বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পাঠ্যবইয়ে বিকৃত করেছে পাকিস্তান

  © ফাইল ফটো

‘‘বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার নামে একটা নাটক করে সফল হন। পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি ছিল বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে এক গোপন চুক্তির ফল।’’

পাকিস্তানে সরকারের অনুমোদিত ‘পাকিস্তান স্টাডিজ’ নামে এক পাঠ্যপুস্তকে এভাবেই লেখা আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস। এই বইতে পূর্ব পাকিস্তান যে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তার জন্য অনেক আভ্যন্তরীণ এবং বাইরের কারণকে দায়ী করা হয়।

বাংলাদেশের জন্মের পর ৫০ বছর হয়ে গেছে, কিন্তু পাকিস্তান যেন বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সেই দাবি এখনো ওঠে।

বাংলাদেশের তরফ থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু পাকিস্তান বারে বারে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের পাঠ্যক্রমে কি বাংলাদেশের এসব অভিযোগ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কোন উল্লেখ আছে?

বাংলাদেশ, বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, যাকে পাকিস্তানের ডান হাত বলে মনে করা হতো, তা যে আলাদা হয়ে গেল, কীভাবে তা পাকিস্তানের স্কুল পাঠ্যপুস্তকে উপস্থাপন করা হয়?

পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হলো যেসব কারণে

পাকিস্তানে বাংলাদেশের জন্ম সম্পর্কে স্কুল শিক্ষার্থীরা প্রথম জানার সুযোগ পায় নবম শ্রেণীতে উঠে, যখন তাদের বয়স ১৫ বা ১৬। সরকারিভাবে স্কুলে যেসব পাঠ্যবই পড়ানো হয়, সেখানে খুবই অস্পষ্টভাবে ১৯৭১ সালের ঘটনাবলী তুলে ধরা হয়। এই বিবরণ দুই বা তিন পৃষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ, খুব বিস্তারিত কিছু সেখানে নেই।

তবে এর বিপরীতে বেসরকারি স্কুলগুলোতে ‘ও লেভেলে’ পাকিস্তান স্টাডিজ বলে যে বই পড়ানো হয়, সেখানে পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিম অংশের মধ্যে যেসব অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল, তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। তবে সরকারি বা বেসরকারি স্কুল- উভয় ক্ষেত্রেই পাঠ্যক্রমে একটা বিষয় অভিন্ন- তা হলো সেখানে বাংলাদেশের তোলা অভিযোগগুলো মোটামুটি উপেক্ষিত।

অনেকসময় পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ১৪টি কারণ উল্লেখ করা হয়, অনেক সময় উল্লেখ করা হয় নয়টি কারণ। পাকিস্তানের ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে এসব ছোটখাটো পরিবর্তন চলছে অনেক বছর ধরে, নানা সরকার আর নানা রাজনৈতিক জমানায়।

এসব কারণ ব্যাখ্যা করার সময় ভারতকে যে কেবল শত্রু-রাষ্ট্র বলে বর্ণনা করা হয়, তাই শুধু নয়, ‘বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে’ পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য ভারতকেই আসল অপরাধী বলে দোষ দেয়া হয়।

ধর্মীয় পরিচয়

পাকিস্তানের একজন শিক্ষাবিদ প্রফেসর এ এইচ নাইয়ার বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই সরকারের লোকজন মনে করেছিল পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানকে একমাত্র ধর্মই এক রাখতে পারে। কাজেই তারা ''এমনভাবে ইতিহাস শিখিয়েছে যাতে করে একটা ধর্মীয় পরিচয় তৈরি করা যায়।

পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার আরেকটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় কিভাবে ''তরুণ বাঙালিদের মন বিষিয়ে তুলতে হিন্দু শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।" এতে আরও বলা হয়, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে’ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর পর আর কোন ‘দেশপ্রেমিক’ নেতা তৈরি হয়নি, সেটাও পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার একটা কারণ।

বাংলাদেশ সৃষ্টির পূর্বে বাঙ্গালিদের পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ কীভাবে দেখতো সেকথা উল্লেখ করে প্রফেসর নাইয়ার বলেন, ‘আমাদের চোখে বাঙালিরা ছিল এক অভুক্ত, পাঁচ ফুট উচ্চতার দুর্বল জাতি। আর আমরা হচ্ছি উঁচু জাতের মানুষ। কাজেই এক ধরণের হেয় চোখে দেখা হতো তাদের।’

ছাত্রদের ওপর প্রভাব

১৯৯০ দশকে নামকরা পাকিস্তানি লেখক এবং ইতিহাসবিদ খুরশিদ কামাল আজিজের (কে কে আজিজ) একটি বই প্রকাশিত হয়, যার নাম ‘দ্য মার্ডার অব হিস্ট্রি।’ এটিতে পাকিস্তানে ইতিহাসের যেসব পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হয় সেগুলোর সমালোচনা করা হয়েছিল।

কে কে আজিজের মতে, পাকিস্তানের ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক পড়ে পাকিস্তানি ছেলে-মেয়েরা বাংলাদেশ কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে কেবল দুই ধরণের ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠছে।

