বেহাল দশা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দুই প্রকল্পের
- ২৪ মে ২০২৫, ১৮:৪৯
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প—‘মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম’ এবং ‘দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসা স্থাপন ও পরিচালনা প্রকল্প’—বর্তমানে চরম অবহেলার শিকার। নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ উন্নয়নের লক্ষ্যে নেওয়া এই প্রকল্প দুটির মেয়াদ প্রায় পাঁচ মাস আগে শেষ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও কেয়ারটেকারদের অভিযোগ, সুষ্ঠু তদারকি ও প্রশাসনিক সমন্বয়ের অভাবে প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি সম্পূর্ণ থমকে গেছে। এতে করে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা ও অনিশ্চয়তা ক্রমেই বেড়ে চলছে। তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন জানায়, তারা প্রকল্পগুলো পুনরায় অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
এদিকে প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম চালু থাকলেও পুনরায় অনুমোদন না হওয়ায় গত পাঁচ মাস ধরে শিক্ষকদের কোনো বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়নি। ফলে শিক্ষক ও কর্মচারীরা পড়েছেন চরম আর্থিক সংকটে, করছেন মানবেতর জীবনযাপন। প্রতিনিয়তই তাদেরকে পরিবার-পরিজন নিয়ে চলতে হচ্ছে চরম কষ্টে, যা তাদের মানসিক চাপও বাড়িয়ে দিচ্ছে। অনেকেই পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবছেন, কেউ কেউ বাধ্য হয়ে খণ্ডকালীন অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন জীবিকা নির্বাহের জন্য। প্রকল্পগুলোর পরিচালকরা মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পরই অন্যত্র চলে গেছেন। এমন অবস্থায় নামকাওয়াস্তে প্রকল্প পরিচালক দিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। পরিচালকরা একসাথে ৭/৮টি দায়িত্ব পালনের কারণে প্রকল্পগুলোর সুষ্ঠু তদারকি করতে পারছেন না বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
আরও পড়ুন: নির্বাচনী চাপের মুখে ইউনূসের পদত্যাগের হুমকি
জানা গেছে, প্রকল্প দুটি নতুন করে অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে, তবে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘসূত্রতা থাকায় প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় রংপুরের একটি মসজিদে পাঠদান করেন সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন ‘আমরা ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার জন্য মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু পাঁচ মাস ধরে এক টাকাও পাইনি। পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি। কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার আবেদন জানিয়েছি, কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। গত ১৯ আগস্ট অন্তবর্তীকালীন সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা প্রকল্পের বিদ্যমান জনবলকে রাজস্বখাতে স্থানান্তরের আশ্বাস দেন। কিন্তু সেই আশ্বাসের কোন অগ্রগতি নেই।’
তিনি আরও জানান, ‘গত ঈদুল ফিতরেও প্রকল্পের শিক্ষক, কোয়ারটেকাগণ বেতন-ভাতা পাননি। বেতন ভাতা না পেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে সবাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পবিত্র ঈদুল আজহার পূর্বে বেতন-ভাতা প্রদান করা না হলে সারাদেশে সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন হবে বলে মনে করেন তারা।’
আরও পড়ুন: রাবির ‘এ’ ও ‘সি’ ইউনিটে ভর্তির বিষয় পছন্দক্রম পূরণ শুরু সোমবার
দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসা স্থাপন ও পরিচালনা প্রকল্পের শিক্ষকদের সংগঠন ‘দারুল আরকাম শিক্ষক কল্যাণ সমিতি’র সভাপতি মো. জয়নুল আবেদিন বলেন, “২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে তারও আগে, গত জুন মাসেই নতুন প্রকল্প প্রস্তাবনা জমা দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এখনও সেই প্রকল্প অনুমোদন পায়নি। গত ঈদেও আমরা বেতন-বোনাস পাইনি। সামনে কোরবানির ঈদ, অথচ এখনো পর্যন্ত বেতন-ভাতা দেওয়ার কোনও নির্দিষ্ট তারিখ জানানো হয়নি। শিক্ষক ও অফিস সহায়ক কর্মীরা চরম আর্থিক সংকটে দিন পার করছেন। তাই আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানাই, আসন্ন ঈদের আগেই যেন বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়।”
তিনি আরও বলেন, “২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরো এক বছরের বেতন-ভাতা আমরা পাইনি। সেটি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আমরা সেই পাওনা পরিশোধের দাবি জানাই। শিক্ষকরা যেন ন্যূনতম মর্যাদা নিয়ে জীবনযাপন করতে পারেন, সে বিষয়েও কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”
শুধু শিক্ষক ও কর্মচারীদের জীবনেই নয়, এর প্রভাব পড়ছে শিশু শিক্ষার্থীদের ওপরও। নিয়মিত পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে, শিক্ষকেরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন, পাঠাগার ও অন্যান্য শিক্ষাসামগ্রী ব্যবস্থাপনাও ভেঙে পড়ছে। এতে প্রকল্পের মূল লক্ষ্য—শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা—প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পটি ১৯৯৩ সালে প্রাথমিকভাবে একটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে শুরু হয়। উদ্দেশ্য ছিল—প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি ঝরেপড়া শিশু ও নিরক্ষর বয়স্কদের মসজিদভিত্তিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা এবং ইমাম ও আলেমদের সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে সম্পৃক্ত করা। ধারাবাহিকভাবে এ প্রকল্পের ছয়টি পর্যায় সম্পন্ন হয়েছে এবং ৭ম পর্যায় ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়।
