মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ ‘এ ব্লক’—সাত দিনের বন্ধ ২০ দিনেও শেষ হল না

বিএমইউর এ ব্লক ভবন ও কক্ষের চিত্র
বিএমইউর এ ব্লক ভবন ও কক্ষের চিত্র © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ঝুঁকিপূর্ণ ‘এ ব্লক ভবন’ নিয়ে যেন লুকোচুরি চলছে। গত ২১ নভেম্বর ভয়াবহ ভূমিকম্পে ঢাকাসহ আশপাশের জেলায় ১০ জনের মৃত্যুর পর ভবনটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ভবনের অন্যান্য কার্যক্রম চলমান থাকলেও ভবনে অবস্থিত পোস্টগ্রাজুয়েট প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকদের হল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৭ দিনের জন্য বন্ধের পর ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও ওই হল আর খোলা হয়নি।

দৃশ্যমান কোনো সংস্কার দেখা না গেলেও প্রশিক্ষণার্থীরা কবে নাগাদ হলে উঠতে পারবেন, তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। এ ছাড়া ভবনের ঝুঁকি নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলায় এমন ‘শাস্তি’র মুখে পড়েছেন কিনা তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করছেন প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকরা। এদিকে আগামী বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) তৃতীয় মেয়াদে হল বন্ধের শেষ দিন হলেও পরদিন পুনরায় সভা আহ্বান করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, ওই সভায় হল খোলা-না খোলার ব্যাপারে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

মূলত, ভূমিকম্পের পর গত ২৪ নভেম্বর ‘৪ তলা বাড়িয়ে হয়েছে সাত, ‘অতি ঝুঁকি’ নিয়েই মেডিকেল শিক্ষার্থীদের বাস এই ভবনে’ শিরোনামে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসে সংবাদ প্রকাশের পর ৭ দিনের জন্য হল বন্ধের সিদ্ধান্ত জানায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ২৫ নভেম্বর এক নোটিশে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই হল খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে হলের ডাইনিং বন্ধ করে সংস্কার কাজ চালানো হবে বলেও জানানো হয়। ওই ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে মোট ২৭০ জন প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসক বাস করতেন।

12
সপ্তম তলা পুরো পরিত্যক্ত ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন

আরও পড়ুন: ৪ তলা বাড়িয়ে হয়েছে সাত, ‘অতি ঝুঁকি’ নিয়েই মেডিকেল শিক্ষার্থীদের বাস এই ভবনে

তবে সংস্কার শেষে ৩ ডিসেম্বর হল চালুর কথা থাকলেও ওইদিন আরেকটি নোটিশ জারি করে প্রশাসন। ওই নোটিশে বলা হয়, ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত হল বন্ধ থাকবে। তবে হল খোলেনি ১১ ডিসেম্বরেও। ফের মেয়াদ বাড়িয়ে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত হল বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরই মধ্যে গত ৪ ডিসেম্বর হল প্রভোস্ট (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. জামাল উদ্দীন আহমদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ওই ভবনের সপ্তম তলা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো সংস্কার চোখে পড়েনি। সংস্কার না করলেও বারবার বন্ধের মেয়াদ বাড়াচ্ছে কেন আমাদের বোধগম্য নয়— নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রেইনি চিকিৎসক

আজ সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) সরেজমিনে দেখা গেছে, এ ব্লক ভবনের ৪র্থ ও ৭ম তলার পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এতে ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়েছে ওই দুটি ফ্লোরে। তবে ৭ম তলা পুরোপুরি বন্ধের কথা থাকলেও সেখানে নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থানটি চালু রয়েছে। ওই ফ্লোরে অবস্থিত ডাইনিং কক্ষে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। যদিও নিরাপত্তা প্রহরীদের সূত্রে জানা গেছে, বাইরে তালা দেওয়া থাকলেও ডাইনিংয়ের কর্মচারীরা ভিতরে অবস্থান করছেন। এ ছাড়া চতুর্থ তলাতেও বেশ কয়েকজন পোস্টগ্রাজুয়েট প্রশিক্ষণার্থী অবস্থান করতে দেখা গেছে। হলের বাইরে পঞ্চম তলার কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও ক্যাফেটেরিয়া এবং দ্বিতীয় তলার ব্লাড ট্রান্সফিউশন ডিপার্টমেন্ট ও অডিটোরিয়াম সচল রয়েছে। আগের মতোই চলছে নীচতলার মার্কেটটিও। ফলে সংস্কারের জন্য হল বন্ধ হলেও প্রতিদিনই শত শত মানুষের আনাগোনা রয়েছে ভবনটিতে। 

13
হল বন্ধ হলেও চতুর্থ তলায় থাকছেন কয়েকজন চিকিৎসক

আরও পড়ুন: সপ্তম তলা ‘পরিত্যক্ত’, হল-ডাইনিং বন্ধের মেয়াদ বাড়ল, বিপাকে হাজারো প্রশিক্ষণার্থী

আকস্মিক সিদ্ধান্তে আমাদের হল বন্ধ দেওয়া হয়েছে। প্রথমে সাত দিনের জন্য বন্ধ বলা বলেও এ পর্যন্ত দুইবার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এতে আমাদের বাসায় থাকা নিয়ে সমস্যা তৈরি হচ্ছে— নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রেইনি চিকিৎসক

