ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে প্রয়োজন সুশিক্ষিত সুনাগরিক
- এম এ মতিন
- প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৪, ১০:১১ PM , আপডেট: ০৯ মে ২০২৪, ১০:৩০ PM
যে সকল কারণে একটি মেগাসিটি বসবাসের যোগ্যতা হারিয়ে অবসবাসযোগ্য নগরের তালিকাভুক্ত হয় সেগুলোর মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত যানজট অন্যতম। বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার যানজট পরিস্থিতির সহনীয় মাত্রা অনেক আগেই অতিক্রম করেছে। তবে গত রমজান মাসে বিশেষ করে ঈদুল ফিতরের আগে ঢাকা শহর এবং এর আশেপাশে অভূতপূর্ব যানজটের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা নগরবাসী/দেশবাসী অর্জন করেছেন তাতে সংশ্লিষ্ট সকলেই একমত যে, এর একটা আশু বিহিত ব্যবস্থা করা দরকার। কী সেই ব্যবস্থা? যানজট নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে সরাসরি কাজ করেন ট্র্যাফিক পুলিশ যারা ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। অন্যান্য যারা সংশ্লিষ্ট তাদের মধ্যে, বিআরটিএ, বিআরটিসি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ অন্যতম। পরোক্ষভাবে যাত্রী কল্যাণ সংস্থা, বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ইত্যাদি সংস্থাও যানবাহন চলাচল ও যানজটের সাথে কমবেশি সম্পৃক্ত।
কোনরূপ গবেষণা বা প্রতিবেদন এর উপর নির্ভর না করে একজন সাধারণ যাত্রী বা গাড়িচালক হিসেবে এ কথা সহজেই এবং নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, যে পরিমাণ যানবাহন পিক আওয়ারে ঢাকা শহরে চলাচল করে সীমিত সংখ্যক ট্র্যাফিক পুলিশের পক্ষে ম্যানুয়ালি সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। বিভিন্ন মোড়ে পিক আওয়ারে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ট্র্যাফিক পুলিশের যে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তাঁদের এই কষ্টকর দায়িত্বপালনের বিষয় বিবেচনা করে ট্র্যাফিক পুলিশের কাজের মেয়াদ ৮ ঘণ্টার স্থলে ৪ ঘণ্টা করা হয়েছে। ঢাকা শহরের দূষিত বায়ু ও চরম আবহাওয়ার মধ্যে কাজ করে ট্র্যাফিক পুলিশরা কেমন আছেন? রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, একাধারে ৬ মাস বা এর অধিক সময় ট্র্যাফিক পুলিশ হিসেবে কাজ করেছেন এমন কর্মচারী/কর্মকর্তাদের অনেকেই শ্বাসকষ্ট, হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। অতএব যানজট নিয়ন্ত্রণে ট্র্যাফিক পুলিশকে অযথা দোষ দিয়ে লাভ নেই। তবে রাজধানী শহরে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ইলেকট্রনিক সিগন্যাল পদ্ধতি না থাকা জনগণ/যাত্রীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে বৈ কি? আমরা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করি তখন ডিজিটাল সিগন্যাল ব্যবস্থার কথা এসেই যায়। যা হোক, আমরা যখন ঢাকা শহরের সমস্যা তথা উন্নয়নের বিষয় নিয়ে কথা বলি তখন অবলীলাক্রমে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ সেই সঙ্গে যানজট নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গ আসে।
