বিসিএসকে স্বপ্ন বানানোর আগে তিন প্রশ্নের জবাব খুঁজুন

অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস্ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত বোরহান উদ্দীন
অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস্ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত বোরহান উদ্দীন  © সংগৃহীত

সেদিন ২০২০ সালের ২৯ আগস্ট। আমি টিউশনির পথে, হঠাৎ মায়ের ফোন। পরের দিন আশুরা ছিল। বাড়িতে ভালো-মন্দ খাবারের আয়োজন। আমি মাকে বললাম, আসব না। দীর্ঘ করোনার বন্ধ কাটিয়ে শহরের আসলাম মাত্র, তাই যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কিন্তু মা বলল, আসতে হবে।

হৃদয়টা কেমন যেন ভারী হয়ে গেল, এরকম করে মা কখনো বলেনিতো। তড়িঘড়ি টিউশন শেষ করেই বাড়ির পথে নেমে পড়ি, পৌঁছাতে প্রায় রাত ১২টা। মা বসে ছিলেন আমি না পৌঁছানো পর্যন্ত। আম্মার টাইফয়েড চিকিৎসা চলছিল। ব্যাবহৃত ওষুধ, ইনজেকশন সব গাট্টি বেঁধে আমাকে দেখানোর জন্য রেখে দিয়েছে।

পরের দিন সকাল থেকেই আয়োজন শুরু। অসুস্থতা নিয়েই সব রান্না-বান্নার আয়োজন মা নিজের কাঁধে নিলেন। দুপুরে দেখলাম পোলাওসহ তিন প্রকারের ভাত ও বাহারি আয়োজন। নিজে আপ্যায়ন করে সবাইকে খাওয়ালেন। সবকিছু খুব স্বাভাবিক; আম্মাও সম্পূর্ণ সুস্থ।

মাগরিবের নামাজের জন্য আমি মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলাম। আম্মাও ওজু করে করে নামাজের জন্য যাচ্ছে দেখলাম। নামাজের একটু পরেই বাড়ি থেকে ফোন; মা বমি করছে। আমি দৌঁড়ে পৌঁছানোর আগেই বমির সঙ্গে মায়ের শরীরের কোনো রক্ত যেন আর অবশিষ্ট ছিল না। এ বীভৎস করুণ চিত্র দেখার মতো অবস্থা ছিল না।

আমার চিন্তায় ছিটেফোঁটাও ছিল না যে মা আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন। ফটিকছড়ি স্কয়ার হাসপাতালে ডাক্তার যখন কনফার্ম করলেন, আমার মাথায় যেন পুরো আকাশটাই ভেঙে পড়ল। আমার চিৎকারে সেদিন বিবিরহাটের আকাশ ভারী হয়েছিল।

২০১৯ সালের ১৭ মার্চ আব্বাকে হারানোর অল্প সময়ের মধ্যে ২০২০ সালের ৩০ আগস্ট মাকে হারিয়ে এভাবে অল্প বয়সে এতিম হয়ে যাব, তা কখনো কল্পনাও করিনি। সত্যি বলতে দুনিয়াতে বেঁচে থাকার আমার কোনো অবলম্বন ছিল না। মাথার মধ্যে পৃথিবীকে বিদায় জানানোর চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল বারংবার।

একা থাকলেই আম্মার স্মৃতি আমাকে ভেঙে চুরমার করে দিত। প্রতি রাত্রে কান্না করাই আমার দৈনিক রুটিনে পরিণত হলো। শোকে মূহ্যমান আমি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলাম। নিজেকে ব্যস্ত রাখার পন্থায় বিসিএস কোচিংয়ের যাওয়া আসা শুরু করলাম। নিয়মিত লাইব্রেরিতে বসতাম যেন আমি মাতৃশোকে দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা থেকে বেঁচে থাকতে পারি।

কিছুদিনের মধ্যে আমি একটা ছন্দে আসলাম। আম্মা আমাকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখতেন। সংকল্পবদ্ধ হলাম যেকোনো মূল্যে বিসিএস ক্যাডার হবো। আব্বা-আম্মার স্বপ্ন পূরণ করব। শিক্ষার্থী হিসেবে আমার অবস্থা খুব নড়বড়ে ছিল। বেসিক জায়গাগুলোতে খুব দুর্বল ছিলাম।

বিবিএ ফার্স্ট সেমিস্টারে ইয়ার ড্রপ থেকে কোনোমতে বেঁচে যাওয়া আমি অনেক সংগ্রাম করেও অনার্স রেজাল্ট আর ভালো করতে পারিনি। গোটা অনার্স লাইফজুড়েই এক ধরনের হীনমন্যতা কাজ করত। অধিকন্তু চার বছরের স্নাতক কোর্স সেশন জটে ছয় বছরের বেশি সময়ে শেষ করি। এরপর চাকরি ধরার যে তাড়া তা উপেক্ষা করে বিসিএসের জন্য বসে থাকাটা অনেক কঠিন ছিল। 

বিসিএসের ক্ষেত্রে একটা বিষয় আমাকে এগিয়ে দিয়েছে, সেটা হচ্ছে রেগুলারিটি। কম পড়লেও আমি রেগুলার পড়তাম। গুরু শরীফ আহমেদ চৌধুরী স্যারের প্রতিটি কথা আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করত। স্যারের ‘Know Thyself Method’ আমি সবসময় অনুসরণ করতাম।

আরো পড়ুন: মহাকাশের প্রতি আগ্রহ আর মহাকাশবিজ্ঞানে পড়া এক জিনিস নয়

পাড়াগাঁ থেকে উঠে এসে আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের মাঝারি মানের ছাত্রের জন্য বিসিএস ক্যাডার হওয়াটা সত্যিই আল্লাহর অশেষ করুণা। ক্যাডার হয়ে মা-বাবাকে জানাতে না পারাটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তি। এ আক্ষেপ আমি কখনো ভুলব না।

তবে এ যাত্রা খুব পিচ্ছিল, বন্ধুর ও ঝুঁকিপূর্ণ। চার-পাঁচ বছর সময় দিয়ে অনেককে আমি খালি হাতে ফিরতে দেখেছি। বিসিএসকে নিজের ড্রিম বানানোর আগে কতগুলো প্রশ্নের উত্তর রেডি করা জরুরি।

১. অনার্স শেষ করে দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকতে আপনি প্রস্তুত কিনা?
২. একটানা পরিশ্রমের ধৈর্য আছে কিনা?
৩. জীবনের কঠিন বাস্তবতায় ঠান্ডা মস্তিষ্কে নিজেকে ধরে রাখতে পারবেন কিনা?

এসব প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক হলে মাঠে আসুন। তিন  মন্ত্রে (কঠোর তপস্যা, কৌশলী সিদ্ধান্ত, বিধাতার অনুগ্রহ অর্জন) মুগ্ধ হয়ে স্বপ্নের পিছনে লেগে থাকুন। তবে এক্ষেত্রে সঠিক গাইডলাইন অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ‘Patience is bitter, but its fruits are sweet’.

লেখক: অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস্ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত (মেধাক্রম ১৩), ৪৩তম বিসিএস


সর্বশেষ সংবাদ