বিশ্ববিদ্যালয়ের নোটিশে বন্ধের পরও ‘অবৈধ’ উপায়ে কেউ কেউ অবস্থান করলেও বড় অংশই আবাসন সুবিধার বাইরে রয়েছেন। এ ছাড়া সপ্তম তলার ডাইনিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বাড়তি খরচে ক্যান্টিনে অথবা বাইরে থেকে খাবার নিতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। তবে প্রায় এক মাস বন্ধ থাকার পরও অবস্থানরত চিকিৎসক প্রশিক্ষণার্থীদের আবাসন সুবিধা ও ডাইনিং কার্যক্রম অনিশ্চিত বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। একাধিক পোস্টগ্রাজুয়েট ট্রেইনি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কবে নাগাদ হল খুলবে তা নিশ্চিত হতে পারছেন না তারা। হল বন্ধ থাকায় বাইরে বাড়তি খরচে থাকতে হচ্ছে তাদের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আবাসিক এক রেসিডেন্ট ট্রেইনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো সংস্কার চোখে পড়েনি। সংস্কার না করলেও বারবার বন্ধের মেয়াদ বাড়াচ্ছে কেন আমাদের বোধগম্য নয়। ট্রেইনি চিকিৎসকরা গণমাধ্যমে ভবনটি সম্পর্কে কথা বলায় ক্ষুব্ধ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এমন করছে কিনা—এমন সংশয়ও আছে।

আরও পড়ুন: মায়ের পথে মেডিকেলে দ্বিতীয় হওয়া নাবিহা, বললেন— ‘আমার কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই’

কিছু সংস্কার হয়েছে। আরও সংস্কারের জন্য সার্ভে চলছে— ডা. জামাল উদ্দীন আহমদ, ডক্টরস হল প্রভোস্ট, বিএমইউ

আরেক ট্রেইনি চিকিৎসক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আকস্মিক সিদ্ধান্তে আমাদের হল বন্ধ দেওয়া হয়েছে। প্রথমে সাত দিনের জন্য বন্ধ বলা বলেও এ পর্যন্ত দুইবার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এতে আমাদের বাসায় থাকা নিয়ে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কারণ আমরা প্রথমে সাত দিনের জন্য ব্যবস্থা করেছিলাম। সেটি এখন ২০ দিন পেরিয়েছে। অল্প অল্প করে মেয়াদ না বাড়িয়ে প্রয়োজনে বড় পরিকল্পনা করেই বন্ধ দিতে পারত।

আধুনিক যুগেও সনাতন পদ্ধতিতে চলছে হল কার্যালয়, নেই গতিশীলতা
বিএমইউর পোস্টগ্রাজুয়েট প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকদের জন্য একমাত্র হলটিতে ২৭০ জনের আবাসন সুবিধা রয়েছে। হল কার্যক্রমের জন্য প্রভোস্টের বাইরে নিয়োজিত রয়েছেন মাত্র একজন কর্মচারী। ‘হোস্টেল সুপারভাইজার’ পদবির ১৬তম গ্রেডের তৃতীয় শ্রেণির এই কর্মচারী দিয়েই চলছে পুরো কার্যক্রম। দাপ্তরিক ডিজিটালাইজেশন না হওয়ায় সব কিছু সামাল দিতে বেশ বেগ পোহাতে হয় এ কর্মচারীকে।

14
৭ম তলার হল কার্যালয় দ্বিতীয় তলার কাঠের বোর্ড দিয়ে তৈরি পরিত্যক্ত একটি কক্ষে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে

আরও পড়ুন: ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পরিত্যক্ত এক্সরে রুমে আগুন, কর্মচারী ‘পলাতক’

সরেজমিনে দেখা যায়, হোস্টেল সুপারভাইজার হলেও টাইপরাইটার থেকে অফিস সহকারীর যাবতীয় কাজ একাই করেন নুর এ আলম সরকার দিপু। অফিসের প্রয়োজনে কখনও আজিজ মার্কেটের কম্পিউটার টাইপ কিংবা ফটোকপির দোকান থেকে বিভিন্ন দপ্তরে ছুটতে হয় তাকে। তিনি ছাড়া আরও দু’জন প্লাম্বার এবং একজন ইলেকট্রিশিয়ান রয়েছেন এ অফিসে, যাদের দিয়ে দাপ্তরিক কোনো কাজ সম্ভব নয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল কার্যালয়ে বেশ ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে।

বুধবার তৃতীয় মেয়াদে হল বন্ধের শেষ দিন হলেও পরদিন পুনরায় সভা আহ্বান করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, ওই সভায় হল খোলা-না খোলার ব্যাপারে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এসব বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তাকে পাওয়া যায়নি। উপাচার্যের একান্ত সচিব ডা. রুহুল কুদ্দুস বিপ্লবও কল রিসিভ করেননি। জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রভোস্ট ডা. জামাল উদ্দীন আহমদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কিছু সংস্কার হয়েছে। আরও সংস্কারের জন্য সার্ভে চলছে। আমরা সপ্তম তলা সম্পূর্ণ বন্ধ ঘোষণা করেছি। অন্যান্য ফ্লোরগুলো চালু হবে। আগামী ১৮ ডিসেম্বর এ বিষয়ে সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, সভায় হল খোলার সিদ্ধান্ত আসতে পারে। আর ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বন্ধ ঘোষিত সপ্তম তলার ডাইনিং রুমটি পঞ্চম তলা অথবা নিচে টিএসসিতে নিয়ে আসা হবে। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে জনবল না থাকলেও প্রভোস্ট অফিসের ধীরগতি হয় না বলে দাবি করেন তিনি। প্রভোস্ট বলেন, আমাদের কাজ কম। এজন্য তেমন অসুবিধা হয় না। তবে আমরা একটা কম্পিউটার অপারেটর চেয়েছি।