ঈদ আসলে পড়ার চিন্তা দূর হয়ে যেত মাথা থেকে

মো. মাকসুদুল হক খান মিরাজ
মো. মাকসুদুল হক খান মিরাজ  © প্রতীকী ছবি

মাহে রমজান শেষে খুশির ঈদ। এই ঈদের নাম ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতরের আরেক নাম রোজার ঈদ। ছোট বেলায় পড়া কবিতায় ঈদের একটা সুন্দর ছবি এখনো মনে গেঁথে আছে- ‘কেউ যাবে না কারে ফেলে, কেউ যাবে না কারে ঠেলে, অন্যে যদি দুঃখ পায় খুশির কিছু নাই তাতে। ঈদের আনন্দ আমরা ভাগ করে নেই সবাই মিলে।’          

চাঁদ দিয়ে শুল্ক পক্ষের শুরু। কিন্তু ঈদে নতুন চাঁদের অবস্থা- এই দেখিলাম সোনার ছবি আবার দেখি নাইরে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আরবি শাওয়াল মাসের প্রথম দিন ঈদুল ফিতর পালিত হয়। ঈদের আগের রাতটিকে ইসলামি পরিভাষায় লাইলাতুল জায়জা বলা হয় যার অর্থ পুরস্কারের রজনী। আমরা ছোট বেলায় বলতাম চাঁদ রাত। শাওয়াল মাসের চাঁদ অর্থাৎ সূর্যাস্তে একফালি নতুন চাঁদ দেখা গেলে পরদিন ঈদ।

নতুন চাঁদ দেখার উত্তেজনা তখনকার শিশুদেরও ছিল তবে বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে নয়, আমরা দেখতাম মাঠের পাশে দলবেঁধে দাঁড়িয়ে। সে কি আনন্দ! সমবয়সীরা মিলে ছোটাছুটি। হৈ হুল্লোড়। আসলে গ্রামে তখন কটা বাড়িতেই বা পাকা দালান ছিল। যা-ই-হোক তারপরই নামত অন্ধকার। বাড়ির উঠোনে হ্যারিকেন, কুপি বাতি জ্বালিয়ে শীতল পাটিতে বসে বড়রা গল্প করত, কেবল গল্পই হতো, কে কোন জিনিস কোন দামে কিনেছে তার বর্ণনা নয়।

তারাবির নামাজ নেই। সুতরাং গল্প আর চা। আম্মা রান্নাঘরে তখন অন্য কাজে ব্যস্ত। চাঁদের আলো কখনো সখনো হয়তো উঁকিঝুকি দিতো আমাদের নারিকেল গাছের সবুজ চিরল চিরল পাতার ফাঁকে। সন্ধ্যায় আলো ছায়ার মিলনে সে এক অপূর্ব দৃশ্য। 

ঈদ উপলক্ষে পুরো সপ্তাহ ছিল আমাদের জন্য পুলক মিশ্রিত। পড়াশোনার বালাই নেই। এমন কি পড়ার চিন্তাটা দূর হয়ে যেত মাথা থেকে। কোথায় বই, কোথায় খাতা-কলম-কোনো কিছুরই খবর নেই। ঈদের ছুটির শেষে স্কুলের বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা এবং অংক কষতে ঘাম ছুটে যেত। ঈদের আগে আগেই একবার বাড়িতে হাজির হতো গ্রামের নাপিত বাসুদেব আর লক্ষণ দা।

বাসুদেব দা বেশ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলত। তার কাছে ছিল চুলের হাঁটু ছাঁট - অর্থাৎ আমাদের মাথা তার দুই হাঁটুর মাঝখানে রেখে চুল ছোট করে কামিয়ে দিতো। কোথাও হঠাৎ কাচি বা ক্ষুর লেগে গেলে স্যাভলনের বিকল্প হিসেবে ফিটকিরি ঘষে দিতো।      

ঈদে তখনকার একটু অবস্থাপন্ন পরিবারের শিশুরা জরিদার পাঞ্জাবি পরতো। সাধারণ পরিবারের ছেলেরা নানা রঙের পপলিনের শাট পড়তো। বয়স একটু বাড়লে ঈদ উপহার হিসেবে পাঞ্জাবি পাওয়া যেত। নতুন কেনা হোক বা না হোক তবে ঈদের দিনে জামা কাপড় ধোপদুরস্ত হওয়া চাই এটা আমরা সবাই জানতাম। কাপড় নিজের হাতে অথবা মায়ের হাতে কাচা যা-ই-হোক না কেন, কাপড় তৈরি করা হতো নিজের হাতেই।

