১০০ বছরের মধ্যে ডুবে যাবে চট্টগ্রাম?

  © সংগৃহীত

চট্টগ্রাম শহরের সাথে আমার নাড়ির সম্পর্ক। কৈশোরের প্রথম ভালোলাগা, প্রথম হারিয়ে যাওয়ার গল্প, প্রথম পা ফসকে পড়ে যাওয়া সব এই শহরে। একটু সময় পেলে এখনো চট্টগ্রামের পথ ধরি। এই শহর আসলেই এক মায়াবী পরী, পাহাড় আর সমুদ্রের মিতালীতে স্রষ্টা এই শহরকে দিয়েছে এক বিশেষ আকর্ষণ। এই আকর্ষণে বারবার ছুটে যাই প্রাণের শহরে।

আমার শৈশব কেটেছে চট্টগ্রাম শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে বাঁশখালীর শেখেরখীলে। সেই ছোটবেলা থেকে চট্টগ্রাম শহর নিয়ে একটা ফ্যান্টাসি কাজ করত! শহরটা কেমন কি জানি! মনে হয় অনেক মানুষ, অনেক বড় বড় রাস্তা, অনেক উচুঁ উচুঁ বিল্ডিং, দেখতে অনেক সুন্দর, বড় লোকদের আবাসস্থল; আরও কত কী! বাবা প্রায়ই চট্টগ্রাম শহরে আসা-যাওয়া আসা করত বিধায় আমারও ইচ্ছা হত কখন আমি কখন বড় হব, তারপর প্রতি সপ্তাহে শহরে আসা-যাওয়া করব। এমন কত রকম ফ্যান্টাসি!

যতদূর মনে পড়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় প্রথম বাবার সাথে চট্টগ্রাম শহরে আসি। তখনকার সময়ে বাঁশখালী থেকে শহরে আসতে সাঙ্গু নদীতে তৈলারদ্বীপ ফেরিঘাট পার হতে হত। এই তৈলারদ্বীপ ফেরীঘাট নিয়েও আমার ফ্যান্টাসি ছিল। শৈশবের বন্ধুদের মধ্যে যারা শহরে গেছিল তারা বলত, পানির উপরে বাস চলাচল করে! তাদের কাছে শুনেছি, ফেরীটা অনেকটাই তলইয়ের (বাঁশ দিয়ে গ্রামাঞ্চলে বানানো) মতো, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যখন যায় তখন খুলে গিয়ে মিশে যায়; কেউবা বলেছিল, এটা ফোলার (ককশীট) মতো পানিতে ভাসে।

শৈশব পার করে কৈশোরে এসে মায়ার শহর-চট্টগ্রামই হয়ে যায় আমার ঠিকানা। কৈশোরের সবচেয়ে সুন্দর মুহুর্তগুলো কেটেছে রাহাত্তার পুল, চট্টগ্রাম কলেজ, চকবাজার, শুলকবহরে। এমন সুন্দর সময় আমার জীবনে আর আসেনি। সেই সময় শহরটাও ছিল সুন্দর- শান্ত, পরিচ্ছন্ন একটি নগরী। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করছিলাম তখন অনেকবারই পড়েছি, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার হেলদি সিটি’র নাম হচ্ছে আমার প্রিয় চট্টগ্রাম।

ফয়সাল আকবর

আমার চেনা সেই শহর বদলে গেছে ভীষণভাবে। শতবর্ষ আগের কথা বলছি না, মাত্র এক দশক কিংবা দেড় দশক আগের চট্টগ্রামের কথা বলছি। এত অল্প সময়ে কীভাবে একটি শহর নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তার উজ্জল দৃষ্টান্ত চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামবাসীর সেই পরিচ্ছন্ন নগরী এখন আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়েছে; মাঝে মাঝে হয়ে যায় বঙ্গোপসাগরের বর্ধিত অংশ!

কেমন আছে চট্টগ্রামবাসী?

