মেধাবীদের জন্য অভিশাপ কোটাপ্রথা— বিলোপ করতে হবে

  © টিডিসি ফটো

গত ৫ জুন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই দুই শ্রেণির নিয়োগে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল, সেটি অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে উচ্চ আদালত। এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।

কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের রায়ের খবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশী ও ছাত্র-ছাত্রীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছে। এসময় সরকারি চাকরিতে সব ধরনের কোটা বাতিলের দাবি জানান তারা। সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল এবং কোটা ব্যবস্থার সমস্যাগুলো মোকাবেলার বিষয়ে কী ভাবছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। জানাচ্ছেন শাহ বিলিয়া জুলফিকার—

মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল সংবিধান পরিপন্থী
সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগের একটি রায়ের প্রেক্ষিতে আবারো পুনর্বহাল হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের ৩০ শতাংশ কোটাসহ অন্যান্য ৫৬ শতাংশ কোটা। ২০১৮ সালের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের চাপে বৈষম্যমূলক কোটাপ্রথা বিলুপ্ত হয়। ২০২৪ সালে এসে পুনরায় সেই কোটাপ্রথার প্রত্যাবর্তন শিক্ষার্থীদের জন্য হতাশাজনক। বিশেষ করে একজন আইনের ছাত্র হিসেবে কোটাপ্রথার প্রত্যাবর্তনকে আমি সংবিধানের অবমাননা হিসেবে দেখি। সংবিধানে একাধিক অনুচ্ছেদে যেকোনো ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৭ এ বলা হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। আবার অনুচ্ছেদ ২৮ এ বলা হয়েছে লিঙ্গ, ধর্ম বা অন্য কোনো ভিত্তিতে কারো প্রতি বৈষম্য করা যাবে না। অনুচ্ছেদ ২৯ এ স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, সরকারি চাকরিতে সকল নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে। ব্যতিক্রম হিসেবে শুধু অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বিধি বিধান প্রণয়নকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আমাদের সমাজে মুক্তিযোদ্ধারা মোটেই অনগ্রসর গোষ্ঠী নয়। তারা সরকার থেকে নিয়মিত মাসিক সম্মানী পেয়ে থাকেন এবং অন্যান্য নানা সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। তাদের সন্তানদের জন্য কোটা রাখা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। শুধু অনুচ্ছেদ ২৯-ই নয়,  অনুচ্ছেদ ১৯ এ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে। তাই আমি মনে করি, বিজ্ঞ হাইকোর্ট বিভাগ কোটাপ্রথা পুনর্বহাল করে যে রায় দিয়েছেন, তা আইনগতভাবে ভ্রান্তিপূর্ণ এবং আদালত কর্তৃক নির্বাহী বিভাগের উপর অনধিকার হস্তক্ষেপ। আশা রাখি, বিজ্ঞ আপিল বিভাগ অতি দ্রুত এই রায় বাতিল করে সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করবেন।

রাফিদ হাসান সাফওয়ান, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কোটা মেধাবীদের জন্য অভিশাপ 
সারা বিশ্বের তরুণ জনগোষ্ঠী যখন নতুন কিছু উদ্ভাবন, আর বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার চিন্তা করছে; সেখানে বাংলাদেশের গুটি কয়েক মানুষ মেধাবীদের অভিশাপ- "কোটা" নামক সুযোগের জন্য লড়ছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জা জনক। কিন্তু আশার বিষয় হচ্ছে সচেতন আর প্রকৃত মেধাবীরা কোটা নামক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ঘৃণা করে আসছে এই পদ্ধতিকে। বর্তমান সময়ে আমাদের উচিত বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো দক্ষতা গুলো অর্জন করা। আমাদের উচিত শুধু মাত্র চাকরির দিকে না ছুটে উদ্ভাবন আর নতুন নতুন উদ্যোগের দিকে নজর দেয়া। এর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উদ্যোক্তা ও উদ্ভাবনী পরিবেশ সৃষ্টি করা। এক্ষেত্রে পরিবারও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। পড়াশুনা শেষ করেই চাকরি করতে হবে, তাও আবার সরকারি চাকরি, সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন পারে কোটার মতো কালো ছায়া থেকে দূরে থাকতে। অন্যদিকে মেধাবীদের যোগ্য স্থান থেকে বঞ্চিত করা সত্যিই অনৈতিক। তাদের চেষ্টা,পরিশ্রম সবকিছুই যখন অল্পের জন্য থমকে যায় তখন নেমে আসে হতাশা। আর হতাশা থেকে যখন আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটে, সেই দায় থেকে যায় আমাদের পুরো জাতির উপর।