আমাদের কালের আগে -তবে আমরাও দেখেছি অদ্ভুত এক ইস্তিরি ছিল-কাঠ কয়লা পোরা বক্স ইস্তিরি। বাড়িতে বাড়িতে নয় গ্রামের শৌখিন দু’একজনের বাড়িতে। এখন তো ঘরে ঘরে ইলেকট্রনিক ইস্ত্রি, তথন পাওয়া না গেলে কাপড় ভাজ করে বালিশের নিচে রেখে ঘুমাতো। 

নতুন জুতো, স্যান্ডেল অবশ্য সবসময় পেতাম না। গ্রামে সারাদিন খালি পায়ে কাটাতাম। সন্ধ্যায় পাঁ ধুয়ে স্যান্ডেল পড়তাম। এখনকার মতো স্যান্ডেলের বাহুল্য এতোটা ছিল না। রোজার ঈদে বা কোরবানির ঈদ যে কোন একটাতে চামড়ার স্যান্ডেল পেতাম। নতুন জুতো পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। কদাচিৎ ঈদে নতুন জুতো পেলে আনন্দে শুকতাম। সেই অনুভূতির কথা বলে বোঝানো যাবে না।

নতুন জামা কাপড়ের কাছে ঘোরাঘুুরি করতাম। তবে নতুন শার্ট, পাঞ্জাবি, স্যান্ডেল লুকিয়ে রাখতাম কারণ ঈদের আগে খেলতে আসা বন্ধুদের কেউ যেন টের না পায় কি রকম হবে আমার ঈদের নতুন জামাকাপড় আর স্যান্ডেল। শার্ট আর স্যান্ডেল জোড়া অন্য বন্ধুদের কারো মতন না হওয়াই ছিল একটা বিগ ডিল।    

ঈদের সকালটা কাটতো উত্তেজনায় ভরা। খুব সকালে ওঠে দলবেঁধে নদীতে গোসল করতে যাওয়া। আমরা থাকতাম ঢাকার অদূরে ধামরাইয়ের প্রত্যান্ত অঞ্চলের একটি গ্রামে। বংশী নদীর কুল ঘেঁষে গড়ে ওঠা গ্রামের নাম রাজাপুর। লাইফবয় সাবানের তখন বেশ খ্যাতি ছিল। সুগন্ধি সাবান ছিল তিব্বত, ক্সসকো আর লাক্স। একসাথে সবাই গোসল করতে যাওয়ার ফলে সাবান নিয়ে পরে যেতো কাড়াকাড়ি। গোসল দ্রæত শেষ করে বাড়ি ফেরার প্রতিযোগিতাও থাকতো। 

আমাদের গ্রামে তখন ঈদের জামাত হতো পাঠশালা স্কুলের মাঠে। সে সময় গ্রামে গ্রামে ঈদগাহ ছিল না। পাশ্ববর্তী দু’এক গ্রাম থেকেও আমাদের ওখানে মানুষ আসতো। ঈদের নামাজ হলেও সবাই একসঙ্গে জড়ো হতো না। দেখা যেত নামাজে দাঁড়িয়েও মাতব্বররা এদিক ওদিক তাকিয়ে খোঁজখবর নিতেন তার পাড়ার লোকজন আসছে কিনা।

দূরে একজনকে দেখা যাচ্ছে দৌঁড়ে ঈদগাহের দিকে আসছেন। অতএব নামাজে দাঁড়িয়েও তার জন্য অপেক্ষা করো আরো কিছুক্ষণ। বাচ্চা নামাজিরা নামাজের কাতারে ছুটাছুটি করে ফুর্তি করতো। সে যে কি আনন্দ যেন এক খেলা। নামাজ আদায়ের পরে যথারীতি কোলাকুলি, ঈদ মোবারক বিনিময় -সে আরেক আনন্দ।            

নামাজের পরে এসে বাড়ির বড়দের পায়ে ধরে সালাম করা। ঈদ সেলামী অবশ্যই পেতাম। ঈদের সালামী দিয়ে পরে নিজের নানা রকম শখের জিনিস কিনতাম। রোজার ঈদ মানে সকালে ঈদগাহে যাওয়ার আগে সেমাই খাওয়া। বাড়িতে বেড়াতে আসা মেহমানদের আপ্যায়নে সেমাই। সেমাই নামটাই বেশ প্রচলিত। তবে সেইও নামও কোন কোন অঞ্চলে শুনতে পাওয়া যায়। গ্রামে একটা সময় শহরের মত রেডিমেড সেমাই সহজলভ্য ছিল না। দেখতাম বাড়িতে আম্মা তৈরি করতো ঈদের সেমাই।