যদি প্রশ্ন করা যায়, ঢাকা শহরের এক নম্বর সমস্যা কোনটি? তাহলে শতকরা প্রায় শতভাগ লোক উত্তর দেবেন, ‘যানজট’। সত্যি কথা বলতে কি যানজট ঢাকা শহরের এক নম্বর সমস্যা বটে। তারপর যদি সম্পূরক প্রশ্ন করা যায়, এর তাৎক্ষণিক সমাধান কি? তাহলে আমরা কী উত্তর পাবো জানি না। তবে এই নিবন্ধে আমরা সে কথাই নিবেদন করার চেষ্টা করছি। বর্তমানে ঢাকা শহরে যে পরিমাণ রাস্তা রয়েছে তা গোটা শহরের ১০.৫%। একটি আদর্শ নগরীতে গোটা শহর যতটুকু জায়গার উপর অবস্থিত সেই মোট জায়গার ২৫% রাস্তা থাকা প্রয়োজন। বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআর আই)-এর এক গবেষণায় দেখা দেখা যায়, ঢাকা শহরে বর্তমানে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা প্রায় ৫১ লাখ ১০ হাজার। এরমধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে প্রায় ৪ লাখ। গত এক বছরে মোটর বাইক ৬ লক্ষ থেকে এক লাফে বেড়েছে ৩৬ লাখে। ব্যক্তিগত গাড়ি এবং মোটর বাইকের সংখ্যা যে বেড়েছে তা তো রাস্তার দিকে তাকিয়ে আমরা স্বচক্ষেই দেখছি। যানজটের কারণে যে ক্ষতি শহরবাসীর হচ্ছে এর উপর সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য না থাকলেও এ আর আই –এর বিভিন্ন গবেষণায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এ আর আই তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে যে, গত এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে (২০২৩) ঢাকা শহরে গাড়ির গতি ছিল ঘণ্টায় মাত্র ৪.৮ কিমি। অথচ কয়েক বছর আগে ২০০৫ সালে এই গতির পরিমাণ ছিল ২১ কিমি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যানজট শুধুমাত্র গতিশীলতাই কমায়নি বরং যাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আর অর্থনীতির ওপর যে প্রভাব পড়েছে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে যানজটের কারণে দেশের অর্থনীতিতে প্রায় শত কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। একই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের আক্রমণের পূর্বে ঢাকা শহরে যানজটের কারণে যাতায়াতকারীদের প্রায় ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এসকল তথ্য সামনে রেখে আমরা যদি যানজট থেকে মুক্তি পেতে চাই তাহলে আমাদের কী করা উচিত? একথা সত্য যে রাতারাতি আমরা রাস্তাঘাট এর পরিমাণ বাড়াতে পারবো না কিংবা যানবাহনের সংখ্যা এবং মহানগরীর জনসংখ্যা কমাতে পারবোনা। তাহলে কি আমরা থেমে যাব? আমরা রাস্তায় চলাচল করবো না? তাতো সম্ভব নয়। চলাচল আমাদের করতেই হবে, যানবাহনে আমাদের চড়তেই হবে। তাহলে আমরা এই যানজটের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাৎক্ষণিক কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি? এ আর আই যানজটের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পালনীয় অনেক সুপারিশ করেছে। সুপারিশের সংখ্যা সহস্রাধিক বলে জানা যায়। সেগুলো কর্তৃপক্ষের সক্রিয় বিবেচনাধীন আছে। আজকে আমরা এ নিবন্ধে যে কথাটি বলতে চাই তা হল এই মুহূর্তে যানজট নিরসনের জন্য আমি আমরা আপনি কিংবা আপনারা কি উপায় অবলম্বন করতে পারি? আমরা মনে করি, সবাই যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে উচ্চমাত্রার শৃঙ্খলাবোধ অবলম্বন করি এবং ধৈর্যের সাথে চলাচল করতে পারি তাহলে আশা করা যায় যানজট কিছুটা হলেও কমে আসবে। একটি উদাহরণ দিতে পারি, যেমন ধরা যাক - একটি বিয়ে বাড়ি। সেখানে অতিথিদের জন্য একটি ঘরে বসা ও আহারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেখানে শ' খানেক লোক বসতে পারেন। অথচ অতিথির সংখ্যা দুই শতাধিক। এখন এই দুই শত লোক যদি একসাথে এই অতিথিশালায় প্রবেশের চেষ্টা করেন তাহলে এখানে বিশৃঙ্খলা ছাড়া কি হতে পারে? তাহলে অতিথিবৃন্দ কী করতে পারেন? যেহেতু অতিথিশালার ধারণ ক্ষমতা ১০০ জন তাই ১০০ জনের ব্যাচ করে অতিথিগণ অতিথিশালায় প্রবেশ করতে পারেন এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে তৃপ্তি সহকারে তাদের আহার গ্রহণ কার্য সম্পাদন করতে পারেন।