তৌফিকুল ইসলাম আশিক, শিক্ষার্থী, পোর্ট এন্ড শিপিং ম্যানেজমেন্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি

কোটা মেধার মূল্যায়নে প্রতিবন্ধক
কোটা সিস্টেম সার্বিকভাবে দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে। কোটা বিন্যাসের কারণে মেধাবীদের দেশ ছাড়ার প্রবণতাও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। মেধাবীরা দেশে তাদের মূল্যায়ন পাবে না এবং পরিশ্রম করার পরও যখন তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেনা; তখন তারা দেশ ত্যাগে বাধ্য হবে।দেশ ক্রমান্বয়ে মেধা শূন্যের দিকে যাবে। কোটার দরকার আছে। তবে একটা দেশের ৫৬% কোটা কখনোই যুক্তিযুক্ত না।দেশ পরিচালনার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রতি ১০০ জনে ৫৬ জন  যদি  মেরিটে পিছিয়ে থাকাদের মধ্য থেকে আসে তাহলে দেশটা কেমন চলবে? আমরা যদি কোটা ব্যবস্থার সার্বিক দিক বিবেচনা করি তাহলে দেখবো; স্কুলে, কলেজে কোটা দিয়ে তারপর আবার তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি আনা হয়।তারপরও তারা অন্যদের সমানুপাতে নিজেকে নিতে পারেনা।তাদেরকে ঠেলে ঠেলে আবার কোটা দিয়ে চাকরিতে আনতে হয়।তাছাড়া জেলা কোটার কী যৌক্তিকতা তা জানা নেই।বেশিরভাগ মেয়েরাই মনে করে নারী কোটার প্রয়োজন নেই।নারী কোটা মেয়েদের জন্য  ভালো কিছু না বরং এটা মেয়েদের জন্য অপমান।উল্লেখ্য যে, কোটার পরিমাণও একদমই যুক্তিযুক্ত না।২.৬৩ শতাংশ জনগণের জন্য ৫৬% চাকরি আর বাকি ৯৭% এরও বেশি অংশের জন্য  ৪৬% চাকরি।আমরা চাই দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে মেধাবী এবং দক্ষ মানুষ আসুক।

একই সাথে আমরা চাই আমরা আমাদের পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাবো। কিন্তু,তাদের সঙ্গে নিয়ে আগানোর জন্য ৫৬% কোটার প্রয়োজন নেই।কোটা রাখা হয় পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। আমাদের দেশের কোটা সিস্টেমের মাধ্যমে আসলে পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী কোনোভাবেই উপকৃত হচ্ছেনা। একজন কৃষকের সন্তান, রিকশাওয়ালা সন্তান পরিশ্রম করার পরও চাকরি পাবেনা কোটার কারণে।তাহলে এখানে পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীকে কীভাবে উপকৃত করা হচ্ছে? বরং, পিছিয়ে পড়াদের আরও পিছিয়ে দিচ্ছে। এই কোটার কারণে বিভিন্ন মহলে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত হতে হচ্ছে।গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অনেকে আছে যাদের জন্ম ৭১ এর পরে। ফলে বলাই যায় মুক্তিযোদ্ধা কোটার নামে সুবিধা লুফে নিচ্ছে একটি গোষ্ঠী আর সম্মানহানি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযুদ্ধের  মহান যোদ্ধাদের উপযুক্ত সম্মান বিঘ্নিত করছে এই কোটা সিস্টেম।

সানজানা আফিফা অদিতি, শিক্ষার্থী, একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বৈষম্যমূলক কোটাপ্রথা বিলোপ করতে হবে 
কোটা জিনিসটা আরোপ করা হয় একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার জন্য। সমাজে যারা পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী, যারা মূলধারার সমাজ থেকে সুযোগ সুবিধায় পিছিয়ে আছে, যারা অন্যদের তুলনায় দুর্বল তাদেরকে  প্রমোট করার জন্য এক্সট্রা সুবিধা হিসেবে কোটা দেয়া হয়।এখন তবে প্রশ্ন হলো , মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানেরা কি সমাজের পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী, সমাজের মূলধারা থেকে তারা কি দূরে, তারা কি সমাজের আর দশটা মানুষের তুলনায় দুর্বল?