চারিদিকে থৈ থৈ পানি। কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর পর্যন্ত, কোথাওবা ডুবে যাবেন যে কোন সময়। এ যেন বঙ্গোপসাগরের স্থল শাখা। কেউ কেউ আবার রসিকতা করে বলেন, এটা একটা বহমান নদী। এই নদীতে নৌকা, রিকশা, সিএনজি, বাস, ট্রাক সব একসাথে চলে। বিডিনিউজ ব্লগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চৌধুরী শহীদ কাদের লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম নদী নয়, একটি নদীবন্দরের নাম। কর্ণফুলি নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই শহরকে বলা হত বন্দর শহর। কালের বিবর্তনে এই বন্দর শহর বর্ষা মৌসুমে একটি নদীতে পরিণত হয়।’ আসলে চৌধুরী শহীদ কাদেরের এই বক্তব্যে চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান দৃশ্যপট ভেসে উঠে।

আপনারা যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখেন তারা দেখেছেন- এই নদীতে চলাফেরা করার জন্য আগ্রাবাদ কর অফিস ইতোমধ্যে একটি নৌকা ক্রয় করেছে। আপনি আরও চোখ রাখতে পারেন খবরের পাতায়, সেখানেও বাস্তবচিত্র ফুটে উঠে। যেমন, ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘চট্টগ্রাম শহরে চলাচলের জন্যে নৌকাই এখন ভরসা’। খুশি হওয়ার মতো সংবাদ নিঃসন্দেহে নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকা না দিয়ে চললে হয় নাকি! একই বছরের ১ জুন প্রথম আলোর প্রতিবেদন ছিল, ‘ভাসছে চট্টগ্রাম শহর’। গত ৯ জুলাই চট্টগ্রামের প্রধান দৈনিক আজাদীর প্রধান সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘শঅর ডুবি গেইয়্যি’ অর্থাৎ শহর ডুবে গেছে। এটা তো বর্ষাকালের চিত্র। অন্যকালে এর চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করে।

যে শহরে যানজট শব্দটাই মানুষের কাছে অপরিচিত ছিল সেই শহরের মানুষ এখন ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে বসে কাটায়! অনেকে বলে সবই ফ্লাইওভার উন্নয়নের আর্শীবাদ। এই আর্শীবাদ পেতে গিয়ে গত কয়েকবছর ধরে নগরীর বাসিন্দাদের ধুলোর সাথে নতুন মিতালি গড়তে হল। দৈনিক আজাদী ২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর প্রধান প্রতিবেদন করেছে, ‘ধুলোময় এক নগরীর নাম চট্টগ্রাম: স্বাস্থ্যঝুঁকিতে নগরবাসী’। বাকীটা বুঝে নেন।

চট্টগ্রাম শহরের রাস্তাঘাটের অবস্থা আরও জঘন্য। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, গর্ত-খানাখন্দ, ফ্লাইওভার উন্নয়নের কারণে রাস্তার উপর পার্টিশন, নির্মাণসামগ্রীর স্তুপ, যানজট, গাড়ি চালকদের যাচ্ছেতাচ্ছে পার্কিং সব মিলে এ যেন যুদ্ধবিদ্ধস্ত অঞ্চল। বহদ্দারহাট থেকে কালুরঘাট সড়ক কয়েক বছর ধরে ওয়াসার কারণে এক পাশ বন্ধ। ওয়াসা এই সড়কে কাজ করছে, কাজ কবে শেষ হবে, তা কেউ জানে না। সিডিএ’র সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ছালাম সাহেব উন্নয়ন দেখাতে ফ্লাইওভার বানাচ্ছে, যে ফ্লাইওভারের ব্যবহার নেই আবার সেই ফ্লাইওভারে নাকি পানিও জমে যায়! এসবের মধ্যেই দিনানিপাত চলছে চট্টগ্রামবাসীর। কালুরঘাট থেকে বহদ্দারহাট, বহদ্দারহাট থেকে জিইসি, জিইসি থেকে লালখান বাজার, বহদ্দারহাট থেকে নতুন ব্রীজ, আগ্রাবাদ থেকে হালিশহর, বক্সিরহাট থেকে কালামিয়া বাজার এই সব সড়কের অবস্থা একেবারেই নাজুক। দৈনিক ভোরের কাগজ ১৩ জুলাই, ২০১৯ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ‘চট্টগ্রাম শহরের এক হাজার ১০০ কিলোমিটারের সড়কের ৪০-৪৫ শতাংশের অবস্থা এখন শোচনীয়।’

