অ্যাপারেল মার্চেন্ডাইজিং: ব্যবসায় শিক্ষায় এক অনিবার্য সংযোজন
একটি সময় ছিল যখন মার্চেন্ডাইজিং শব্দটি কেবল গার্মেন্টস কারখানার ভেতরের এক নির্দিষ্ট কাজের পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল। সময়ের গতিতে, বৈশ্বিক বাণিজ্যের বিকাশে এবং পোশাকশিল্পের বিবর্তনে আজ সেই মার্চেন্ডাইজিং একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা জ্ঞানে পরিণত হয়েছে—যা ব্যবসায় শিক্ষা বা বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ে জায়গা করে নেওয়ার মতো প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করেছে। অথচ বিস্ময়করভাবে, দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও বিবিএ বা এমবিএ প্রোগ্রামে অ্যাপারেল মার্চেন্ডাইজিং একটি স্বতন্ত্র মেজর হিসেবে অন্তর্ভুক্ত নয়। এটি কেবল সময়ের ঘাটতি নয়, বরং দেশের অন্যতম রপ্তানিনির্ভর খাতের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠনে এক বড় শূন্যতা।
অ্যাপারেল মার্চেন্ডাইজিং আসলে ব্যবস্থাপনার বহুমাত্রিক প্রয়োগের এক আদর্শ ক্ষেত্র। এখানে মার্কেটিং, অপারেশনস ম্যানেজমেন্ট, সাপ্লাই চেইন, ফাইন্যান্স, কাস্টমার রিলেশন, কমিউনিকেশন এবং নেগোশিয়েশন—প্রতিটি শাখার একযোগে উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। একজন মার্চেন্ডাইজারকে যেমন পণ্যের ডিজাইন থেকে শুরু করে সোর্সিং, কস্টিং, উৎপাদন তদারকি, গুণগত মান যাচাই, সময়মতো ডেলিভারি নিশ্চিত করা—এসব বিষয়ে দক্ষ হতে হয়, তেমনি তাকে আন্তর্জাতিক বায়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ, দর কষাকষি ও চুক্তি বাস্তবায়নের মতো বিষয়েও পারদর্শী হতে হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মার্কেট অ্যানালাইসিস, ট্রেন্ড প্রেডিকশন এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মতো জটিল বিষয়ের ব্যবহারিক প্রয়োগ। ব্যবসায় শিক্ষার আলোকে বিচার করলে, মার্চেন্ডাইজিং আসলে ম্যানেজমেন্ট শিক্ষার ‘লাইভ কেস স্টাডি’—যেখানে বাস্তব সিদ্ধান্ত, সময়ের চাপ, এবং আন্তর্জাতিক মাপকাঠি একসঙ্গে কাজ করে।
বর্তমানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিবিএ ও এমবিএ প্রোগ্রামে যেসব মেজর চালু আছে, যেমন ফাইন্যান্স, মার্কেটিং, ম্যানেজমেন্ট, এইচআরএম, বা অপারেশনস—সবই গ্লোবাল ক্যারিয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত হলেও, সেগুলোর প্রত্যক্ষ বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রে সীমিত। অন্যদিকে, মার্চেন্ডাইজিং হলো এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে এসব বিষয় একযোগে কাজ করে এবং শিক্ষার্থীরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাস্তব শিল্পক্ষেত্রে নিজেদের প্রয়োগ ঘটাতে পারে। এ ধরনের বাস্তবমুখী, চাকরি-সংযুক্ত এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গঠিত একটি মেজর বিজনেস স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য হবে সময়োপযোগী, প্রাসঙ্গিক এবং জীবনঘনিষ্ঠ।
আরও পড়ুন: ৫ শিক্ষা বোর্ডের সামনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, ফটকে তালা
