‘অবৈধ নিয়োগ-প্রমোশন না দেওয়ায়’ বিজয় দিবসের  অনুষ্ঠান বর্জন প্রো-ভিসিসহ বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় © সংগৃহীত

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পবিপ্রবি) শিক্ষকদের নিয়োগ ও প্রমোশনকে কেন্দ্র করে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের মধ্যে দুটি অংশে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। শর্ত পূরণ না হওয়ার পরও পদোন্নতি পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন একটি পক্ষ। দাবি না মানায় উপাচার্যকে ‘জামায়াতপন্থী’ আখ্যা দিয়ে উপ-উপাচার্যের নেতৃত্বে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানও বর্জন করেছেন বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের কিছু দাবি-দাওয়া উপাচার্য কর্তৃক পূরণ না হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকরাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। গত ১১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রিজেন্ট বোর্ডের ৫৭তম সভায় কয়েকটি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে এ মতবিরোধ দেখা দেয়। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষক ও ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ট্যাব) সাংগঠনিক সম্পাদক এবিএম সাইফুল ইসলামের প্রমোশন নিয়ে মতবিরোধ অন্যতম। দীর্ঘদিন ধরে তার পদোন্নতির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিতর্ক বিদ্যমান ছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রিজেন্ট বোর্ডের এক সদস্য জানান, বিধি অনুযায়ী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কমপক্ষে চার বছরের বাস্তব শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। কিন্তু তার সে শর্ত পূরণ হয়নি। একই সঙ্গে স্বীকৃত জার্নালে মোট ১০টি গবেষণা প্রকাশনা থাকতে হয়, যার মধ্যে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ন্যূনতম ছয়টি প্রকাশনা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রেও তিনি প্রয়োজনীয় সংখ্যক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করতে পারেননি। ফলে বিষয়টি অননুমোদিত উল্লেখ করে স্থগিত করা হয়।

আরও পড়ুন: পবিপ্রবিতে একই বছর অনার্স-মাস্টার্স পাশ করা কর্মচারীর অস্বাভাবিক পদোন্নতির অভিযোগ

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক জামাল হোসেনের স্ত্রী জিনাত নাসরিন সুলতানার নিয়োগের বিষয়টিও রিজেন্ট বোর্ডে অনুমোদন পায়নি। নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগে একজন শিক্ষক নিয়োগের কথা থাকলেও অধ্যাপক জামাল হোসেন রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তার স্ত্রীকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য নিয়োগ বোর্ডকে চাপ দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পদের অনুমোদন না থাকায় নিয়োগ বোর্ড ভবিষ্যতে ইউজিসি কর্তৃক পদ অনুমোদনের শর্তসাপেক্ষে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে মতামত দেয়। কিন্তু বিষয়টি রিজেন্ট বোর্ডে উত্থাপিত হলে এ প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত উল্লেখ করে বাতিল করা হয়। বরং বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পুনরায় নিয়োগের বিষয়ে বোর্ড সদস্যরা মতামত দেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব সিদ্ধান্ত নিজেদের অনুকূলে না আসায় বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের একটি অংশ রিজেন্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলামের ওপর দোষারোপ শুরু করেন। এতে পবিপ্রবির শিক্ষকরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। রিজেন্ট বোর্ড-পরবর্তী সময়ে অভ্যন্তরীণ বিভক্তি থাকলেও তা প্রকাশ্যে আসেনি। তবে বিজয় দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে উপ-উপাচার্যের গ্রুপটির সঙ্গে উপাচার্যের দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন: ‘বঞ্চিত’ দাবি করে দুই পদোন্নতি: ‘সহযোগী অধ্যাপক’ হওয়ার ৯০ দিন না পেরোতেই হচ্ছেন ‘অধ্যাপক’!

জানা গেছে, শেষ মুহূর্তে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক এস এম হেমায়েত জাহানের নেতৃত্বাধীন অংশটি উপাচার্য অধ্যাপক কাজী রফিকুল ইসলামকে দুটি শর্ত দেয়। শর্ত পূরণ হলে তারা বিজয় দিবস উদযাপনে অংশ নেবে, অন্যথায় নয়— এমন সিদ্ধান্ত জানানো হয়। শর্ত দুটি হলো— প্রথমত, সম্প্রতি শাস্তির আওতায় আনা দুই কর্মকর্তার শাস্তি মওকুফ করে স্বপদে বহাল করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসিক সায়েন্সের অধ্যাপক মামুন-উর-রশিদকে নতুন অনুষদের (ওশানোগ্রাফি) ডিন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। তবে উপাচার্য এসব শর্তে সম্মতি না দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।

