গবেষণায় ১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা পাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা

ইউজিসির লোগো
ইউজিসির লোগো © টিডিসি সম্পাদিত

দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গবেষণা কার্যক্রমে নতুন গতি আনতে শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ২২৪ কোটি টাকার গবেষণা তহবিল। উচ্চশিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাস্তবায়িত হচ্ছে একটি বৃহৎ প্রকল্প—হায়ার এডুকেশন অ্যাকসেলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (হিট)। এ প্রকল্পের আওতায় সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে গবেষণা তহবিল দুই ধাপে বিতরণ করা হবে। প্রথম ধাপে ৬১২ কোটি টাকার গবেষণা তহবিল বিতরণের প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান। প্রথম ধাপের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর শুরু হবে দ্বিতীয় ধাপের তহবিল বিতরণ। 

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে হায়ার এডুকেশন অ্যাকসেলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (হিট) প্রকল্পের আওতায় গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল সক্ষমতা বৃদ্ধি, এবং নারী শিক্ষায় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব বিকাশে বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে চার হাজার ১৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। প্রকল্পটির যৌথভাবে অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার—এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ৫১ শতাংশ এবং বিশ্বব্যাংক ৪৯ শতাংশ অর্থায়ন করছে।

আরও পড়ুন: শহীদ-আহত পরিবারের সদস্যদের ঢাবি ভর্তিতে কোটা সুবিধা দেওয়ার তথ্যটি সঠিক নয়

সূত্র মতে, হায়ার এডুকেশন অ্যাকসেলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (হিট) প্রকল্পের আওতায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণাকে উৎসাহিত করতে প্রথম পর্যায়ে গবেষণায় অর্থ বরাদ্দের জন্য বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে গবেষণা প্রস্তাব (রিসার্চ প্রপোজাল) আহ্বান করে। আবেদন জমার শেষ তারিখ ছিল ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেশের সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোট ১ হাজার ৫১৬টি গবেষণা প্রস্তাব জমা পড়ে। এসব প্রস্তাবের মধ্য থেকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাছাইকৃত গবেষণা প্রকল্পগুলোকে অর্থায়নের আওতায় আনা হবে। গবেষণার মান, প্রাসঙ্গিকতা এবং সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনায় রেখে প্রকল্পগুলো নির্বাচন করা হবে। বর্তমানে গবেষণা প্রকল্প প্রস্তাবনাগুলোর মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চলছে। প্রতিটি প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করছেন দুইজন স্বতন্ত্র রিভিউয়ার, যাতে মূল্যায়নের নিরপেক্ষতা ও মান নিশ্চিত করা যায়। প্রত্যেক রিভিউয়ার নির্দিষ্ট সূচকের ভিত্তিতে নম্বর প্রদান করছেন।

‘এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। যেহেতু দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের দেশে গবেষণার জন্য বরাদ্দ সীমিত, তাই এই নতুন তহবিল গবেষণায় আগ্রহী শিক্ষক ও গবেষকদের জন্য এক অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তবে এ সুযোগের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রস্তাবিত গবেষণাগুলো হতে হবে মৌলিক, প্রাসঙ্গিক এবং এমন, যা বিদ্যমান জ্ঞানভান্ডারে বাস্তব অবদান রাখতে পারে। তবে বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং যেন জটিলতায় গবেষকরা না পড়েন, সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।’- অধ্যাপক ড. মো. আবু ইউসুফ

সব প্রস্তাবনার স্কোর যাচাই-বাছাই শেষে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০টি প্রকল্প চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হবে অর্থায়নের জন্য। প্রতিটি নির্বাচিত গবেষণা প্রকল্পের জন্য গড়ে প্রায় দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ফান্ড বরাদ্দ দেওয়া হবে। তবে প্রকল্পের পরিধি ও প্রয়োজন অনুযায়ী এই অর্থ কিছুটা কমবেশি হতে পারে। ইতোমধ্যে ইউজিসি অভিজ্ঞ গবেষক, খ্যাতনামা শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একাধিক মূল্যায়ন কমিটি গঠন করেছে। এসব কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইউজিসির তিনজন সদস্য, যারা প্রত্যেকে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জুলাই মাসে শুরু হয় এবং এটি ২০২৮ সালের জুলাই মাসে শেষ হওয়ার কথা। পাঁচবছর মেয়াদি বৃহৎ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার গুণগত মানোন্নয়নে একটি দীর্ঘমেয়াদি কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। শুধু গবেষণাতে নয়, বরাদ্দপ্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃষি, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও সামাজিক বিজ্ঞানের মতো ক্ষেত্রে গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাডেমিক সক্ষমতা, প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতেও কাজ করবে এ প্রকল্প।

আরও পড়ুন: শিক্ষক নাদিরা ইয়াসমিনকে সাতক্ষীরা কলেজে চান না শিক্ষার্থীরা, বিক্ষোভের ডাক

জানা গেছে, গবেষণা তহবিল বণ্টনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে কয়েকটি সূচকের ভিত্তিতে তিনটি ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এই সূচকের মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা, গবেষণা প্রকাশনার পরিমাণ ও মানসহ একাধিক বিবেচ্য বিষয়। এই শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, ‘এ’ ক্যাটেগরিতে রাখা হয়েছে ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়, যারা মোট গবেষণা তহবিলের ৫৫ শতাংশ পাবে। ‘বি’ ক্যাটেগরিতে রয়েছে আরও ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়, যাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩০ শতাংশ। আর ‘সি’ ক্যাটেগরিতে রয়েছে বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যারা বাকি ১৫ শতাংশ তহবিল থেকে অংশ পাবে।

