মনিরুলরা কেন দেশে ফিরতে পারে না

মনিরুলরা কেন দেশে ফিরতে পারে না
মনিরুলরা কেন দেশে ফিরতে পারে না  © টিডিসি ফটো

মনিরুল ইসলাম বাংলাদেশের সন্তান। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সাইন্সে পড়া। তারপর মাস্টার্স করেছেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে। পিএইচডি করেছেন জর্জিয়া ট‍্যাক থেকে। এখন কাজ করছেন গুগলে। এই মনিরুল ইসলাম, পিএইচডি শেষে দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন। যেমনটি চায় দেশের বহু তরুণ-তরুণী। কেন ফিরেননি, জানেন? —সে বিষয়ে খুব অল্প কথায় তিনি বলেছেন, জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে কম্পিউটার সিকিউরিটিতে পিএইচডি করার পর ভেবেছিলাম দেশে ফিরব। তখন দেখলাম আমার বন্ধুরা এরই মধ্যে বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হয়ে গেছে। আমি যদি দেশে ফিরে শিক্ষকতা করি, আমাকে একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। আমার অনেকগুলো গবেষণাপত্র (Scientific article) ছিল। যদি আরও গবেষণার কাজ করতে চাই, দেশে হয়তো সেই সুযোগ পাব না। (প্রথম আলো, ০১ জুলাই ২০১৮)

মনিরুল ইসলামের কথাগুলোকে একটু ব‍্যাখ‍্যা করে বলি। ধৈর্য দিয়ে শুনুন। সারা দুনিয়াতে তরুণদেরকে ইউনিভার্সিটিতে নিয়োগ দেয়া হয় তার গবেষণার যোগ‍্যতা, পাবলিকেশনের গুণগত মান, সুপারভাইজরদের নাম-ডাক, রিসার্চ প্রপোজাল ইত‍্যাদির উপর ভিত্তি করে। ইউনিভার্সিটি ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-গবেষকদের প্রমোশন, বেতন এগুলো নির্ভর করে তার গবেষণা ও কন্ট্রিবিউশনের উপর। এই মনিরুল ইসলাম যদি বাংলাদেশে ফিরে যেতো, তাহলে সে ইউনিভার্সিটিতে জব পেতো লেকচারার বা এসিসট‍্যান্ট প্রফেসর হিসেবে। (যদিও বা পেতো!) মজার বিষয় হলো, তার যে কলিগরা ওখানে এসোসিয়েট প্রফেসর (কিংবা প্রফেসর) হয়ে বসে ছিলো, দেখা যেতো, তাদের কোন গবেষণার অভিজ্ঞতা নেই। অর্থাৎ মনিরুল ইসলাম পিএইচডি, পোস্টডক করে গিয়ে লেকচারার বা এসিসট‍্যান্ট প্রফেসর কিন্তু তার কলিগ এতোকিছু না করেই এসোসিয়েট প্রফেসর! —দুধ আর ঘিয়ের দাম যে রাজ‍্যে সমান হয়ে যায়!

সারা দুনিয়ার ইউনিভার্সিটিগুলো ট‍্যালেন্ট হান্ট করে। দেশে-বিদেশের যে কেউ আবেদন করতে পারে। আমাদের বিশ্ববিদ‍্যালয় বা গবেষণা ইনস্টিউটগুলোতে রিসার্চ ফান্ড সহ ওপেন এপ্লিকেশনের সুযোগ নেই বললেই চলে। তাই এই মনিরুলরা যখন কষ্ট করে বিদেশ থেকে গবেষণা করে ফিরে, তখন বলা হবে: তোমার বয়স নেই, তুমি বিসিএস দিতে পারবে না। তোমার বয়স নেই, তুমি সরকারী চাকুরিতে আবেদন করতে পারবে না। বলা হবে—বিদেশে কিছু করতে পারলে না, দেশে এসেছো! মনিরুলদেরকে ঘুরতে হবে, নেতার পিছু পিছু। ঘুরতে হবে ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকের দয়া-দাক্ষিণ‍্যের জন‍্য। আর মনিরুলদের বহু সাধনার অর্জন, ছয় মাসেই দুধ থেকে ছানায় পরিণত হবে!