আরও পড়ুন: দিল্লির প্রেসক্রিপশনে আওয়ামী লীগকে আর রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না: ইনকিলাব মঞ্চ
প্রকল্পের আওতায় প্রাক-প্রাথমিক, বয়স্ক ও সহজ কুরআন শিক্ষা—এই তিন স্তরে মোট ১ কোটি ২১ লাখ ৫১ হাজার জনকে শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে। শুধুমাত্র ২০২০ ও ২০২১ শিক্ষাবর্ষেই ৪৮ লাখ ৬০ হাজার ৪০০ জন এবং ২০২২ সালে ২৪ লাখ ৩০ হাজার ২০০ জনকে শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়াও সারাদেশে ৫৫০টি মডেল ও ১৫০০টি সাধারণ রিসোর্স সেন্টারসহ মোট ২০৫০টি রিসোর্স সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে।
৭ম পর্যায়ের এ প্রকল্পে ৩১২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৮ হাজার ৮০০টি প্রাক-প্রাথমিক কেন্দ্র, ৭৬৮টি বয়স্ক কুরআন শিক্ষা কেন্দ্র এবং ৪৪ হাজার ২০০টি সহজ কুরআন শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক শিশুদের পাশাপাশি বয়স্ক, ঝরেপড়া এবং স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের কুরআন শিক্ষাসহ সাধারণ শিক্ষা প্রদান করা হয়। শিক্ষার্থী ভর্তির হার বাড়ানোর পাশাপাশি ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক সচেতনতা তৈরিতেও প্রকল্পটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
অন্যদিকে, ‘দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদ্রাসা স্থাপন ও পরিচালনা’ শীর্ষক প্রকল্পটি একনেক সভায় ২০২২ সালের ১ জুন অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১৯০৯ কোটি ৬ লাখ টাকা।
এ ধরনের প্রকল্পের নির্ধারিত তারিখ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে তারা বাজেট প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকায় এখনো সুনির্দিষ্ট তারিখ জানানো সম্ভব হয়নি। তারপরও আমরা তাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছি। তারা আশ্বাস দিয়েছেন, আজ বিকেল বা আগামীকাল (রবিবার) নাগাদ তারিখ জানাতে পারবেন। দারুল আরকাম প্রকল্পটি এখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, আর গণশিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় চালুর প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। একনেকে অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু করা যাবে।
-ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আ. ছালাম খান।
এ প্রকল্পের আওতায় দেশের সকল উপজেলায় অবকাঠামোগত ব্যয় ছাড়াই ১ হাজার ১০টি দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। এখানে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ জন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা হয়। পাশাপাশি ২ হাজার ২০ জন শিক্ষক ও ১ হাজার ১০ জন সহায়ক কর্মী—মোট ৩ হাজার ৩০ জন আলেম ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হয়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ প্রকল্পের জন্য সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার ২১৪ লক্ষ টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩ হাজার ৩০০ লক্ষ টাকা। প্রকল্পটি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়ে গেছে। পরবর্তী মেয়াদে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চার বছরের জন্য নতুন করে প্রকল্প অনুমোদনের প্রস্তাব ধর্ম মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।
বর্তমানে এই দুটি প্রকল্পই নতুন করে একনেক অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ফলে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন বন্ধ রয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, গণশিক্ষা কার্যক্রম এর ফাইল ইতোমধ্যে একনেকে উঠেছে, অনুমোদন হলে অচিরেই কার্যক্রম পুনরায় চালু হবে। তবে দারুল আরকাম প্রকল্পটির ফাইল এখনও একনেকে উপস্থাপন হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তারিখ নির্ধারণের অপেক্ষায় রয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন: মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে সহায়তা দিচ্ছে সরকার, সময় বাড়ল আবেদনের
মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ার বলেন, ‘গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। প্রকল্পটি পুনরায় পাসের প্রক্রিয়া চলমান। এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, ধর্ম মন্ত্রণালয়, ও অর্থ মন্ত্রণালয় একসাথে কাজ করছে। আশা করছি, খুব শীঘ্রই প্রকল্পটি পাস হবে, তখন বকেয়া বেতনসহ যাবতীয় সুবিধাদি তারা পেয়ে যাবেন।’
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আ. ছালাম খান বলেন, “প্রকল্পগুলো নিয়ে কাজ চলছে, আমরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। আজ একনেক বৈঠকে গণশিক্ষা কার্যক্রমের একটি প্রকল্পের ফাইল উপস্থাপন করা হয়েছে, বৈঠক এখনো চলছে। যদি অনুমোদন পায়, তাহলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। তবে দারুল আরকাম প্রকল্পের ফাইল এখনো বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়নি। ফাইল ওঠার পরই জানা যাবে, কবে সেটি অনুমোদনের জন্য আলোচনায় আসবে।”
তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের প্রকল্পের নির্ধারিত তারিখ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে তারা বাজেট প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকায় এখনো সুনির্দিষ্ট তারিখ জানানো সম্ভব হয়নি। তারপরও আমরা তাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছি। তারা আশ্বাস দিয়েছেন, আজ বিকেল বা আগামীকাল (রবিবার) নাগাদ তারিখ জানাতে পারবেন। দারুল আরকাম প্রকল্পটি এখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, আর গণশিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় চালুর প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। একনেকে অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু করা যাবে।”