ফ্লাইওভার রাজনীতি

চট্টগ্রাম শহরে গত কয়েক বছর ধরে যা চলল তা মূলত অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইওভার রাজনীতি। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সংক্ষেপে যেটি ‘সিডিএ’ নামে পরিচিতি সেই সিডিএ’র চেয়ারম্যানের কাজই ছিল কারণে-অকারণে মেগা প্রকল্প নেওয়া। খবরের কাগজে পড়েছি ওনার বক্তব্য- হাজার কোটি টাকা না হলে নাকি ওনার প্রকল্পই মনে হয় না। মূল সমস্যায় না গিয়ে এই ফ্লাইওভার রাজনীতির কারণে চট্টগ্রাম শহরে রাস্তা দিয়ে এখন নৌকা চলে। এই ফ্লাইওভারগুলোর অবস্থা একটু এক নজরে আপানারা জেনে নিতে পারেন।

সর্বপ্রথম ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল ১.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার। এই ফ্লাইওভারে দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ শাহ আমানত সেতুর দিকে নামতে যেকোন সময় ঘটে যেতে পারে বড় দুর্ঘটনা। ঠিক নামার পথেই দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের যানবাহনগুলোকে ডান পাশে ঘুরে পূর্ব পাশে যেতে হয়। স্থানীয়রদের মতে, ‘ফ্লাইওভার তৈরির পর থেকে বহদ্দারহাট এলাকায় যানজট আরো বেড়ে গেছে। ফ্লাইওভার দিয়ে কোনো যানবাহন চলাচল করে না।’ এই ফ্লাইওভার নির্মাণকালীন সময়ের সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো অনেক পরিবারে দগদগে ঘা। ২০১২ সালের ২৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় এই ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে নিহত হয়েছিল অন্ততঃ ২৩ জন। আর পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অনেকেই।

এরপরে নির্মাণ করা হয় ২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে দেওয়ানহাট ফ্লাইওভার এবং ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কদমতলী ফ্লাইওভার। ওই এলাকায় আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল ও চট্টগ্রাম রেলস্টেশন অবস্থিত। যানবাহনের চাপে প্রায়ই রাস্তায় দীর্ঘ যানজট থাকলেও উপরের ফ্লাইওভার তখন খুব একটা গাড়ি দেখা যায় না।

এরপরে মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত ৪৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫.২ কিলোমিটার দীর্ঘ আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। কিছুটা কাজে আসছে একমাত্র এই ফ্লাইওভার। তাও নাকি বর্ষাকালে এই ফ্লাইওভার পানি জমে যায়। বলা যায়, বিপুল অর্থব্যয়ে নির্মিত ফ্লাইওভারগুলো শুধু নগরীর শোভাবর্ধনই করছে, যানজট নিরসনে কিংবা নগরবাসীর তেমন কাজে আসছে না।

ধ্বসে পড়েছে রিং রোডের ওয়াকওয়ে

২০১২ সালে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডার ধ্বসে পড়ার মতো গত ১৩ জুলাই, ২০১৯ ধ্বসে পড়েছে চট্টগ্রাম শহর রক্ষায় নির্মায়মাণ উপকূলীয় বাঁধ কাম আউটার রিং রোড’র ওয়াকওয়ে। তবে এবার জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি- এটুকুই স্বস্তি। ধ্বসে পড়া ওয়াকওয়ের ভাঙ্গা অংশে বের করে দিয়েছে-উন্নয়নের নামে যা চলছে তার প্রতিচ্ছবি। কোন লোহা-রড ছাড়াই ঢালাই দেওয়া হয়েছে। তাও আবার এই সড়কটি নাকি শহর রক্ষা করবে! জানা যায়, সিডিএ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

কেন পানির নিচে চট্টগ্রাম?

