ইবতেদায়ী শিক্ষা ও কয়েকটি প্রাসঙ্গিক ভাবনা

ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা  © ফাইল ফটো

আমার বাবা ঝিনাইদহ জেলার অজপাড়াগাঁয়ের একটা মাদ্রাসার শিক্ষক। তিনি যখন শিক্ষকতা শুরু করেন তখন সেখানে ভালো বিল্ডিং ছিলো না, ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা ছিলো না, আধুনিক কোন সুবিধা ছিলো না, বেতন-ভাতা ছিলো না। তবু তিনি দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন। কারণ বেতন না থাকলেও ছিল ছাত্রছাত্রীদের ও সমাজের মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

এ পুঁজিই মূলত তাকে চাকরি চালিয়ে নিতে অনুপ্রাণিত করেছে। অবশেষে এমপিও নামক সোনার হরিণের দেখা পেয়েছেন। তবু সচ্ছলতা আসেনি কোনদিনই (মূলত বর্তমান বাজারে এই বেতনে সচ্ছলতা আসা অসম্ভব)। জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে মাদ্রাসায় চাকরি করছেন। বেতন পেয়ে আসছেন অফিস সহকারী/ক্লার্কের সমান অর্থাৎ ১৬তম গ্রেডে।

ঈদের সময় আবার বোনাস পান দপ্তরি, নাইট গার্ড, নিরাপত্তাকর্মী­, ক্লার্কের অর্ধেক। এমপিও নীতিমালা যেখানে শিক্ষককে এসব কর্মচারীদের চেয়ে নূন্যতম কোন সুবিধা বেশি দিতে পারেনি; ঈদের সময় কেন তারা এসব কর্মচারীদের চেয়ে অর্ধেক বোনাস পাবেন?
আমার কাছে এটি কোন প্রকারেই বোধগম্য নয়। আমাদের মনে রাখা দরকার একজন কর্মচারীর চেয়ে একজন শিক্ষক সমাজিক গ্রহণযোগ্যতা বেশি পান। তাই সামাজিক দায়বদ্ধতাও তার বেশি। বোনাস কম দিয়ে প্রকারান্তরে এসব শিক্ষককে আমরা ছোট করছি কিনা ভেবে দেখা দরকার। এখানে টাকার অঙ্ক গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং শিক্ষক হিসেবে তার মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি স্বরুপ এক টাকা হলেও বেশি দেওয়া উচিৎ ছিল; এটাই তার সম্মান ও স্বীকৃতি। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে এর উল্টো।

এ সমস্যা শুধু আমার বাবার নয় বা শুধু মাদ্রাসার জুনিয়র শিক্ষক পদটিরও নয়। বরং প্রতিটি মাদ্রাসার এবতেদায়ী শাখার সকল শিক্ষকের।

এ পর্যায়ে ইবতেদায়ি মাদ্রাসা/শাখা সম্পর্কে একটু ধারণা নেয়া যাক

ইবতেদায়ি মাদ্রাসা/শাখা হলো মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাথমিক স্তর। এখানে সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয় করা হয়েছে। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার যে কার্যক্রম সরকার পরিচালনা করছে ইবতেদায়ি মাদ্রাসা বা ইবতেদায়ি শাখা তারই অংশ। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি স্কুল সমূহ, ইবতেদায়ি মাদ্রাসা/শাখা ইত্যাদির মাধ্যমে এদেশের শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে থাকে। অথচ ইবতেদায়ি মাদ্রাসা/শাখা রয়ে গেছে অবহেলিত। বেতন ও অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলনায় এবতেদায়ী শিক্ষকরা পিছিয়ে আছেন অনেক গুণ।

ইতোমধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকগণ ১৩তম গ্রেডের বেতন প্রাপ্য হয়েছেন। কিন্তু ইবতেদায়ি শিক্ষকগণের ভাগ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি। এখনো তারা বেতন পান ১৬তম গ্রেডে। সরকারি ও আধাসরকারি চাকুরিজীবী এর সুযোগ সুবিধার তারতম্য থাকবেই; কিন্তু মূল গ্রেড এক হওয়া বাঞ্ছনীয়। মাদ্রাসার ইবতেদায়ি সেকশনের জুনিয়র মৌলভি, জুনিয়র শিক্ষক ও এবতেদায়ী ক্বারি পদ তিনটি প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষক হিসেবে ১৩তম গ্রেডে বেতন পাবার দাবিদার। তাই মাদ্রাসার এমপিও নীতিমালার পরিশিষ্ট ‘‘ঘ’’ এর ক্রমিক নম্বর ৩২, ৩৩ এবং ৩৪ সংশোধন করে উপর্যুক্ত তিন শিক্ষকের বেতন ১৬ তম গ্রেডের পরিবর্তে ১৩তম গ্রেড করার দাবি করছি।

এখানে একটা বিষয় থেকে যায়; সেটা হলো পদগুলোর শিক্ষাগত যোগ্যতা। যেহেতু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগদানের যোগ্যতা ধরা হয়েছে নূন্যতম স্নাতক পাশ। সুতরাং মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে ইবতেদায়ি শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে প্রবেশের যোগ্যতাও স্নাতক বা সমমান করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমার সুপারিশ হলো-
১.জুনিয়র মৌলভির ক্ষেত্রে নূন্যতম ফাযিল/সমমান পাশ।
২.জুনিয়র শিক্ষকের ক্ষেত্রে নূন্যতম স্নাতক পাশ।
৩.ইবতেদায়ি ক্বারির ক্ষেত্রে দাখিল এবং আলিমে মুজাব্বিদ সহ নূন্যতম ফাযিল/সমমান পাশ।

যদি এই নীতিমালাগুলো কার্যকর করা যায় তাহলে এসব এবতেদায়ী শিক্ষকগণের আর্থসামাজিক অবস্থার যেমন উন্নয়ন হবে তেমনি দেশ পাবে মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ্য কর্ণধার।

আমার দৃষ্টিতে ইবতেদায়ি সেকশনের সবচেয়ে বঞ্চিত শিক্ষক হলেন স্বয়ং ইবতেদায়ি প্রধান। ‘বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মাদ্রাসা) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮’ এর পরিশিষ্ট ‘‘ঘ’’ এর ক্রমিক নম্বর ৩১ এ ইবতেদায়ি প্রধানের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ১১তম গ্রেডে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ২০১৮ সালে নীতিমালা জারি করা হলেও আজ অবধি এই সুবিধা ইবতেদায়ি প্রধানগণ পাচ্ছেন না। খুবই অবাক লাগে এখন পর্যন্ত ইবতেদায়ি প্রধানগণ বেতন পান ১৫তম গ্রেডে। কোথায় ১১তম গ্রেড আর কোথায় ১৫তম গ্রেড ভাবা যায়! দ্রুততম সময়ে এসব ইবতেদায়ি প্রধানদের পাওনা ১১তম গ্রেডের বেতন কার্যকর করা প্রয়োজন।

এবার আসি ভিন্ন প্রসঙ্গে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে শিক্ষার উপর বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। যেমন শিক্ষা ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে নায়েম। মধ্যমিক/দাখিল স্তরের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে বি.এড কলেজগুলো। তেমনিভাবে প্রথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে পিটিআই কলেজগুলো।এককথায় প্রায় সকল স্তরের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা আছে।কিন্তু ইবতেদায়ি শিক্ষকদের কোন বিশেষ বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই।

পিটিআই এর আদলে ইবতেদায়ি শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে ইবতেদায়ি শিক্ষকগণ দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় বড় ধরনের অবদান রাখতে পারবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

লেখক: শিক্ষক, গৌরীনাথপুর দাখিল মাদ্রাসা, মহেশপুর, ঝিনাইদহ।
email: minhaziudeo@gmail.com


সর্বশেষ সংবাদ