অথচ আপনারা, এই আপনারাই বাংলাদেশে বসে বলবেন, মনিরুলরা বাংলাদেশের খেয়ে পড়ে বিদেশ গিয়ে দেশকে ভুলে গেছে। বিদেশের জীবন পেয়ে দেশের কথা আর মনে রাখেনি। কিন্তু এই মনিরুলরাই যখন বাংলাদেশে গিয়ে একটি চাকুরি পাবে না, তার পরিবারকে চালাতে পারবে না, মা-বাবার ভরণ-পোষণ দিতে পারবে না, তখন কিন্তু কেউ খোঁজও নিবে না। —কোনদিনও না। এই মনিরুলরা কী তখন জর্জিয়া ট‍্যাকের সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে বাঁচতে পারবে? আপনারা কী কোনদিন আমাদের সিস্টেমটা পরিবর্তনের জন‍্য বলেছেন? —কোনদিন কী বলেছেন, ইউনিভার্সিটিগুলোর উচিত ট‍্যালেন্ট হান্ট করা। —ইউনিভার্সিটিগুলোর উচিত, রিসার্চ প্রপোজাল, একাডেমিক ব‍্যাকগ্রাউন্ড ইত‍্যাদির উপর যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দেয়া। রিসার্চ ফান্ড সহ ওপেন এপ্লিকেশনের সুযোগ রাখা। দেশের মেধাবীদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার জন‍্য প্রতিযোগিতাম‍ূলক প্রকল্প চালু করা!

মনিরুলরা দেশে ফিরলে, সরকার তার পোষ‍্য শিক্ষক পাবে না। মনিরুলরা প্রিন্সটন থেকে পড়ে গিয়ে নেতার ছবি ঝুলিয়ে পূজা দিতে পারবে না। মনিরুলরা ফিরে গেলে, দেশের ছেলে-মেয়েরা আরো জ্ঞানী হবে, সচেতন হবে। তাহলে সরকারের পোষ‍্যবাহিনী কে হবে? —সরকারের পোষ‍্য বাহিনী না থাকলে, ক্ষমতাকে চীরস্থায়ী করতে পারবে না। সুতরাং মনিরুলদের ফিরিয়ে নিয়ে বিপদ ডাকার কী দরকার! তারচেয়ে ঢের ভালো, অনুগত ছাত্র-শিক্ষক তৈরি করা।

মনিরুল ইসলামরা ফিরতে পারে না কারণ তাদেরও পেট আছে। ক্ষুধা আছে। তাদেরও পরিবার আছে। কষ্ট ও যোগ‍্যতা দিয়ে তারা যেটা অর্জন করেছে, সেটাকে তারা কী করে অবলীলায় ভাসিয়ে দিবে, বলুন! যে দেশটিতে মনিরুলরা জন্ম নেয়, সেই দেশ তাদেরকে কখনোই ডাকে না। অথচ, যে দেশে মনিরুলরা জন্ম নেয় না, সে দেশগুলোই তাদের খোঁজে। এমন বহু মনিরুল, মধ‍্যবিত্ত আর নিম্নমধ‍্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসে। তাদের পরিবারগুলো গ্রামে থাকে। উচ্চশিক্ষিত হয়ে বিদেশে কাজ-কর্ম করে বলে, তাদের পরিবার বেঁচে আছে। দেশে ফেরার জন‍্য সকাল-সন্ধ‍্যা আকুলতা থাকলেও, তারা ফিরতে পারে না। তাদের ফেরার জায়গা থাকে না। তাদেরকে কেউ ডাকে না!

ফেসবুক থেকে সংগৃহীত


সর্বশেষ সংবাদ