অনুরূপভাবে ঢাকা শহরের যানজটের ইতিবৃত্তান্ত একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। ঢাকা শহরের এয়ারপোর্ট রোডের কথাই ধরা যাক। এখানে রাস্তা দিয়ে একসাথে দুই লেনে ৪/৪ টি গাড়ি স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারে। এর মধ্যে যদি পিছনের গাড়িগুলো হুড়োহুড়ি করে ৪ লাইনের জায়গায় ৫/৬ লাইন করে ফেলে তাহলে কি অবস্থা হতে পারে? লেন ভঙ্গ করা ট্র্যাফিক আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। গাড়ি চালকগণ তা জানেন, জেনেও আইন অমান্য করেন। কারণ তারা এও জানেন, গতিসীমা ভঙ্গ করে, লেন-আইন ভংগ করে ডান-বাম ঘোরে ৫০/১০০ গাড়ি অতিক্রম করে সামনে গিয়ে গাড়ি চলাচল একেবারে বন্ধ করে দিলেও তার শাস্তি হবে না। ট্র্যাফিক পুলিশ তো অনেক দূরে। রাস্তায় সি সি ক্যামেরার অভাব। ডিভাইডারবিহীন রাস্তায় এমন দৃশ্য নিত্যকার। এখানে গাড়ি চালকদের সর্বোচ্চ শৃঙ্খলাবোধ, বিচার বুদ্ধির প্রয়োগ, ধৈর্য এবং অন্য গাড়ি চালকদের প্রাপ্য অধিকার এর প্রতি সম্মানবোধ কার্যকর ভূমিকা রাখতা পারে। বাস্তবতা হলো– একটি বাস যদি ২টি বাস অতিক্রম করে আগে বাস স্টেশনে পৌঁছাতে পারে তা হলে অন্তত ২/১ জন প্যাসেঞ্জার বেশী পাবে বলে তার বিশ্বাস। এটা তার জন্যে খুবই প্রয়োজন। কারণ ট্রিপ শেষে চুক্তির টাকা মালিককে তার বুঝিয়ে দিতে হবেই। বোকার মত ভদ্রলোক সেজে ১০টা বাসের পিছনে বসে থাকার তো কোন যুক্তি নাই। গাড়িচালকদের নিয়মিত কর্মচারী হিসেব মাসিক বেতন না দিয়ে চুক্তিভিত্তিক বাস চালানো– এটি ঢাকা শহরে এবং অন্য জায়গায় যানজট সৃষ্টি, রাস্তায় অনবরত ভেঁপু বাজিয়ে, ডান-বামে বাস চালিয়ে, ভীতিকর পরিবেশ তৈরির একমাত্র কারণ। একটি কথা মনে রাখা দরকার, কোন রুটে যাত্রীর কমতি নেই – বরং দিনকে দিন বাড়ছে। তা হলে প্রতিযোগিতা করে আগে গিয়ে যাত্রী তোলা, রাস্তার মাঝখানে যাত্রী নামানো-উঠানোর প্রয়োজন কী? ঢাকা শহরে ৬/৭টি রুটে ৬/৭ রঙের বাস চললে এবং সুস্থিরভাবে গাড়িচালকগণ বাস চালালে মালিকদের আয়ের কমতি হবে বলে মনে হয় না। উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের কর্তব্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেগা সিটিগুলোতে মাস ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম চালু করা। এতে অতিরিক্ত খুব বেশি খরচ নেই। দরকার শুধুমাত্র সুশিক্ষা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং ইতিবাচক মানসিকতা। আর গাড়ি চালকদের উন্নত মানসিকতা সৃষ্টির জন্যে দরকার প্রেষণা ও চলমান প্রশিক্ষণ। এ আর আই -এর সুপারিশে বলা হয়েছে গাড়ি চালকদের মোটিভেশনের জন্যে বার্ষিক বাজেটে অন্তত ২০০০ কোটি টাকা রাখা প্রয়োজন। ব্যয়বহুল বটে। তবে গাড়িচালকদের বি আর টি সি’র একটি উন্নতমানের ক্লাসরুমে, চা-নাস্তা খাইয়ে, সম্ভব হলে একটি ছোট্ট খাম হাতে দিয়ে তাদেরকে বুঝানো রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় তাদের করণীয় কী? যানজট মোকাবেলায় তাদের সহযোগিতার কোন বিকল্প নেই। এর পাশাপাশি করণীয় পালন না করলে কী শাস্তির ব্যবস্থা আইনে রয়েছে, ইত্যাদি। গাড়ি চালকদের এই চলমান শিক্ষা/প্রশিক্ষণকে একটি জাতীয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে বাৎসরিক বাজেটে সাধ্যমতো বরাদ্দ রাখতে হবে। ২০০০ কোটি টাকা এই মুহূর্তে খরচ করতে না পারলেও বৃহত্তর স্বার্থে অন্তত ২০০ কোটি টাকা গাড়িচালকদের পেছনে প্রশিক্ষণ বাবদ খরচ করলে লাভ বৈ ক্ষতি হবে না। এ কাজের জন্যে তাৎক্ষণিকভাবে ট্র্যাফিক বিভাগ বাস স্টেশনগুলোতে অনবরত রেকর্ড বাজাতে পারেন। যেখানে গাড়ি চালক, যাত্রী এবং যথেচ্ছভাবে রাস্তা পারাপার ইচ্ছুক পথচারীদের জন্যে সতর্কবার্তা থাকবে। ট্র্যাফিক জ্ঞানশূন্য লক্ষ লক্ষ রিকশাচালকের কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণের জন্যে বাজেটে অন্তত কিছু বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন বলে মনে করি।