গবেষণা প্রস্তাব মূল্যায়নের সময় প্রতিটি ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের গ্রুপের মধ্যেই প্রতিযোগিতা করবে। অর্থাৎ, ‘এ’ ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা প্রস্তাব একে অপরের সাথে তুলনামূলকভাবে বিবেচিত হবে, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরির ক্ষেত্রেও তাই। এর ফলে তুলনামূলকভাবে ছোট বা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যও ন্যায্য প্রতিযোগিতার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই ক্যাটেগরি ভিত্তিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা একদিকে যেমন গবেষণার গুণগত মান নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে, অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্তরের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে গবেষণায় অধিকতর সক্রিয় হতে উদ্বুদ্ধ করবে।

‘আমরা প্রস্তাবগুলোর মূল্যায়ন প্রক্রিয়া অত্যন্ত স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, জবাবদিহিমূলক এবং গুণগত মাননির্ভর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করছি। এজন্য অভিজ্ঞ গবেষক, শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত পর্যালোচনা (রিভিউ) কমিটি নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী কাজ করছেন। আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে প্রকৃতপক্ষে যুগোপযোগী, প্রয়োগযোগ্য ও সমাজে প্রভাব ফেলতে সক্ষম গবেষণাগুলোকেই অর্থায়নের আওতায় আনা হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই উদ্যোগ বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাতকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে এবং দেশের সামগ্রিক জ্ঞান চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’ - প্রকল্প অধ্যাপক ড. আসাদুজ্জামান

বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘদিন ধরেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংকট একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে। প্রয়োজনীয় গবেষণা তহবিলের অভাবে বহু সম্ভাবনাময় ও সময়োপযোগী গবেষণা কার্যক্রম থমকে ছিল কিংবা শুরুই করা যায়নি। তাদের ধারণা, এ প্রকল্পের আওতায় নতুন বড় আকারের গবেষণা বরাদ্দ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা করবে। এতে শুধু গবেষণার পরিসরই বাড়বে না, বরং নতুন চিন্তা, উদ্ভাবন এবং বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান উৎপাদনের পথও উন্মুক্ত হবে। গবেষণায় অর্থায়নের এ ধারা যদি ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখা যায়, তাহলে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাত আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে সক্ষম হবে, এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও উদ্ভাবন দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও সমাজ উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখতে পারবে।

আরও পড়ুন: পল্লী বিদ্যুৎ কর্মীদের সারা দেশে কর্মবিরতির শুরু আজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু ইউসুফ বলেন, ‘এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। যেহেতু দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের দেশে গবেষণার জন্য বরাদ্দ সীমিত, তাই এই নতুন তহবিল গবেষণায় আগ্রহী শিক্ষক ও গবেষকদের জন্য এক অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তবে এ সুযোগের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রস্তাবিত গবেষণাগুলো হতে হবে মৌলিক, প্রাসঙ্গিক এবং এমন, যা বিদ্যমান জ্ঞানভান্ডারে বাস্তব অবদান রাখতে পারে। তবে বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং যেন জটিলতায় গবেষকরা না পড়েন, সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।’

জানতে চাইলে হায়ার এডুকেশন অ্যাকসেলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (হিট) প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক ড. আসাদুজ্জামান বলেন, ‌‌‘উচ্চশিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণাকে গতিশীল করার লক্ষ্যে হিট প্রকল্প একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার ক্ষেত্রে যে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা বিরাজ করছিল, আমরা এই প্রকল্পের মাধ্যমে তা কাটিয়ে ওঠার একটি সুসংগঠিত ও টেকসই কাঠামো গড়ে তুলতে কাজ করছি। গবেষণা ফান্ডের জন্য রেকর্ডসংখ্যক প্রস্তাব জমা পড়েছে—এটি আমাদের শিক্ষকদের গবেষণার প্রতি আগ্রহ ও সক্ষমতার প্রমাণ। রিসার্চ ফান্ডের জন্য প্রাপ্ত বিপুলসংখ্যক প্রস্তাবনা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা সম্ভাবনার ইতিবাচক প্রতিফলন।’

আরও পড়ুন: সাত কলেজের অন্তর্বর্তী প্রশাসনের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে আজ

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রস্তাবগুলোর মূল্যায়ন প্রক্রিয়া অত্যন্ত স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, জবাবদিহিমূলক এবং গুণগত মাননির্ভর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করছি। এজন্য অভিজ্ঞ গবেষক, শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত পর্যালোচনা (রিভিউ) কমিটি নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী কাজ করছেন। আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে প্রকৃতপক্ষে যুগোপযোগী, প্রয়োগযোগ্য ও সমাজে প্রভাব ফেলতে সক্ষম গবেষণাগুলোকেই অর্থায়নের আওতায় আনা হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই উদ্যোগ বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাতকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে এবং দেশের সামগ্রিক জ্ঞান চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’