দু-বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চান আলমগীর
সম্প্রতী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্টার ভাইরাল হয়েছে তাতে লিখা ছিলো- শুধুমাত্র দু-বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই। টিউশনি খুঁজতে এমন একটি পোস্টার লাগিয়েছেন বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থী মো. আলমগীর কবির। একজন বেকারের চাকরির জন্য অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে এই পোস্টারে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন আলমগীর। জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে কৃষক পরিবারে তার জন্ম। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। অনেক আগে পড়ালেখা শেষ করেও কপালে কোন চাকরি জুটেনি। বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
আলমগীর কবির তার পোস্টারে লিখেছেন, ‘শুধুমাত্র দু-বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই।’ সকাল ও দুপুরের খাবারের বিনিময়ে তিনি পড়াবেন। এ ছাড়া তিনি লিখেছেন, প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত গণিত ব্যতীত সবকিছুই পড়াবেন। সেই পোস্টারে নিজের পেশা হিসেবে লিখেছেন ‘বেকার’। এতে তার নাম ও মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে।
আরও পড়ুন: ফেনী কলেজ ছাত্রলীগের প্রথম নারী সম্পাদক রাত্রী
নিজের পোস্টারটি সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রয়োজনের তাগিদে এই পোস্টার লিখতে বাধ্য হয়েছে। অনেকদিন টিউশনি খুঁজেও পাচ্ছিনা। বন্ধুদের বললে তারা ম্যানেজ করে দিতে পারছেনা। একটা টিউশনি পেয়েছি দেড় হাজার টাকা বেতন। কিন্তু এই টাকা দিয়ে চলা সম্ভবনা। পরিবারের অবস্থা ভালোনা তাদের কাছেও চাওয়ার মুখ নেই।
চাকরির পরীক্ষা দিতে মাঝে মাঝে ঢাকা যেতে হয়। আমার কিছু জমানো টাকা ছিল, যা দিয়ে বেশ কয়েকবার ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। এখন ধার-দেনা করে চলছি। অনেক ঋণের মধ্যে আছি আমি। গত মাসে একাধিকবার (বিভিন্ন চাকরি পরীক্ষার) ভাইভা দিতে ঢাকায় যেতে হয়েছে। অনেক টাকা খরচ হয়েছে।
আরও পড়ুন: মার্চ-এপ্রিলে কমবে সংক্রমণ, সর্দিই মূল কারণ: ড. বিজন
দুই বেলা ভাতের বিনিময়ে যিনি পড়াতে চান, সেই আলমগীর থাকতেন মেসে। কিন্তু চলতে কষ্ট হচ্ছিল। মেসে থাকা-খাওয়ার জন্য তো অনেক টাকা দরকার। তিনি তখন চাকরির কোচিং করতেন। তার সঙ্গে একটি মেয়ে পড়তেন। কবির সেই মেয়েকে তাদের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন। মেয়েটি তার বাবার সঙ্গে কথা বললে তিনি কবিরকে থাকার জায়গা দেন। সেখানেই এখন থাকেন তিনি। তাই মাথার ওপর একটা ছাদ থাকলেও তিন বেলা খাবারের সংস্থান নেই তার। এ জন্যই তার এই বিজ্ঞাপন।
একটা চাকরির জন্য বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে টাকা জোগাড় করে আলমগীর কবির ছুটে বেড়ান এদিক-ওদিক। সরকারি চাকরির বয়স চলে গেছে করোনার শুরুর বছরই। সরকারি চাকরি হলো না। বেসরকারি চাকরিই ভরসা এখন। কিন্তু সেখানেও তদবির ছাড়া কোন কাজ হয়না।
আলমগীর কবির বলেন, আমি যেখানে টিউশনি করাই, সেখানে রাতে নাশতা দিত। আমি তাদের বলেছিলাম, রাতে নাশতা না দিয়ে একটু ভাত দিতে; তাহলে আমার রাতে খাবারের চিন্তাটা থাকবে না। তো রাতের খাবারের ব্যবস্থা তো হলোই। এখন চিন্তা ছিল সকাল ও দুপুরের খাবারের। যেহেতু টিউশনি পাচ্ছি না। আর দেড় হাজার টাকায় নিজের হাত খরচ ও সকাল-দুপুরের খাবার জোগাড় সম্ভব না। আমি অনেক দিন না খেয়েও থেকেছি। রাতে গিয়ে ছাত্রের বাসায় খেয়েছি।’
আরও পড়ুন: চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎ ছাড়াই শেষ হলো ১৬তম প্রার্থীদের মানববন্ধন
এই কঠিন বাস্তবতার কথা বলতে গলা ধরে আসছিল আলমগীর কবিরের। তিনি বলেন, ‘উপায় না পেয়ে আমি দুই বেলা খাবারের বিনিময়ে টিউশনি করার সিদ্ধান্ত নিই। এর পর এই পোস্টার লাগাই। আমি পোস্টার বেশি লাগাইনি। যেখানে থাকি, সেই গলিতে ৮-১০টা পোস্টার লাগিয়েছি, যাতে বাসার পাশে এক-দুইটা বাচ্চাকে পড়াতে পারি। আমার দুবেলা খাবারও হবে, আর যে টাকা পাব তাতে কোনোমতে হাতখরচ হবে।’
আলমগীর কবির বলেন, ‘আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আর পারছি না। বেকারত্ব যে কত কষ্টের, তা বলে বোঝাতে পারব না। এই বয়সে বাবার কাছ থেকে টাকা চাইতেও লজ্জা করে। আর পরিবারের যে অবস্থা, আমাকে কিছু দিতেও পারবে না তারা।’ নিজের উদাহরণ টেনেই তিনি বলেন, ‘একজন কবির সারা দেশের বেকারদের প্রতিচ্ছবি। আমাকে তো বাঁচতে হবে।’
পোস্টারের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই তাকে ফোন দিয়েছেন, সহায়তা করতে চেয়েছেন। কিন্তু কারো করুণা চাননা সে। নিজের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হতে চায়।