খাদের কিনারায় দেশের রাজনীতি, বিএনপিকে ঠেকাতে চক্রান্ত

সাইদুর রহমান
সাইদুর রহমান  © টিডিসি ফটো

খাদের কিনারায় পড়েছে রাজনীতি। গভীর সংকটে বাংলাদেশ। একের পর এক চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে। ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের পতনের পর এখন টার্গেট বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানকে নিয়ে শুরু হয়েছে ষড়যন্ত্র। তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবাসন আটকাতে দেশি-বিদেশি মহাচক্রান্ত চলমান রয়েছে। এই চক্রান্তে সরকারের কিছু উপদেষ্টা, পাঁচজন পতিত বুদ্ধিজীবী, গোয়েন্দা সংস্থা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল সম্পৃক্ত হয়েছে।

বিএনপিকে টেম্পু স্ট্যান্ড চাঁদাবাজি অ্যাখ্যায়িত করে স্যোসাল মিডিয়ায় অপপ্রচার শুরু হয়েছে। দলটির কিছু বিপথগামী নেতাকর্মীর নেতিবাচক কর্মকাণ্ড পরিকল্পিতভাবে প্রচারণায় আনা হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীও বুঝে বা না বুঝে চক্রান্তকারীদের ফাঁদে পা দিয়েছে। গুপ্তচরবৃত্তিতে আগ্রাসী ছাত্রশিবির ছাত্রলীগকে গিলে খেতে পারলেও কোনোভাবেই তারেক রহমানকে নিজেদের ডেরায় আনতে ব্যর্থ হয়ে তার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারা দেশে যেসব কমিটি করছে তার বেশির ভাগ ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী।

ভোটের রাজনীতি জামায়াত-শিবির গুরুত্বহীন হলেও মেধার রাজনীতিতে অনেকটা এগিয়ে। সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। চক্রান্তকারীদের একমাত্র ভরসা জামায়াত-শিবির। বিরাজনীতিকরণের যে ফাঁদ ২০০৭ সালে পাতা হয়েছিল, সেই পথে এগোচ্ছে বিশেষ গোষ্ঠী। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে ওই গোষ্ঠীর আপত্তি না থাকলেও তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে ঘোর বিরোধিতা শুরু করেছে তারা। বিএনপির ভেতরে অ্যান্টি তারেক রহমান গ্রুপকে চাঙাও করে ফেলেছে তারা।

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত। তারেক রহমানই এই মুহূর্তে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শূন্যতার পর তারেক রহমানকে আটকানো গেলে সহজেই চক্রটি তাদের স্বার্থ হাসিল করতে পারবে। কারণ তারেক রহমান জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারক-বাহক। জামায়াত ইসলামীর রাজনীতি নিয়ে তারেক রহমানের এলার্জির সুযোগ নিচ্ছে চক্রটি। খালেদা জিয়াকে সহজেই সংশ্লিষ্টদের ডেরায় আনা সম্ভব হলেও তারেক রহমানের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে তারা। তারেক রহমানকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে বিকল্প পথে হাঁটা শুরু করেছে ষড়যন্ত্রকারী।

এই চক্রান্তে ব্যবহার করা হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশনকে। এই কমিশনে যারা আছেন, তাদের কারোর কারোর তারেক রহমানকে নিয়ে আপত্তি আছে। যে চক্রান্তকারীরা এই কার্যক্রম শুরু করেছে, তাদের পশ্চিমা বিশ্বের একটি পক্ষের সমর্থনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার গতিরোধ করতে পারা মানেই চক্রান্তকারীদের এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মূল কারিগর হিসেবে একটি অপপ্রচার মাঠে চালানো হচ্ছে। সেটি হলো, এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড জামায়াত-শিবির। তাদের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হলো, ছাত্রলীগ, পুলিশ-প্রশাসন, চিকিৎস, সাংবাদিক সব শ্রেণি-পেশায় অনুপ্রবেশ করে হাসিনা সরকারকে বন্দি করা হয়। মেধার রাজনীতি নিয়ে আন্দোলনকে এক দফায় রূপান্তর করে সরকার ফেলানো হয়। এগুলো বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার। হাসিনার পতন হয়েছে বিগত ১৭ বছরের অপশাসনের জন্য।

ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল পটভূমি তৈরি করেছে বিএনপিই। তারেক রহমান নেপথ্যে থেকে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। হাসিনা পতনের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একক নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে শিবির সমর্থিত ছাত্ররা। তারা এখন দ্রুত ছাত্র-সংসদ নির্বাচন আয়োজনে তৎপর হয়ে উঠেছে। জাতীয় নির্বাচনে যাদের আপত্তি, তারা এখন বৈধভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দখল করতে চায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা নির্বাচন চাচ্ছে, তারা কেন জাতীয় নির্বাচন চায় না? 

