সংস্কার নিয়ে বিএনপির কিছু ঐতিহাসিক প্রশ্ন ও উত্তর

ড. মাহদী আমিন
ড. মাহদী আমিন  © টিডিসি সম্পাদিত

প্রথম প্রশ্ন: বাংলাদেশে সর্বপ্রথম দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থার প্রস্তাবনা কোন রাজনৈতিক দল দিয়েছিল? 

উত্তর: বিএনপির ২০১৬ সালে প্রণীত ভিশন ২০৩০-এর ছয় নম্বর দফায় প্রথমবারের মতো সংসদে উচ্চকক্ষের কথা বলা হয়, যা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ২০২২ সালে ঘোষিত ২৭ দফা ও ২০২৩ সালে ঘোষিত ৩১ দফাতেও বিশেষ গুরুত্ব পায়। 

দ্বিতীয় প্রশ্ন: প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়সীমা নির্ধারণের প্রস্তাবও কি বিএনপি সর্বপ্রথম দিয়েছিল?

উত্তর: হ্যাঁ। ৩১ দফার পঞ্চম দফায় সুস্পষ্ট রয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি পরপর দুই টার্মের বেশি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন না। ফ্যাসিবাদের এমন একটি সময়ে জনগণের ভোটের অবশ্যম্ভাবী প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান এই প্রস্তাব দেন, যখন শেখ হাসিনা নিজের অবৈধ প্রধানমন্ত্রীত্ব কুক্ষিগত রাখতে নজিরবিহীন গুম-খুন, হামলা-মামলা, দমন-নিপীড়ন চালাতে থাকে। টাইম মেশিন দিয়ে সেই রক্তস্নাত সময়টাতে ফিরে যেতে পারলে বোঝা যাবে এই উদার প্রস্তাবনার মহাত্ম!

তৃতীয় প্রশ্ন: প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসের বিষয়ে ২০১৬ সালের ভিশন ২০৩০ থেকে শুরু করে ৩১ দফায় বিএনপি কি বলেছিল?

উত্তর: বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোয় রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা এককভাবে প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত হওয়ায়, বিএনপি এই পদ্ধতির পরিপন্থী এবং ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা প্রস্তাব করে আসছে গত এক দশক ধরে। শেখ হাসিনার সময়ে একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের আবরণে একটি স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দেওয়ার কারণে, নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে চেক্স এন্ড ব্যালেন্সেস আনার জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর নিয়োগে অল-পার্টি পার্লামেন্টারী কমিটির ভেটিং, এবং বিষয়ভিত্তিক সংস্কার কমিশনগুলো গঠন — এই প্রতিটি পলিসির ভিত্তি বিএনপির ৩১ দফা। 

বর্তমান বাস্তবতায় প্রশ্ন:

১. অধিকাংশ মৌলিক সংস্কারের প্রধান প্রস্তাবক যদি বিএনপি হয়, তবে কেন একটি ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে যে, বিএনপি সংস্কার চায় না?

উত্তর: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়, যেকোনো অর্থবহ পরিবর্তন তথা সংস্কার প্রকল্পের চিরন্তন ও টেকসই সমাধান হলো জাতীয় নির্বাচন। সুতরাং, একটি নেভার-এন্ডিং প্রসেস হওয়া সত্ত্বেও, যখন সংস্কার এবং নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে, জাতীয় নির্বাচনকে পিছিয়ে জনগণের ভোটাধিকার হরণকে দীর্ঘায়িত করার ন্যারেটিভ তৈরি হচ্ছে, তখন প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয় যে, এই তৎপরতার পেছনে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকতে পারে। 

আজ থেকে ২ বছর আগে, যখন কেউ ভাবতেও পারেনি কি-কি সংস্কার প্রয়োজন, সেই সময় রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের জন্য ৩১ দফার সুবিস্তৃত সংস্কার পরিকল্পনা দিয়েছিলো বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলো। সেই সংস্কারের আবার ভিত্তি ছিল ২০১৬ সালের ভিশন ২০৩০। আজ যদি কেউ বিএনপির দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবনার আলোকে, ইম্প্লিমেন্টশনে কিছু মেথডোলজিক্যাল ডিফারেন্সের কারণে বলেন যে বিএনপিই সংস্কার চায় না — সেটি কি অজ্ঞতা, অপপ্রচার না অপরাজনীতি — তা জানতে একটি রিসার্চ করা যেতে পারে!

২. দ্বিকক্ষের উচ্চকক্ষে বিএনপি কেন নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের অনুপাতকে প্রস্তাব করেছে?

উত্তর: দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের মূল লক্ষ্য সফল পেশাজীবী ব্যক্তিদের রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পৃক্ত করা, যেমন বিশিষ্ট ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, ইত্যাদি। নিম্নকক্ষের পরাজিত প্রার্থীদের রাষ্ট্রীয় পদায়ন কোনোভাবেই এর লক্ষ্য নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্যে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব একটি অজানা বিষয়, সুতরাং উচ্চকক্ষ প্রচলনের সময় এই ধরণের পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়ায় না গিয়ে, জনগণের কাছে বোধগম্য আসনভিত্তিক সিস্টেমকেই প্রায়োরিটি দেওয়া উচিত। সময়ের প্রবাহে, উচ্চকক্ষ সিস্টেম মোটামুটি ম্যাচিউর হলে ও জনগণের আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরী হলে, জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে সেখানকার নমিনেশন প্রসেস রিভিউ করা যেতে পারে, এবং কাট-অফ বা থ্রেশহোল্ড-এর বিষয়ও আসতে পারে। 

৩. আওয়ামী লীগের বিচারের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান কি?

উত্তর: ফ্যাসিবাদের ১৬ বছরে এবং গণঅভ্যূত্থানে সবচেয়ে বেশি শহীদ-পঙ্গু-আহতের সংগঠন হিসেবে, সবচেয়ে বেশি গুম-খুন, হামলা-মামলার শিকার রাজনৈতিক দল হিসেবে, জনগণের আকাঙ্খার ধারক হিসেবে, বিএনপি বারবার বলে এসেছে যে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের এবং ব্যক্তিগতভাবে তার নেতৃত্বের অবশ্যই মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার হতে হবে। গত ৭ মাসে কেন দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি, কেন বিচারিক আদালতের গতি থমকে আছে, সেটিই একটি রহস্য। সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ এই বিচারিক প্রক্রিয়া যেন মানদণ্ড মেনে ও টেকসইভাবে করা হয়, যেন দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকার না হয়, যেন দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর করা যায়, সেটিও বিবেচনা করা প্রয়োজন। 

৪. সংস্কারের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান আসলে কি?

উত্তর: সংস্কারের প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপির অবস্থান থেকে বোঝা যায় যে, দলটি কেবল কথার কথা বলে কাউকে অযথা খুশি করার পপুলার পলিটিক্স করতে চাইছে না। যতটুকু বাস্তবসম্মতভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব, ততটুকুই বলছে। কারণ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে, বিএনপির বিজয় যেমন অনিবার্য, তেমনি সংস্কার নিয়ে সেই সরকারের দায়বদ্ধতাও অটুট থাকবে, ইনশাআল্লাহ। এই প্র্যাগমাটিক এন্ড সাস্টেইনেবল এপ্রোচ কারো পছন্দ হতে পারে, আবার কারো অপছন্দও হতে পারে; এটিই তো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে, সামগ্রিকভাবে জনগণ কোনটিকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে, তা জানার একমাত্র উপায় হচ্ছে তাঁদেরকে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।

নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর তাত্ত্বিক ও ক্ষেত্রবিশেষে জনবিচ্ছিন্ন চিন্তাধারার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো জনগণের সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি করা, তাঁদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা এবং আকাঙ্খা পূরণ করা। তাই সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে সিরিজ অফ কনসালটেশন, ডায়ালগ ও ফিডবেক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ৩১ দফা হয়ে উঠেছে সংস্কারের রাষ্ট্রীয় পথযাত্রায় আমাদের জনসম্পৃক্ততা ও জনমত গঠনের মৌলিক ভিত্তি।

৫. সংস্কার আর নির্বাচনের সম্পর্ক তাহলে কি?

উত্তর: গণতন্ত্র হলো একটি প্রক্রিয়া যেখানে সকল ব্যক্তি তাঁর মতামত প্রকাশ করতে পারেন এবং রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনভাবে সংস্কার, জনকল্যাণ ও উন্নয়ন সহ প্রতিটি বিষয়ে নিজ-নিজ অবস্থান জানাতে পারে। নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে, কোনটি গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত এবং কিভাবে সরকার ও দেশ পরিচালিত হবে।

অতএব, ভিন্ন মত ও পথের বৈচিত্র্যকে সাদরে গ্রহণ করে, সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের উচিত তাঁদের নিজস্ব ভিশন এবং সংস্কার প্রস্তাবনা দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরা। যদি জনগণ তাঁদের চিন্তাধারাকে সমর্থন জানিয়ে ভোট দেয়, তবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে সেই সংস্কার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা হবে, পাবলিক ম্যান্ডেট ও নির্বাচনী জবাবদিহিতা নিয়ে কমিটমেন্ট ফুলফিল করা হবে — এটিই গণতন্ত্রের নিয়ম-রীতি।

সুতরাং আসুন, নির্বাচন ঠেকানোর জন্য সংস্কারকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঢাল না বানিয়ে, টেকসই সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচনকে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে বিবেচনা করি। (লেখকের ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত)

লেখক:  রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও তারেক রহমানের উপদেষ্টা


সর্বশেষ সংবাদ