প্রসঙ্গত, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে হেনস্তা ও চড়-থাপ্পর মেরে আহত করার ঘটনায় গত ৪ নভেম্বর খণ্ডকালীন কর্মকর্তা মো. লোকমান হোসেন (মিঠু) ও মো. মাহমুদ-আল-জামানকে সহকারী রেজিস্ট্রার পদ থেকে সেকশন অফিসার পদে পদাবনতি করা হয়।

এদিকে বিজয় দিবস উদযাপনের আগে উপাচার্য একসঙ্গে দিবসটি পালনের আহ্বান জানালেও উপ-উপাচার্য গ্রুপটি শর্ত না মানলে একসঙ্গে উদযাপনে অংশ নেবে না বলে জানায়, এমন তথ্য সংশ্লিষ্ট সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পরবর্তীতে উপাচার্য জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণসহ অন্যান্য কর্মসূচি সম্পন্ন করেন। এ সময় উপ-উপাচার্যের গ্রুপটি উপাচার্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী অভিযোগ তুলে স্লোগান দেয়। একই সঙ্গে তারা উপাচার্যকে জামায়াতপন্থী আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে বক্তব্য ও স্লোগান দিতে থাকে।

আরও পড়ুন: পদোন্নতির অনিয়মসহ পবিপ্রবির বঙ্গবন্ধু পরিষদের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লাগামহীন দুর্নীতির অভিযোগ

বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় কর্মসূচি কেন বর্জন করা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম হেমায়েত জাহান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা বিগত বছরগুলোতে জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সাথে একসঙ্গে কর্মসূচি করেছি। কিন্তু এবার ভিসি স্যারের কাছে আমাদের দাবি ছিল, আমরা তাদের সঙ্গে একসঙ্গে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণে যাব না। ভিসি স্যার আমাদের কথা শোনেননি। তাই আমরা কর্মসূচিতে যাইনি।

এ সময় দুই কর্মকর্তার শাস্তি মওকুফ ও অধ্যাপক মামুন-উর-রশিদকে নতুন অনুষদের ডিন নিয়োগের শর্ত দেওয়া হয়েছিল কী না— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এগুলো ভুল তথ্য। এ ধরনের কোনো কথা আমাদের হয়নি।

তবে উপ-উপাচার্য বিষয়টি অস্বীকার করলেও তার অনুগত শিক্ষক এবং আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক জামাল হোসেন শাস্তি মওকুফের দাবির বিষয়টি অকপটে স্বীকার করে বলেন, এই বিষয়গুলো তো আছেই। ভিসি অনেক কিছু করেন, তার অনেক কাজ আমাদের কাছে অসংলগ্ন মনে হয়। রিজেন্ট বোর্ডে যেসব বিষয় চূড়ান্ত হয়েছিল, তিনি সেগুলো ফিরিয়ে এনেছেন। এ বিষয়ে খোঁজ নিলে আরও জানতে পারবেন আপনারা।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, জাতীয় দিবসের মত গুরুত্বপূর্ণ দিনে উপ-উপাচার্যের এ ধরনের কর্মকাণ্ড ও উপাচার্যকে জিম্মি করে অনৈতিক দুটি দাবি তোলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। উপ-উপাচার্যসহ অন্যরা বিজয় দিবসে যে বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড করেছেন, তা সংবিধানস্বীকৃত পদে থেকে করা সমীচীন নয়। আমি বারবার একসঙ্গে বিজয় দিবস উদযাপনের আহ্বান জানিয়েছি, কিন্তু তারা আমাকে জিম্মি করে অসাধু দাবি আদায়ের চেষ্টা করেছে। এসব করে কেবল পরিবেশ ঘোলাটে হয়, সফলতা আসে না।

তিনি আরও বলেন, আমি বাকৃবির বিএনপিপন্থী সোনালী দলের সাংগঠনিক সম্পাদক, জিয়া পরিষদের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এবং ভেটেরিনারি অনুষদের সভাপতিসহ বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলাম। ছাত্রজীবনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের রাজনীতি করেছি। কিন্তু উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের সময় অবশ্যই বিধি ও নিয়ম মেনে কাজ করতে হয়। আমাকে যেভাবে অযাচিতভাবে ট্যাগিংয়ের মধ্যে ফেলা হচ্ছে, তা হীন প্রচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। আমি বারবার একসঙ্গে বিজয় দিবস উদযাপনের আহ্বান জানিয়েছি। তাদের নেতৃত্বে অধ্যাপক হেমায়েত স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, দুটি শর্ত পূরণ হলেই তারা অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন, নচেৎ নয়। শেষ পর্যন্ত তারা আসেননি। পরে যেসব শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন, তাদের নিয়েই সুশৃঙ্খলভাবে বিজয় দিবস উদযাপন করা হয়েছে।