এমন নয় যে মার্চেন্ডাইজিং শুধু গার্মেন্টস খাতেই সীমাবদ্ধ। এটি আজকের দুনিয়ায় একটি সম্পূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম, যা ফ্যাশন রিটেইল, ই-কমার্স, ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, এবং গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে, যারা মার্চেন্ডাইজিং-এ মেজর নেবে, তারা কেবল একটি খাতের জন্য প্রস্তুত হবে না; বরং তারা বহুবিধ শিল্পে কাজ করার দক্ষতা নিয়ে গড়ে উঠবে। এর ফলে তৈরি হবে একটি নতুন ধরনের ম্যানেজার প্রজন্ম, যারা শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞানেই নয়, বাস্তব বিশ্বেও নেতৃত্ব দিতে পারবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মার্চেন্ডাইজিং-এর এই বিশাল কর্মক্ষেত্র ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এই বিষয়টি এখনও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি। আজ যখন শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে এক ধরনের দিকভ্রান্তি নিয়ে—তখন প্রয়োজন এমন একটি মেজর, যা স্পষ্ট ক্যারিয়ার পথ তৈরি করতে পারে। অ্যাপারেল মার্চেন্ডাইজিং হতে পারে সেই পথ। কারণ এই খাতে এখনও দক্ষ পেশাজীবীর ঘাটতি রয়েছে, এবং ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে। আজ যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিবিএ ও এমবিএ পর্যায়ে ‘Apparel Merchandising’ নামে একটি পৃথক মেজর চালু করে, তাহলে তা হবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
এই মেজর চালু করতে হলে প্রয়োজন একটি ইন্ডাস্ট্রি-লেড অ্যাকাডেমিক কাঠামো, যেখানে ব্যবসায় শিক্ষার মৌলিক বিষয়গুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকবে মার্চেন্ডাইজিং-এর কোর সাবজেক্ট যেমন—বায়ার ম্যানেজমেন্ট, গার্মেন্টস প্রোডাকশন সিস্টেম, গ্লোবাল সোর্সিং স্ট্র্যাটেজি, প্রোডাকশন প্ল্যানিং, টেকনিক্যাল শিট ও প্যাকিং ইনস্ট্রাকশন বিশ্লেষণ, এবং সাপ্লাই চেইন কন্ট্রোল। সাথে থাকবে সফট স্কিল প্রশিক্ষণ, ভাষা দক্ষতা এবং ইন্ডাস্ট্রি ইন্টার্নশিপ। এতে শিক্ষার্থীরা হবে বাস্তবমুখী, আত্মবিশ্বাসী এবং প্রতিযোগিতামূলক।
আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৩, আক্রান্তও বেড়েছে
বাংলাদেশের অর্থনীতি যেহেতু এখনও পোশাক শিল্পনির্ভর, সেই অর্থনীতির ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের দরকার এমন নেতৃত্ব, যারা ব্যবসায় শিক্ষা নিয়েও শিল্পের প্রয়োজনে নিজেকে উপযোগী করে তুলতে পারবে। অ্যাপারেল মার্চেন্ডাইজিং-কে বিজনেস এডুকেশনের মূলধারায় আনা সেই নেতৃত্ব তৈরির ভিত্তি হতে পারে। সময় এসেছে আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসার পাঠ্যক্রমে এই জরুরি সংযোজন ঘটাক, না হলে আমরা ভবিষ্যতের নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ হাতছাড়া করে ফেলব।
উচ্চশিক্ষার পাঠ্যক্রমে এই সংযোজন কেবল একটি নতুন সাবজেক্ট সংযোজন নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য দক্ষ জনশক্তি গঠনের ঘোষণা। এমন একটি পেশা যেখানে একজন শিক্ষার্থী শিখবে কীভাবে একজন বিদেশি বায়ারের ভাষা বুঝে, তাকে মূল্য বোঝাতে হয়; কীভাবে একটি ডিজাইন কস্টিং করে একটি ব্র্যান্ডের অনুকূল করে তুলতে হয়; কীভাবে একটি কাস্টমস ডকুমেন্ট দেরি হলে পুরো চেইন ব্যাহত হয়, এবং কীভাবে এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেও পণ্যের মান, সময় ও মুনাফা ধরে রাখা যায়। ব্যবসা শিক্ষা যদি বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুতির আরেক নাম হয়, তাহলে মার্চেন্ডাইজিং হলো তার বাস্তবতম অনুশীলনক্ষেত্র।
আমাদের তরুণরা আজ শুধু চাকরি খুঁজছে না, তারা এমন শিক্ষা খুঁজছে, যা দিয়ে বিশ্বে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারবে। অ্যাপারেল মার্চেন্ডাইজিং সে সম্ভাবনার অন্যতম পথ। এখন প্রয়োজন এই বিষয়টিকে শিক্ষা নীতির মূলধারায় নিয়ে আসা, এবং বিজনেস স্কুলগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করা। তাহলেই তৈরি হবে সেই নেতৃত্ব, যারা শুধু কারখানায় নয়, বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে।
লেখক: অধ্যাপক
প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি