেওয়ার চাপ বেড়েছে। এসব বিবেচনা করে সরকার অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক সাপোর্টের জন্য কয়েকটি স্কুল মিলে একজন মানসিক কাউন্সিলিং বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়েছে জাপান সরকার। আবার যেসব এলাকা খুবই সংক্রমণপ্রবণ এবং স্কুল বন্ধ ছিল, তাদের অনলাইনে ক্লাসে অংশগ্রহণের নিমিত্তে নিম্ন আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ডিভাইসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

২০২০ জুলাই থেকে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমে কিছুটা পরিবর্তন এনেছিল জাপান সরকার। মূলত ৮৩.৮ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পাঠদান দূরশিক্ষণের মাধ্যমে চালু রেখেছিল। এর মধ্যে ৭০.৬ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ও শ্রেণিকক্ষে বা হাইব্রিড ক্লাসের সমন্বয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। অন্যরা কেবল অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান দিয়েছে। সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গবেষকরা একাডেমিক কার্যক্রম করেছেন। শ্রেণিকক্ষে দু'জনের মাঝখানে একটি করে স্পেস রাখা হয়েছিল। ক্যাফেটেরিয়াগুলোতে মুখোমুখি খাওয়া ও গল্প করা যেত না। এই ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের পার্টিশন থাকত, যাতে করে কেউ কথা বললেও যেন অন্যের শরীরে এয়ার পার্টিকেল পৌঁছাতে না পারে।

সংক্রমণের হার অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি ক্যাটাগরি করেছিল। শূন্য (নীল রং- কোনো বাধা নেই), ১ (হলুদ রং- দূরত্ব মেনে মুখোমুখি ক্লাস করতে পারবে), ২ (কমলা রং- কেবল স্নাতক তৃতীয় বর্ষ ক্লাস করবে), ৩ (লাল রং- শিক্ষার্থীদের আগ্রহের আবেদন পরিপ্রেক্ষিতে), ৪ (বেগুনি রং- সব ধরনের ক্লাস বাতিল, কেবল অনলাইন), ৫ (কালো- অনলাইন ও অফলাইন উভয় বাতিল) ক্যাটাগরিতে ক্লাস-পরীক্ষা পরিচালনা করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ভবনের সামনে স্যানিটাইজার রেখে শিক্ষার্থীদের তা ব্যবহার উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারগুলোতে শিফটভিত্তিক করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কোনো ভবনের মোট জনসংখ্যার ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত এক সময়ে পারমিট করা হতো। দ্বিতীয় শিফটে বাকিরা এসে গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম করত। তবে সংক্রমণ হার যখন কমিয়ে আসে, তখন স্বাভাবিক নিয়মে মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভাগগুলো শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালু করে।

অনলাইনে শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হতো। নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে তা একটি নির্দিষ্ট সার্ভারে জমা দিতে হতো। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মূল্যায়ন করতে শিক্ষকদের সমস্যা হতো না। কোনো ল্যাবরেটরির কেউ সংক্রমিত হলে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই ল্যাব সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিত। ল্যাবের অন্য সদস্যদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হতো।

এই বছরের শুরুতে কভিডের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি স্বাভাবিক নিয়মে গ্রহণ করেছে জাপান। দুই ধাপে হওয়া ভর্তি পরীক্ষায় প্রথমে কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। দেশটির ৫ লাখ ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। এই সংখ্যা দুই ভাগে বিভক্ত করে সারাদেশে ৬৮১টি কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। প্রথম দফায় কেউ অসুস্থ হলে তাদের দ্বিতীয় দফায় ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছিল। ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সাত দিন আগ থেকে প্রতিদিন সকালে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে এবং তাপমাত্রার ডাটা পরীক্ষা কেন্দ্রে আনতে হয়েছে। যদি আবেদনকারীদের শরীরে কভিডের লক্ষণ থাকে তাহলে বিকল্প পরীক্ষার জন্য আবেদন করতে পারবে।

মহামারিকালে মাত্র এক মাস শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও স্বাভাবিক নিয়মে ফেরার লড়াই করেছে জাপান। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটছে ভিন্ন। আমাদের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে করোনা সংক্রমণ বাড়বে। মূলত কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতার খেসারত দিচ্ছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা কি ঘরে বসে আছে? তারা কিন্তু বাইরে যাচ্ছে, ঘুরছে-ফিরছে। উপরন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী মানসিক যন্ত্রণায় আছে। এই সময়ে অনেক শিশুর শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে পড়েছে, অনেক কিশোরী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে, অনেকেই মাদকাসক্ত বা বিপথগামী হচ্ছে।

আমাদের নীতিনির্ধারকরা শক্তিশালী শিক্ষানীতি গ্রহণ করতে পারছে না কেন? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করতে আর কতদিন অপেক্ষা করবেন তারা? আমরা চাই, সরকার খুব শিগগির একটি কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। জাপান সরকার করোনাকালে যে শিক্ষানীতি গ্রহণ করেছে, তার সামান্য অনুসরণ করা গেলেও আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল করতে বেগ পেতে হবে না। দ্রুতই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল করা দরকার। তবে শুধু সচল হলেই হবে না, সেশনজট কমাতে ডাবল শিফটে অন্তত দুই বছর শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। ছুটি কমিয়ে আনতে হবে। আশা করি, নীতিনির্ধারকরা সেদিকেই গুরুত্ব দেবেন।

লেখক: গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান


সর্বশেষ সংবাদ