দিনে দিনে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা। বর্ষকালে প্রায়শই পানির নিচে থাকা আমার প্রিয় শহর। সংবাদ মাধ্যম বলছে, ঘণ্টাপ্রতি ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতেই এই শহরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ তলিয়ে যায়! নগর পরিকল্পনাবিদসহ সাধারণ মানুষ এমনকি খোদ সিটি কর্পোরেশন মেয়র নিজেই বলছেন, সমন্বয়হীন উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের ফল এই জলাবদ্ধতা। বন্দরনগরীর বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম ও পরিকল্পনা গ্রহণে সমন্বয়ের অভাবেই চট্টগ্রাম বঙ্গোপসাগরের বর্ধিতাংশে পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই।

সমন্বয় না থাকায় তারা জলমগ্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে নিজেরা কতটা নির্দোষ সেটা প্রমাণে বেশি ব্যস্ত থাকে। বর্তমান সিটি মেয়র আ. জ. ম. নাসির ২০১৭ সালে সরকারকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছিলেন, চট্টগ্রামের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যাতে সিডিএকে না দেয়। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, এসব সংস্থা কর্পোরেশনের সাথে কোন কাজেই সমন্বয় করছে না। এই সমন্বয়হীনতার প্রমাণ আমরা দেখি, ৫৩ কোটি টাকা ব্যয় করে আগ্রাবাদে পানি উন্নয়ন বোর্ড যে স্লুইস গেইট নির্মাণ করল, বছর পর মেয়র সাহেব সেই স্লইস গেইট ভাঙ্গলেন। এই ভাঙ্গা-গড়ার খেলা কিন্তু সবই জনগণের টাকায়।

জলাবদ্ধতার আরেকটি কারণ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রানাধীন ১৭টি খালের শোচনীয় অবস্থা। নগরীর মানচিত্রে এসব খাল থাকলেও বাস্তবে অনেক খালের কোনো চিহ্ন নেই, আবার কোনটি পরিণত হয়েছে নালায়! ফলে ভারী বৃষ্টিপাত হলে প্রবেশ করা জোয়ারের পানি ও বৃষ্টিপাত একাকার হয়ে পানিতে তলিয়ে যায় পুরো শহর।

মূলত অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থার পাশাপাশি জোয়ারের পানি ঠেকানোর মতো কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে বন্দরনগরী খ্যাত আমার মায়ার শহর চট্টগ্রাম। সংবাদ মাধ্যমের ভাষ্য মতে, চাকতাই খালের উপরের অংশের প্রশস্ততা ৩৫ ফুট হলেও নিচের অংশের প্রশস্ততা মাত্র ১৫ ফুট। গত ১৩ জুলাই দেখা গেছে এক ব্যতিক্রম ভিন্ন চিত্র। পুরো চট্টগ্রাম শহর পানিবন্দী, বাসা-বাড়ী-অফিস সবখানে পানি আর পানি, কিন্তু চাকতাই খালে পানি নেই! এথেকে প্রতীয়মান হয়, আসলে জলাবদ্ধতার অর্ন্তনিহিত কারণ। অপরিকল্পিত নগরায়নকেও জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে দেখছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশেষ কোনো গবেষণা ছাড়াই সিডিএ, পাউবো এবং চসিক পানিতে টাকা ঢালছে।

জলাবদ্ধতার দায়ভার কার?