বিদেশি শক্তি, জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জামায়াত-শিবির, কিছু উপদেষ্টা, পাঁচ পতিত বুদ্ধিজীবী, তারেক রহমানবিরোধী বিএনপির ভেতরে ক্ষুদ্র একটি অংশ যে চক্রান্তে জড়িয়ে পড়েছে, তাতে সবারই জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে। তাদের হুটহাট সিদ্ধান্তের কারণে ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগের পর বিএনপিকে রাজনীতির মাঠ থেকে মাইনাস করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার অলীক স্বপ্ন বাস্তবায়ন এত সোজা না। বরং তাদের বিভক্তির বীজ বিপনের কারণে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকারী ও সমর্থকদের সামনে ঘোর অন্ধকার অপেক্ষা করছে। তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে গিয়ে তারাই মাইনাস হয়ে যাওয়ার পথে।

বিগত প্রায় পাঁচ মাস বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতিটি বক্তব্য দেখুন, শুনুন। কত পরিচ্ছন্ন ও স্বচ্ছভাবে নিজের দল ও দেশকে নিয়ে কথা বলছেন। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ৩১ দফা ঘোষণা করেছেন। জনগণের ভোটে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে, তা নিয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে চমৎকারভাবে দলের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। সামনে গুণগতভাবে রাজনীতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলছেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি অপরিহার্য ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।

কিন্তু একটি কুচক্রী মহল তারেক রহমানের গুড লিডারশিপ দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। নিজেদের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে ভাবিত এবং শঙ্কিত করে তুলেছে। জামায়াতে ইসলাম, জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং সরকারের একটি ক্ষুদ্র অংশ তারেক রহমানের ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব ঠেকাতে নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল গ্রহণ করেছে। এরা মনে করছে, নির্বাচন বিলম্বিত করে বিএনপিকে বিতর্কিত করে তোলা যাবে। বিএনপিকে জনগণের বিরুদ্ধে নিয়ে গিয়ে নিজেদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের খায়েশ জাগ্রত হবে। এ জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর আইডি খুলে দক্ষ প্রযুক্তি টিম দিয়ে নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আপনাদের বুঝতে হবে, বিএনপির যতগুলো কর্মী আছে, আপনাদের সারা দেশে ততগুলো সমর্থকও নেই। ৫ শতাংশ ভোট নিয়ে এই অচক্রান্তে লিপ্ত হয়ে লাভ নেই। বরং নিজেরাই নিজেদের নিয়ে ভাবুন।

তারেক রহমান উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী একজন গণতন্ত্রমনা বাংলাদেশি। উগ্র বামপন্থী বা উগ্র ইসলাম পন্থাকে তিনি খুব একটা পছন্দ করেন না। এই পছন্দ না করা যদি তার দোষ হয় তাহলে আপনারা নিজেদের সংশোধন করুন। উগ্র ইসলামি কর্মকাণ্ড বাংলাদেশিরা পছন্দ করেন না। তারেক রহমান খাটি মুসলমান ও নামাজি ব্যক্তি। তিনি বাংলাদেশের সৃষ্টির চেতনায় বিশ্বাসী। তিনি বাংলাদেশি, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারক-বাহক।

বিগত বিরাজনীতিকরণের নতুন প্রজেক্টে বাংলাদেশের সুশীল সংবাদমাধ্যমগুলোও জড়িত। ইতিমধ্যে কুচক্রী মহলটি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকও সম্পন্ন করেছে। আপনারা স্বপ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ শেষ, আগামীতে বিএনপিও শেষ হবে। তারপর জামায়াত শেষ করবেন। এরপর নতুন দল করবেন। ভোট দেবেন, নিজেদের জনপ্রতিনিধিদের যেকোনো মূল্যে সংসদে নিয়ে আসবেন। বিষয়গুলো ভাবনার জগতের মতো, বাস্তবে অত্যন্ত কঠিন। এই কঠিন খেলায় হাত দিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলার দরকার কী?

