বাংলা ভাষা লেখায় দুর্বলতা কেন?
বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যত্নের অভাব এবং উদাসীনতা নিয়ে ভাষাবিদদের মনে আক্ষেপ দিনকে দিন যেন বেড়েই চলছে। তাদের কথা হচ্ছে, বাংলা ভাষা লেখার ক্ষেত্রে বানান এবং বাক্য গঠনের দুর্বলতা এখন বেশ চোখে পড়ছে। কিন্তু এনিয়ে অনেকের মধ্যে তেমন কোন চিন্তা-ভাবনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
স্কুল জীবনের শুরু থেকেই বিষয় হিসেবে বাংলা পড়ানো হলেও বাংলা লেখার ক্ষেত্রে এই দুর্বলতা কেন? এর জন্য কি শিক্ষা ব্যবস্থা দায়ী, নাকি অন্যকিছু? এসব প্রশ্ন অনেকেরই মনে রয়েছে। স্কুলে বাংলা বিষয়ে ভালো নম্বর পেলে শিক্ষার্থীদের ভাগ্যে প্রশংসা খুব একটা জোটে না, যতটা হয় ইংরেজির ক্ষেত্রে।
স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে সানজিদা শারমিন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, পরিবার কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- কোথাও বাংলার তেমন একটা গুরুত্ব নেই।
"বাবা-মা এবং শিক্ষকরা বলেন, তুমি যদি ইংরেজিতে ভালো করো তাহলে তোমার ফিউচার ভালো হবে। ইংরেজিতে যখন নম্বর বেশি পেতাম, তখন খুব প্রশংসা হতো। কিন্তু বাংলায় কত নম্বর পেয়েছি কেউ কিন্তু কখনও জিজ্ঞেসও করতো না," বলেন সানজিদা শারমিন।
আরও পড়ুন: আরবি হরফে বাংলা লেখা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিলো যেভাবে
মিস সানজিদার কথা অনেকাংশেই সত্যি মনে করেন রংপুরের একটি স্কুলের শিক্ষক আশরাফ আলী। তিনি বলছিলেন, বাংলা নিয়ে কেউ ভাবে না। তাই এটি শেখা এবং শেখানোর প্রতিও যত্নের অভাব রয়েছে। যার নেতিবাচক ফলাফল দেখা যায় লেখার ক্ষেত্রে।
মি. আলী বলেন, "অবস্থাটা এরকম পর্যায়ে চলে গেছে যে ইংরেজি বলতে পারলে আমরা সেটাকে মেধা যাচাইয়ের মাধ্যম ধরে নিই। বাংলা ভাষার চর্চা করলে, বাংলা ভাষায় পড়াশোনা করলে পরিস্থিতির সাথে আমি মিলিয়ে চলতে পারবো না- এরকম মনে করা হয়।"
ভাষাবিদরা মনে করেন, বাংলা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা একটি বিষয়। ভাষা লেখার ক্ষেত্রে দুর্বলতার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পাঠ্যক্রম। যেভাবে স্কুলে বাংলা পড়ানো হচ্ছে, সেটিও শুধু পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাবার জন্য। এতে প্রকৃত অর্থে ভাষা কতটা শেখা যাচ্ছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর বলেন, ভাষা শেখা নয়, পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। "লক্ষ্য যেখানে এ-প্লাস, অতএব সে নিজেকে সেভাবে তৈরি করে," বলেন অধ্যাপক শেখর।
আরও পড়ুন: ভাষাশহীদদের সম্মানে ৫২ কিলোমিটার দৌড়ালেন ১০ যুবক
বাংলা লেখার সময় অনেকের মধ্যে বিভিন্ন শব্দের বানান নিয়ে এক ধরনের দ্বিধা দেখা যায়। কয়েক বছর আগে বাংলা একাডেমির প্রকাশিত বানান অভিধানে অনেক শব্দের বানান দেখা যাচ্ছে , যেগুলোর সাথে পাঠ্যবইয়ের বানানের মিল নেই।
শিক্ষার্থী সানজিদা শারমিন বলেন, "রিসেন্টলি বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবার সময় আমি জানতে পারি যে বাংলা একাডেমি কিছু বানান পরিবর্তন করেছে। ছোটবেলা থেকে আমরা যা শিখে এসেছি এই বানানগুলো তার সাথে যাচ্ছে না।"
ভাষাবিদরা বলছেন, বাংলা ভাষায় বানানের বিষয়টি নতুন নয়। এই বানানরীতি অনেক পুরনো। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কোন প্রচারণা বা আলোচনা না থাকায় বানান নিয়ে অনেকের মধ্যে দ্বিধা তৈরি হয়েছে বলে মনে করে অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর।
"আমরা আমাদের প্রকৃত সংস্কার প্রচার করি না, জনসমক্ষে নিয়ে আসি না। এটি ১৯৩৬ সালে করা। কিন্তু এতদিন এটি জনসমক্ষে নিয়ে আসা হয়নি। নিয়ে আসবার জন্য যে প্রস্তুতি এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে সবাইকে জাগরিত করা, এই বিষয়গুলো একেবারে নেই," বলেন অধ্যাপক শেখর।
ভাষাবিদরা মনে করেন, বাংলা ভাষার শুদ্ধ রূপ বজায় রাখতে হলে ভাষা শেখানো এবং শেখার প্রতি যত্ন যেমন থাকতে হবে, তেমনি আগ্রহও প্রয়োজন। যার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র: বিবিসি বাংলা