এবার পথচারী পারাপার নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। কথায় আছে, ‘প্রয়োজন আইন মানে না’। কিন্তু এর ফলাফল যদি হয় ভয়াবহ? উদাহরণ দেয়া যাক– সময় সকাল ৮টা। স্থান– এয়ারপোর্ট থেকে হাউজবিল্ডিং। হরেক রকম গাড়িতে রাস্তা কানায় কানায় পূর্ণ। সকাল ৯টার মধ্যে পোঁছাতে হবে নির্দিষ্ট অফিসে/ গন্তব্যে। গাড়ির গতি বেশী না হলেও ১৫-২০ কিমি এর কম নয়। হঠাৎ চালকের নজরে পড়লো হাত উঁচুতে উঠিয়ে জন কয়েক রাস্তার ওপারে যাওয়ার জন্যে রাস্তার মাঝখানে এসে পড়েছেন। চালক বাধ্য হয়ে গাড়ি থামালেন। একজনের পেছনে আর কয়েকজন। এয়ারপোর্ট থেকে হাউজবিল্ডিং এর বাইরের কথা নাই বা বললাম। এর ফলাফল কী? পাঠকবৃন্দের নিকট তা ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই আশা করি। মজার ব্যাপার হলো উল্লিখিত জায়গায় বেশ কয়েকটি ওভারব্রিজ রয়েছে। সেগুলো কিন্তু প্রায় খালি। এর পর ‘অননুমোদিত ইউটার্ন’। ইউটার্ন এর ফলে যে রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হয় সে কথা তো বলাই বাহুল্য। যথেচ্ছ পথচারী পারাপার, অননুমোদিত ‘ইউটার্ন’ বন্ধ হলেই কি ঢাকা শহরের যানজট চলে যাব? হয়তো যাবে না। কিন্তু ১৫/২০ কিমি গতি যে ০ কিমি –এ আসবে না সে কথা তো অবশ্যই সত্যি। ট্র্যাফিক পুলিশ জানে, এতে কী অসুবিধা হচ্ছে এবং অননুমোদিত পথচারী পারাপার কিংবা ‘ ইউ টার্ন’ কীভাবে বন্ধ করতে হয়। কিন্তু তারা তা করছে না। ‘গা ছাড়া ভাব’ যাকে বলে। ঢাকা শহরের ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনায় পথচারীদের নির্দেশনা তথা মোটিভেশন এবং ফোর্সড এডুকেশন সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। অতীতে আমরা লক্ষ্য করেছি, পথচারীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ট্র্যাফিক পুলিশ মাইক ব্যবহার করতেন, রেকর্ড বাজাতেন। তাতে দিনভর উচ্চারিত হতো- ‘ওভার ব্রিজ ব্যবহার করুন, যথেচ্ছ রাস্তা পারাপারের চেষ্টা করবেন না। এটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ,’ ইত্যাদি। এখন আর এমনটি শোনা যায় না। উন্নয়নশীল একটি দেশের রাজধানী শহর কেমন হবে, এর ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, জনসংখ্যা কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে, ভাসমান ছিন্নমূল লোকজনের কী হবে, প্রায় চলন্ত রাস্তায় গাড়িতে ভিক্ষা চাওয়া ভিক্ষুকদের কী হবে? এগুলো সবই ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনার অংশ। ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামলে একাধিক ছিন্নমূল মানুষ (নারী-পুরুষ) এসে যখন গাড়ির গ্লাসে হাত দিয়ে ঠোকর দিতে থাকেন তখন গাড়িতে বসা যাত্রীরা বিব্রত হন বৈ কি? এই ছিন্নমূল মানুষদের পুনর্বাসনের কোন ব্যবস্থা করা কি প্রয়োজনীয় নয়? অন্যদিকে এখানে দিন-রাত প্রায় ২৪ ঘণ্টা লোকজন ওভারব্রিজ ছেড়ে, এমন কি ওভারব্রিজের নিচ দিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছেন। বৃদ্ধ এবং ভারী লাগেজ বহনকারী যাত্রীদের কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু বাকিরা ওভারব্রিজ ছেড়ে ওভার ব্রিজের নিচ দিয়ে গাড়ির গতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যে রাস্তা পারাপার হন তাতে কি যানজটের সৃষ্টি হয় না? যখন একজন পথচারী হাত উঠিয়ে রাস্তা পার হওয়া শুরু করেন তখন গাড়িচালক গাড়ির গতি তাৎক্ষণিকভাবে থামাতে বাধ্য হন। এর ফলে কী ঘটে? উত্তর দিক অভিমুখে ধাবিত সকল গাড়ি থামতে বাধ্য হয় এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এর প্রভাবে খিলক্ষেত পর্যন্ত সকল গাড়ির গতি কমে যায়। অপরপক্ষে