চট্টগ্রাম কেন পানির নিচে থাকে? এটা নিয়ে যতদূর বির্তক ও আলোচনা চলে তার চেয়ে বেশি বিতর্ক চলে কে দায়ী তা নিয়ে। সাধারণ মানুষের যত ক্ষোভ তা সিটি মেয়র আ. জ. ম. নাসিরের ওপর। আবার সিটি মেয়র সব দোষ ‘সিডিএ’ এবং সিডিএ’র সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের ওপর চাপিয়ে যেন সব দায়মুক্ত ভাব। নিঃসন্দেহে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সিটি মেয়রকে এই দায়ভার বহন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী সিডিএ।

শুধু অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইওভার নির্মাণ বা আবাসিক এলাকা তৈরিতেই ব্যস্ত ছিল সিডিএ। আর সিডিএর সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম ব্যস্ত ছিলেন জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার প্রকল্পের কথা বলে পুরো নগরে বিলবোর্ড ও পোস্টার ছড়িয়ে দিয়ে নিজের ঢাক-ঢোল পিঠাতে। সিডিএ’র এই সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান নাকি কোন এক অনুষ্ঠানে বলছিলেন, ‘জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান না করে যেন আল্লাহ আমার মৃত্যু না করেন।’ ওনি পদে না থাকলেও আমরা দোয়া করি, তিনি যেন মৃত্যুর আগে কথা রেখে যেতে পারেন।

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার ২০১৭ সালে তিনটি প্রকল্পে ৯ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এর মধ্যে সিডিএ বাস্তবায়ন করছে সাত হাজার ৬১৬ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প। আর পানি উন্নয়ন বোর্ড এক হাজার ৬২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রকল্পের কাজ তিন বছর ধরে চললেও জলাবদ্ধতার চিত্র একটুও কমেনি বরঞ্চ বেড়েছে। প্রকল্পগুলোতে নালা-নর্দমা ও খালের পুনঃখনন, বাঁধ নির্মাণ, জোয়ার প্রতিরোধক ফটক, খালের দুই পাশে প্রতিরোধ দেয়াল, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের জন্য বরাদ্দ রাখা হলেও নতুন ও শাখা খাল খননে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। অথচ এই জলাবদ্ধতা নিরসনে একসময় নতুন খাল খননের সুপারিশ করেছিল সিডিএ, সেই সিডিএ এখানে কোনো বরাদ্দ রাখেনি। ফলে চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলেও নগরবাসী সুফল পাবে কিনা, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের কাছে সংশয় কাজ করছে।

পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ সিকান্দার খান সংবাদ মাধ্যমকে সম্প্রতি বলেছেন, ‘চট্টগ্রামে যেভাবে উন্নয়নের নামে টাকা ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অপরিকল্পিত হওয়ায় তা জলে যাবে। এবং সিডিএ যে ফ্লাইওভারগুলো নির্মাণ করছে, তা জনগণের কল্যাণের জন্য নয়। বাহবা কুড়ানো ও প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য বড় বড় এসব প্রকল্প নেয়া হচ্ছে।’

১০০ বছরের মধ্যে ডুবে যাবে চট্টগ্রাম?

ইতোমধ্যেই আমার প্রাণের শহর চট্টগ্রাম নগরী পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে। এই শহরে বর্ষাকালে স্থবির হয়ে যায় স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত-ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান সবকিছুই। সেই শহর নিয়ে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’। নাসার সেই গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, ‘একশ’ বছরের মধ্যে ডুবে যাবে চট্টগ্রামসহ বিশ্বের ২৯৩ শহর: নাসার বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা’।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, হিমবাহ ও দুই মেরুর বরফ দ্রুত গলছে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকায় আগামী ১০০ বছরের মধ্যে ছোটবড় সব মিলিয়ে বিশ্বের ২৯৩টি শহর পুরোপুরি পানির নিচে ডুবে যাবে। তালিকায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামের নামও রয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়েছে, চট্টগ্রামের হারিয়ে যাওয়া অনিবার্য, এমন দাবি করে নাসার বিজ্ঞানী সুরেন্দ্র অধিকারী বলছেন, রেহাই পাবে না বাংলাদেশের বন্দর শহর চট্টগ্রাম। বিশ্বের বাকি ২৯২টি শহরের সঙ্গে চট্টগ্রামও হারিয়ে যাবে জলের অতলে, ১০০ বছর পর। সমুদ্রের পানির স্তর যেভাবে বাড়ছে, তাতে চট্টগ্রামকে বাঁচানো আর সম্ভব হবে না।

