৫ম গণবিজ্ঞপ্তি: মেধাতালিকায় এগিয়ে থেকেও সুপারিশ না পাওয়ার অভিযোগ

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও এনটিআরসিএ লোগো
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও এনটিআরসিএ লোগো  © ফাইল ফটো

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স নিয়ে এমবিএ করেছেন আব্দুর রাফি। অসচ্ছল পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী তিনি। পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর সব পর্যায়ের পরীক্ষাতেই ভালো ফলাফল করেছেন রাফি। স্বপ্ন ছিল শিক্ষক নিয়োগের ৫ম গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যে কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুপারিশ পাবেন। এরপর বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা করবেন।

সেই স্বপ্ন পূরণের দৌঁড়ে অনেকটা এগিয়েও গিয়েছিলেন রাফি। ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ৬৫ নম্বর পেয়ে। কিন্তু রাফির সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বেসরকারি স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসায় ৯৬ হাজারের বেশি শূন্য পদ থাকলেও একটি প্রতিষ্ঠানেও চাকরির সুপারিশ পাননি তিনি। অথচ রাফির চেয়ে কম নম্বর পেয়ে নামি-দামি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুপারিশ পেয়েছেন অনেকে।

আব্দুর রাফি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, মেধাতালিকায় এগিয়ে থাকলেও তাকে সুপারিশ করা হয়নি। অথচ আবেদনের সময় তিনি যে প্রতিষ্ঠানগুলো ‘চয়েস লিস্ট’-এ রেখেছিলেন সেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার চেয়ে কম নম্বরধারী এবং মেধাক্রমে পিছিয়ে থাকা প্রার্থীদের সুপারিশ করা হয়েছে। বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কীভাবে জীবন পরিচালনা করবেন সেই দুশ্চিন্তা এখন গ্রাস করেছে তাকে।

শুধু রাফি নয়; মেধাক্রমে এগিয়ে থেকেও ৫ম গণবিজ্ঞপ্তিতে একটি প্রতিষ্ঠানেও সুপারিশপ্রাপ্ত হননি ফিন্যান্স বিষয়ে নিবন্ধন সনদ নেওয়া ১৫ জন চাকরিপ্রার্থী। এই অবস্থায় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

তারা বলছেন, ব্যাংকিং এন্ড ইন্সুরেন্স বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স করেও অনেকে ফিন্যান্স, ব্যাংকিং এন্ড ইন্সুরেন্সে সুপারিশ পেয়েছেন অনেকে। তাদের নম্বর ৬০-৬২। এত কম নম্বর পেয়েও কীভাবে ১০ জন ফিন্যান্স, ব্যাংকিং এন্ড ইন্সুরেন্স বিষয়ে সুপারিশ পেলেন তা অনুসন্ধানের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। অবিলম্বে ৫ম গণবিজ্ঞপ্তির প্রাথমিক সুপারিশের ফল বাতিল করে নতুন করে সুপারিশের দাবি জানিয়েছেন তারা। 

বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) বলছে, প্রতিষ্ঠান প্রধানদের পাঠানো শূন্য পদের তথ্য এবং প্রার্থীদের আবেদনের ভিত্তিতে নিয়োগের প্রাথমিক সুপারিশ করা হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান ফিন্যান্স, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্সুরেন্স বিষয়ে চাহিদা দেওয়ায় শুধু ফিন্যান্স বিষয়ে সুপারিশ করা হয়নি। ফিন্যান্স বিষয়ে সমস্যা হওয়া প্রার্থীদের নিয়ে বোর্ড সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

প্রার্থীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এনটিআরসিএ’র সচিব মো. ওবায়দুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রতিষ্ঠান প্রধানদের শূন্য পদের চাহিদার ভিত্তিতে সুপারিশ করা হয়েছে। চাহিদার বাইরে সুপারিশ করলে অনেকসময় এমপিওভুক্তিতে সমস্যা হয়। ভুল হয়ে থাকলে বিষয়টি আমরা দেখবো। 

ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ফিন্যান্সের বিষয় কোড ৪২৪। আর ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্সুরেন্সের সাবজেক্ট কোড ৪৪৮। এ দুটি বিষয় কম্বাইন্ড করে মেধাতালিকা তৈরি করেছে এনটিআরসিএ। ৪৪৮ কোডের অর্থাৎ ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্সুরেন্স বিষয়ের সব নিবন্ধনধারীকে নিয়োগের সুপারিশ করা হলেও ফিন্যান্সের নিবন্ধনধারীদের নিয়োগের সুপারিশ করা হয়নি। অথচ ফিন্যান্সের সুপরিশবঞ্চিতদের অধিকাংশের মেধাক্রম ৬০০-৮০০ এর মধ্যে। নিজের বাড়ির কাছের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছেন। মেধাক্রম এক হাজারের মধ্যে হলেও তারা নিয়োগের সুপারিশ পাননি। সেখানে একই মেধাক্রমে পিছিয়ে থাকা প্রার্থীকে সুপারিশ করা হয়েছে।