দেশের সূর্য সন্তানেরা যেই শোষণকারী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বুকের রক্ত দিয়ে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে জীবন বাজি রেখেছিলো, তাদের সন্তানদেরকে কোটা প্রদান করা দেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার পরিপন্থি।মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারকে সমাজের পিছিয়ে পড়া দুর্বল গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা মুক্তিযোদ্ধাদের চরমভাবে অপমানিত করা বৈকি আর কিছুই নয়।সাম্য আর মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় উদ্দেশ্যে যেই মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখেছে, তাদের সন্তানদেরকেও এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠানোর আহ্বান জানাচ্ছি।

উল্লেখ্য যে, সংবিধান মতে  রাষ্ট্রে যদি পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী থাকে, সরকার যদি চায় তবে সেই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত জনগণকে কোটা দিতে পারে। তবে এই ক্ষেত্রে কোটা দেওয়ার উদ্দেশ্য হবে তাদেরকে মূলধারায় নিয়ে আসা। এখানে কোটা থাকবে কি থাকবে না থাকবে এটা সরাসরি সরকারের সিদ্ধান্ত। বিচার বিভাগ এখানে সাংবিধানিকভাবে হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার রাখে না। অর্থাৎ কোটা থাকতেই হবে এমন কোন সাংবিধানিক আইনগত বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশের সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়নি। তাই এই যে সংবিধান অনুসারে কোটা থাকতেই হবে বলে মুখে ফেনা তোলা হয় এই দাবিটা আসলে ভিত্তিহীন।এখন প্রশ্ন হল বাংলাদেশের কোন কোন গোষ্ঠীর কোটা দরকার? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বাংলাদেশে কোটা পাওয়ার অধিকার আছে শুধু দুটো গোষ্ঠীর। একদল শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং অন্যদের হলো বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। তারা কতটুকু কোটা পাবে সেই সিদ্ধান্তটা নেয়া হবে বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী, চাকরিপ্রার্থী সহ যত স্টেকহোল্ডার আছে সকলের সম্মিলিত মতামতের উপর ভিত্তি করে নেয়া সিদ্ধান্তের দ্বারা। সেইসাথে নিশ্চিত করতে হবে যে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গোষ্ঠীর মাঝে যারা সত্যিকার অর্থেই কোটা পাওয়ার যোগ্য অর্থাৎ অনগ্রসর অঞ্চল থেকে উঠে এসেছে তারাই যেন কেবল কোটা পায়।এক পুরুষের অধিক সময় ধরে যারা শহরে বসবাস করে ভালো চাকুরি/ব্যবসা করছে সেই ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর কেউ সমাজের পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর মাঝে পড়ে না।অথচ আমরা দেখতে পাই এই শহুরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরই চাকুরিতে অধিক পরিমাণ সুযোগ পায় কিন্তু বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশ যারা তারাই বঞ্চিত থাকে। এই চর্চার পরিবর্তন জরুরি।কেননা,বাংলাদেশকে স্বাধীন করা হয়েছে একটি বৈষম্যহীন, নিরাপদ, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং আইনের শাসনে পরিচালিত একটি মেধাভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। একটি বৈষম্যহীন মেধাভিত্তিক রাষ্ট্র কায়েম করার শর্ত হল এর প্রধান প্রধান জায়গাগুলোতে স্বজনপ্রীতি না রেখে মেধাভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন ও কার্যকরী রাষ্ট্রযন্ত্র তৈরি করতে হবে। কেবল একটি বৈষম্যহীন মেধাভিত্তিক নিয়োগ পদ্ধতি  তৈরি করার মাধ্যমে একটি সুস্থ এবং নিরাপদ রাষ্ট্রযন্ত্র তৈরি করা সম্ভব এবং একটি নিরাপদ রাষ্ট্রযন্ত্রই পারে একটি উন্নত, সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। তাই একটি মেধাভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার তাগিদেই এই বৈষম্য মূলক কোটাপ্রথাকে বিলোপ করে একটি কল্যাণকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

রিফাত রশিদ, শিক্ষার্থী,আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