বিএনপির যেসব নেতাকর্মী ক্ষমতাসীন হতে যাওয়ার যে ভাবধারায় আছেন, সেটি থেকে বেরিয়ে পড়ুন। ক্ষমতা বহুদূর। হাইব্রিড নেতারা আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন করে বিগত ৫ আগস্টের ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন করেছেন, আত্মীয়দের পুনর্বাসন করে যাচ্ছেন, আপনাদের কপালে দুঃখ আছে। আপনারা ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হবেন। আপনারা জুলাই-আগস্টের আন্দোলনকে পুঁজি করে ভাগ্যের উন্নয়ন করতে গিয়ে মুক্তিকামীদের বিতর্কিত করছেন। ক্ষমতা দেখিয়ে রাজনীতির মাঠ দখলে নিচ্ছেন। নিজেদের সংশ্লিষ্ট এলাকায় রাজা-মহারাজার মতো শাসন পরিচালনার যে স্বপ্নবিভোর তৈরি করেছেন, সেটি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। ত্যাগীদের পাশে থাকুন, ত্যাগীদের মূল্যায়ন করুন। জনগণের পাশে থাকুন।

বাংলাদেশের রাজনীতিকে সঠিক পথে আনতে আবার আন্দোলনে নামতে হবে ছাত্র-জনতাকে। সরকার এবং ছাত্রদের বিভ্রান্তিকর পরিকল্পনা, সেটি বাস্তবায়নে গোয়েন্দা সংস্থার যে তৎপরতা তা রাজনীতিবিরোধী বিরাজনীতিকরণ প্রজেক্ট। প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তার না করে চাঁদাবাজির সুযোগ করে দেওয়া, বিগত ৫ মাসে ফ্যাসিবাদ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, সংশ্লিষ্ট নিজেরাই চাঁদাবাজে জড়িয়ে অন্যকে চাঁদাবাজ বানানো, সরকারের বিভিন্ন খাতে নীরবে চাঁদাবাজি করা, এইগুলো দৃশ্যত অপশাসন। সেই অপশাসনের দিকে সরকারকে ধাবিত করে যাচ্ছে একটি অংশ যারা বিরাজনীতিকরণে জড়িত।

প্রধান উপদেষ্টা বিচক্ষণ মানুষ। তাকে কোনো ফাঁদে পা দেওয়া ঠিক হবে না। তাকে বিভ্রান্ত করতে প্রতিনিয়ত একটি গোষ্ঠী মাঠে সক্রিয়। ফ্যাসিবাদ উন্নয়ন উন্নয়ন করেছিল, এরা সংস্কার, সংস্কার করে ফ্যানা তুলে ফেলছে। যদি সরকার বিরাজনীতিকরণের পথে অগ্রসর হয়, তাহলে আন্দোলন অবধারিত। সরকারকে জামায়াত, ছাত্রদের রাজনৈতিক শক্তি মনে করে বিরাজনীতিকরণ প্রজেক্টে অগ্রসর করানো ভুল নীতি মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে মাঠে নামাতে বাধ্য করবে। এভাবে বিভক্তির রাজনীতি নিয়ে সরকারের সামনে এগোনো অত্যন্ত কঠিন হবে। দিকহারা হতে পারে সরকার। ক্ষমতা হারাতে পারে ছাত্র-জনতা। পুনর্বাসিত হবে ফ্যাসিবাদ। ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত হবে মুক্তিকামীদের।

বর্তমান সরকারের সেইফ এক্সিটও গুরুত্বপূর্ণ। আগামীতে কোন দল ক্ষমতায় আসবে, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, কারা বিরোধী দলে থাকবেন, সেটি নির্ধারণের দায়িত্ব আপনাদের দেওয়া হয়নি। আপনাদের সুন্দর সেইফ এক্সিটের জন্য দরকার নির্বাচন। নির্বাচন বিলম্বিত করে সররকারের বা ছাত্রদের অন্য কোনো ধান্দা থাকলে পতন অনিবার্য। সরকার ভুল পথে চললে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতিও নির্ধারণ হবে রাজপথে। জনগণ ভোটের দাবিতে মাঠে নেমে তাদের অধিকার নিশ্চিত করবে।

বাংলাদেশের মুক্তির একমাত্র পথ নির্বাচন। নির্বাচন টালবাহনা চলবে না। বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এরশাদের পতন হয়েছিল ১৯৮৬, ১৯৮৮ ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য। হাসিনারও পতন হয়েছে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত ভোট করার জন্য। অতএব নির্বাচনের মতো আগুন ইস্যুতে হাত লাগিয়ে নিজেদের জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করবেন না।

লেখক : রাজনীতি ও নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক


সর্বশেষ সংবাদ