তারা বলছেন, ফিন্যান্স, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্সুরেন্স বিষয়ে যারা এনটিআরসিএ’র সনদ প্রাপ্ত হয়েছেন তারা সবাই একই বিষয়ে ৪২৪ কোডে একই প্রশ্নেপত্রে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। জাতীয় মেধাতালিকায় একই সাথে অবস্থান করছেন। গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হওয়ার পর অনলাইনে প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদ দেখার জন্য অনুসন্ধানকালে যে সকল কলেজে পদ শূন্য দেখিয়েছে সেগুলোতেই তারা আবেদন করেছিলেন। এই কলেজগুলোর বাইরে তারা অন্য প্রতিষ্ঠানের সুপারিশের জন্য ‘ইয়েস’ অপশনেও ক্লিক করেছিলেন। অথচ ব্যাংকিং এন্ড ইন্সুরেন্স ভিন্ন বিষয় কোডে পরীক্ষা দিয়ে তাদের থেকে কম নম্বরধারীরা ফিন্যান্স, ব্যাংকিং এন্ড ইন্সুরেন্স বিষয়ে প্রাথমিক সুপারিশ পেয়েছে।

১৭তম শিক্ষক নিবন্ধনে ফিন্যান্স এবং ব্যাংকিং ও ইন্সুরেন্স বিষয়ে জাতীয় মেধাক্রমে অবস্থানে রয়েছেন সালেহা খাতুন। তিনি বলেন, আমার চয়েজ অর্ডারের কলেজে মেধাক্রমকে আমার চেয়ে পিছিয়ে থাকা প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। অথচ আমি মেধাক্রমে এগিয়ে থেকেও সুপারিশ পাইনি। ব্যাংকিং এন্ড ইন্সুরেন্স অনার্স করে তারা ফিন্যান্স, ব্যাংকিং এন্ড ইন্সুরেন্স বিষয়ে প্রাথমিক সুপারিশ পেয়েছে ৬০-৬২ নম্বর পেয়ে। এটি কীভাবে সম্ভব? শুধু সুপারিশ পাওয়াই নয়; ভালো কলেজ পেয়েছেন অন্তত ১০ জন। অবিলম্বে আমাদের নিয়োগের সুপারিশ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, সবক্ষেত্রেই মেধাক্রমে এগিয়ে থাকা প্রার্থীরাই চাকরির সুপারিশ পান। অথচ এনটিআরসিএ’র সুপারিশের ক্ষেত্রে ভিন্নতা। এটি মেনে নেওয়া যায় না। এত কষ্ট করে প্রিলি, লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়েছি। অথচ চাকরির সুপারিশ পাইনি। অবিলম্বে আমাদের নিয়োগের সুপারিশ করতে হবে। 

কাউসার আহাম্মদ নামে আরেক ভুক্তভোগী জানান, ‘আমার মেধাক্রম ৬৮৫, সিরিয়াল ৭৩৭। আমি যে ৪০টি প্রতিষ্ঠান চয়েস লিস্টে রেখেছিলাম সেখানে মেধাক্রমে থাকা নিবন্ধনধারীদের সুপারিশ করা হয়েছে। অথচ আমাকে একটি প্রতিষ্ঠানেও নিয়োগের সুপারিশ করা হয়নি। এই ফলে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা রয়েছে। এই ফল বাতিল চাই। নতুন করে ৫ম গণবিজ্ঞপ্তির প্রাথমিক সুপারিশের দাবিও জানান তিনি।’

এনটিআরসিএ’র চেয়ারম্যান সাইফুল্লাহিল আজমকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, ‘স্যারের অনেক সুনাম শুনেছি। তিনি এনটিআরসিএতে যোগদানের পর অনেক ভালো কাজ করেছেন। স্যারকে বলতে চাই, আমাদের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। আমাদের এমপিওভুক্তিতে কোনো জটিলতা নেই। এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী আমাদের সকল যোগ্যতা রয়েছে। স্যারের কাছে অনুরোধ, দ্রুত আমাদের নিয়োগ সুপারিশের ব্যবস্থা করুন।

সার্বিক বিষয়ে এনটিআরসিএ’র সচিব মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, নতুন নিয়ম অনুযায়ী ফিন্যান্স বিষয়ের নিবন্ধনধারীদের এমপিওভুক্তিতে জটিলতা তৈরি হতে পারে। সেজন্য তাদের প্রাথমিক সুপারিশ করা হয়নি। আমরা এ বিষয়ে বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত নেব। বোর্ড সভায় প্রার্থীদের সুপারিশের সিদ্ধান্ত হলে তাদের নিয়োগের সুপারিশ করা হবে।


সর্বশেষ সংবাদ