প্রতিবেদনে তিনি আরও বলেছেন, প্রতি ১০ বছর অন্তর এক দশমিক চার সেন্টিমিটার পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম শহর। এই হারে পানি বাড়তে বাড়তে আগামী ১০০ বছরের মধ্যেই চট্টগ্রাম শহর থাকবে ১৪ দশমিক ০১ সেন্টিমিটার পানির নিচে। অর্থাৎ তখন আর এই শহরে শুকনো মাটির অস্তিত্বই থাকবে না।

আপনারা যারা এই শহরের কর্তাব্যক্তি আছেন, চট্টগ্রাম উল্টায় ফেলতেছেন বলে বিলবোর্ড-পোস্টারে পুরো শহর ছেয়ে ফেলছেন তারা কি এই আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন?

মুক্তির উপায় কি?

বছর যায়, দশক যায় কিন্তু জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি মেলে না চট্টগ্রামবাসীর। জলাবদ্ধতা থেকে কি আদৌ মুক্তি আছে চট্টগ্রামবাসীর? ডুবতে যাওয়া চট্টগ্রামকে রক্ষার সুযোগ আছে কি আমাদের হাতে? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া আসলেই কঠিন। তবে চেষ্টা তো করা যেতে পারে। সমুদ্রপৃষ্টের পানিসীমার নিচের ভূমি হয়েও এখনো টিকে আছে দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। সেখানে আমাদের সম্ভাবনা তো আছেই নিঃসন্দেহে। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান যা কিছু বলে এই শহরকে বাঁচানোর তাগিদে-

এক. আমাদের সবার আগে দরকার চট্টগ্রামের উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনার দায়িত্বে থাক ২৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়। এই সমন্বয় সাধন সম্ভব না হলে যত বড় প্রকল্পই নেওয়া হোক না কেন তা ব্যর্থতাই পর্যবসিত হবে।

দুই. এখন সময় এসেছে ১৯৯৫ সালের ইউএনডিপির অর্থায়নে প্রণীত ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানটি লালফিতা বন্দী থেকে বের করে নিয়ে এসে বাস্তবায়ন করার। এই প্ল্যানটির বাস্তবায়নই হয়তো চট্টগ্রামকে টিকে রাখার একটা দিক খুলে দিবে।

তিন. স্বাধীনতার আগে চট্টগ্রাম শহরে যে ৭০টি খাল ছিল তা পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতেই হবে। এসব খালে যেসব অবৈধ স্থাপনা আছে তা উচ্ছেদ করতেই হবে। এছাড়া বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে নতুন খাল ও শাখা খাল খনন করা এবং জলাধার স্থাপনের বিকল্প নেই।

চার. চট্টগ্রাম শহরকে রক্ষা করতে একাধিক শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি নগরের নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাওয়া ঠেকাতে খালগুলোর মুখে স্লুইসগেট নির্মাণ করতে হবে।

পাঁচ. চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার সংকট নিরসনের প্রশ্নটি কর্ণফুলী নদীর নাব্যতার সাথেও জড়িত। তাই কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা ঠিক রাখতে খনন ও পুনঃখনন অব্যাহত রাখতে হবে।

ছয়. চট্টগ্রাম শহরের বড় অংশের মালিক চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং সশস্ত্র বাহিনীকে সামগ্রিক পরিকল্পনায় ও প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে।

সর্বশেষ একটি গণ আওয়াজ তুলতে হবে। এতোদিন ধরে যে আওয়াজটি ছিল ‘চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানেই বাংলাদেশের উন্নয়ন’। আমার মনে হয় এই আওয়াজের আবেদন শেষ হয়ে গেছে। এখন সময় এসেছে নতুন একটি আওয়াজ তোলার, একটি কম্পমান প্রতিধ্বনি তোলার- ‘চট্টগ্রাম বাঁচলেই, বাঁচবে বাংলাদেশ’। অন্যথায় হারিয়ে যাবে চট্টগ্রাম, হারিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

লেখক: ৩৫তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত এবং
লেকচারার, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ,
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।


সর্বশেষ সংবাদ