আতপ চাউল সিদ্ধ করে হাতের দক্ষতায় তৈরি করতেন চালের গুড়ির তার। টুকরো সেমাই তৈরি করতে পারতেন পিড়িতে হাত ঘুরিয়ে। এটাকে বলা হতো কাচা সেইও। আমাদের বাড়িতে আরেকটি ছিল পিতলের তৈরি সেইওয়ের কল। বেশ কয়েকটি ছাট ছিল সে কলে-মিহি, মাঝারি আর মোটা সব রকম বানানো যেত এটাকে বলত কলের সেইও। কলের হাতল ঘুরানোর দ্বায়িত্ব পড়তো আমাদের ছোটদের ওপর। এই কাজ আমরা বেশ আনন্দ নিয়েই করতাম।          

আমাদের সময় ঈদ কার্ডের প্রচলন ছিল। পাড়ায় পাড়ায় ছেলেপেলেরা কার্ডের দোকান দিত। সেখান থেকে কার্ড কিনে বন্ধুদের দিত। কে কয়টা কার্ড পেলো সেগুলো আবার শিশুরা একত্র হয়ে মিলিয়ে দেখতো। রং বেরঙের জামা কাপড় পরে শিশুরা এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে বেড়াতো।            
  
এবার আসি রান্নার কথায়। আব্বা ঈদের বাজার করতেন। উয়ার্শী পাইকপাড়ার বড় বাজার থেকে সেমাই, চিনি, গরম মসলা, পোলাওয়ের চাল, কিসমিস কিনে আনতেন। বাড়ি থেকে কিছুটা দূর এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম যতক্ষণ না আব্বাকে দেখা যায়। কি একটা অবস্থা! ঈদ তো না এগিয়ে আসত, এ রকম অনেক দম বন্ধ করা মুহূর্ত। রোজার ঈদে সেমাই, কাচা সেইও আর কলে তৈরি সেইওয়ের ক্ষীর, পোলাও, কোরমা, বাড়ির বাগ দেওয়া বড় মোরগের ঝাল মাংস রান্না হতোই হতো। গন্ধে ম ম করতো পুরো বাড়ি।      
           
ঈদের দিন নতুন জামাকাপড় আর স্যান্ডেল পরে ডাঁট বেড়ে যেত। বন্ধুদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে সেমাই খাওয়ার পর নতুন স্যান্ডেলে ধুলোবালি লেগেছে কিনা চট করে এবং দেখে নিতাম। ধুলো লাগলে পানিতে চুবিয়ে নিতাম। চুবানোর পর হাঁটতে গেলে পায়ের তলার ঘর্ষণে ইদুরের মত স্কুইজি শব্দ করত।    
              
ঈদ যায় ঈদ আসে। সেই বয়স কবে ঝরে গেছে। মনে হয় এইতো সেদিনের ঘটনা। অথচ কত বছর পেছনের কথা। এখনো চোখ বন্ধ করলে সেসব স্মৃতি চোখে ভাসে, নস্টালজিক করে দেয়। জীবনের সেরা ঈদ পেছনে ফেলে এসেছি, যা কেবলমাত্র ছোট বেলায় পাওয়া সম্ভব, এখন নয়। যত ঈদ একজীবনে আসুক না কেন ঘুরে ফিরে ছোট বেলার ঈদই আমার কাছে সেরা, সবথেকে শ্রেষ্ঠ ঈদ। যা কখনো ভুলব না। মনে হয় আবার যদি ফিরে যেতে পারতাম সেই সময়ে।         

আমাদের সময়ের ঈদ আনন্দের কথা বলতে গিয়ে এত কথা বলা। তখন ঈদ এমনিতেই আমাদের কাছে আকর্ষণের বিষয় ছিল। বছরব্যাপী অপেক্ষা করে থাকতাম এই ঈদের জন্য। এই অপেক্ষাতে ছিল আনন্দ। এই আনন্দের জন্য অতিরিক্ত পয়সা খরচ করতে হতো না। আমাদের সময়ের সাথে এখনকার সময়ের পার্থক্য কি?

তখন আমরা খুব অল্পতেই খুশি হতাম। খুব বেশি চাহিদা ছিল না আমাদের। তখনকার ঈদ ছিল ছোটদের আর এখন মনে হয় বড়দের। লক্ষ টাকায় পাঞ্জাবি, ব্যান্ডের শার্ট, প্যান্ট, স্যান্ডেল, জুতো, দামি বিদেশি পারফিউম আরো কত কি! এখনকার ঈদের আনন্দ মনে হয় দাম দিয়ে কেনা। কৃত্রিম আনন্দ। 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।       


সর্বশেষ সংবাদ