দক্ষিণ অভিমুখে গমনকারী গাড়িগুলোর গতি উত্তরদিকে আজমপুর পর্যন্ত তাৎক্ষণিকভাবে থেমে যায়। অতএব এই বেআইনি রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে পারলে অনাহুত এই যানজটের সৃষ্টি হবে না। বিষয়টি অতি সাধারণ কিন্তু এর ফল সুদূরপ্রসারী। আর একটি অতি সাধারণ অথচ বহুল চর্চিত বিষয় বলতে চাই। সেটি হলো যাত্রীবাহী বাসের যেখানে সেখানে যাত্রী নেয়া। ঢাকা শহরের যে কোন বাসস্ট্যান্ডের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বাসগুলো তাদের জন্যে নির্ধারিত স্থান ব্যবহার না করে যত্রতত্র এমনকি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠাচ্ছে এবং প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে যাত্রী নামাচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই রাস্তায় যানবাহনের গতির ফ্লু বিঘ্নিত হচ্ছে এবং ফলত যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। তাই গাড়িচালক, যাত্রী এবং পথচারীদের যদি ট্র্যাফিক আইনের আওতায় আনা যায় এবং তারা ধৈর্যের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে বাসস্ট্যান্ন্ড/নির্ধারিত জায়গা ব্যবহার করেন তাহলে আশা করা যায় রাস্তার যানজট অনেকটাই কমে যাবে। এজন্য যে জিনিসটির দরকার সেটি হল গাড়ি চালক এবং যাত্রী সবাইকে উচ্চতর শৃঙ্খলার সাথে চলাচল করতে হবে, ট্র্যাফিক পুলিশদের যথাযথ আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে, পথচারীদের যথাযথ শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে মোটিভেশনাল প্রচারণা চালাতে হবে। এ জন্যে ট্র্যাফিক পুলিশের পাশাপাশি স্কুল কলেজ থেকে ভলানটিয়ার নিয়োগ করা যেতে পারে। অননুমোদিত পথচারী এবং ইউ টার্ন ছাড়াও অননুমোদিত ধীর গতিসম্পন্ন যানবাহন মেইন রাস্তায় প্রবেশ করে দ্রুত চলমান গাড়ির গতি শ্লথ করে দেয়। যেমন– ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান, রিকশা, স্কুটার, মোটর বাইক। একটি কথা মনে রাখা দরকার। সেটি হল বিশ্বের যে কোন দেশের রাজধানী শহর অন্য শহরের তুলনায় আলাদা। রাজধানী শহরের অধিবাসীদের মূল্যবোধ, শৃঙ্খলাবোধ, আচার-আচরণ একটু আলাদাই হয় এবং হওয়া উচিত। সেজন্য অনেক দেশে রাজধানী শহরে বাসিন্দাদের পরিচয়পত্র বহন করতে হয়। পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ রাজধানী শহরে প্রবেশ কিংবা বাস করতে পারেন না। এমনকি নতুন যাত্রীদের যারা রাজধানী শহরে আসেন তাদের আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে হয় পুলিশের কাছে। যেমন-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, চাকরির ইন্টারভিউ, আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে আসা, ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের দেশে হয়তোবা অধিক জনসংখ্যার কারণে আমরা রাজধানী শহরে আসা বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা। যার ফলে প্রতিদিন জনসংখ্যার চাপ রাজধানী শহরের উপর বেড়েই চলছে। ফলশ্রুতিতে আমরা সম্মুখীন হচ্ছি ভয়াবহ যানজট এবং মনুষ্য জটের।
সুতরাং সুশিক্ষা, নাগরিক শৃঙ্খলাবোধ ও ট্র্যাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ, দক্ষ গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু, সর্বোপরি রাজধানী শহরে জনসংখ্যা ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণই হতে পারে ঢাকা শহরকে যানজটের হাত থেকে মুক্ত করার নিয়ামক।
লেখক: উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ ও প্রক্টর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এবং প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি)
ই-মেইল:amatin@aub.ac.bd