প্রথমটি হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তান ছিল সমস্যায় জর্জরিত, আর স্বভাবগত ভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি অবিশ্বস্ত। কাজেই বাংলাদেশের জন্ম পাকিস্তানের জন্য ভালোই হয়েছে। অথবা বাংলাদেশের আলাদা হওয়ার বিষয়টিকে অতীতের একেবারেই অগুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করে তারা।

কে কে আজিজের মতে, এটি ছিল ১৯৭১ সালের আগে কি ঘটেছে সে সম্পর্কে ছাত্রদের অন্ধকারে রাখার জন্য একেবারেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি চেষ্টা।

ছাত্রদের ওপর এর কি প্রভাব পড়েছে সে ব্যাপারে প্রফেসর নাইয়ারও কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের সরকার যা চেয়েছিল. তাই আসলে ঘটছে। এসব ছেলে-মেয়ের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে ভারত হচ্ছে শত্রু আর পাকিস্তান এখানে নিপীড়নের শিকার।

এরকম ইতিহাস শিখিয়ে পাকিস্তানের কি লাভ হয়েছে?

এ প্রশ্নের উত্তরে পাকিস্তানের একজন কলামিস্ট এবং শিক্ষাবিদ আসিম সাজ্জাদ আকতার বলেন, ‘আপনি যদি এমন কিছু চিন্তা-দাস তৈরি করতে চান যারা আপনার সব কথায় হ্যাঁ বলবে, যুদ্ধের হুংকার দিয়ে কথা বলবে এবং আপনাকে হাততালি দেবে, তাহলে হয়তো একটা লাভ আছে। কিন্তু আপনি যদি চান সমাজে এমন কিছু মানুষ তৈরি করতে যারা শুধু সৃষ্টিশীলই নয়, যারা সমালোচনা করতেও সক্ষম, তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে আপনি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন।’

আসিম সাজ্জাদ বলেন, ‘এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কোন গবেষণার চেষ্টাকে বাধা দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় ভাষ্যকে যারা টিকিয়ে রাখতে চায়, তারা এক্ষেত্রে কোন রকমের পরিবর্তন দেখতে চায় না।’

পাকিস্তানই একা এই কাজ করছে না

বাংলাদেশের জন্মের ঘটনা পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং ভারত- এই তিন দেশে কীভাবে তুলে ধরা হয়? গবেষক আনাম জাকারিয়া এই তিন দেশে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন ১৯৭১ সালের ঘটনাবলী এই তিন দেশে কিভাবে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হয়।

আনাম জাকারিয়া বলেন, এই তিনটি দেশ থেকে ইতিহাসকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা সম্ভব। পাকিস্তানই কি একমাত্র দেশ, যারা ইতিহাসকে পাঠ্যক্রমে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে ধরছে?

এ প্রশ্নের উত্তরে আসিম সাজ্জাদ বলেন, প্রত্যেকটি দেশই চায় তাদের নাগরিকদের একটি সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে গড়ে তুলতে। কাজেই এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান একাই যে এই কাজ করছে তা নয়। কিন্তু একটা সফল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের যে বিবরণ পাকিস্তান তুলে ধরছে, সেটাকে তিনি খুবই হাস্যকর বলে বর্ণনা করেন।

আসিম সাজ্জাদ বলেন, এমনকি আজকের দিনেও আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের বলে যাচ্ছি যে পাকিস্তানের ৫৪ শতাংশ মানুষ, যারা এই পাকিস্তানেরই অংশ ছিলেন, তারা একটি বিদেশি ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছেন। আমার দৃষ্টিতে এটা একেবারেই হাস্যকর।

শিক্ষকদের ভূমিকা

প্রফেসর এ এইচ নাইয়ার এক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকার কথা প্রসঙ্গে বলেন, এরা নিজেরাই শৈশবে যা শিখেছেন, সেটাই তাদের মনে গেঁথে আছে। এরা যখন এমন ছাত্রদের মুখোমুখি হন, যাদের মনে অনেক প্রশ্ন এবং কৌতূহল, তখন এই শিক্ষকরাও পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত শ্লোগানেরই আশ্রয় নেন। এরপর আর সেখানে কোন আলোচনার সুযোগ থাকে না।

তাঁর মতে, খুব কম শিক্ষকই খুঁজে পাওয়া যাবে যারা যুক্তির ভিত্তিতে এসব নিয়ে আলোচনা করেন।

একজন শিক্ষক হিসেবে আনাম জাকারিয়া ভারত এবং পাকিস্তানের শ্রেণিকক্ষগুলোতে গেছেন এবং এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, শিশুদের যে-ধরণের ইতিহাস শেখানো হচ্ছে তার ফলে সমাজে ঘৃণা এবং অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।

তার মতে, ১৯৭১ সালে এই তিন দেশের ভূমিকা কি ছিল সেটা শিক্ষার্থীদের জানতে দিলে কোন ক্ষতি নেই, বরং এতে বিরাট উপকার হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক কবি, সৈনিক, রাজনৈতিক কর্মী এবং নারীবাদী কর্মী যে তখন সামরিক অভিযানের বিরোধিতা করেছিলেন এরকম অনেক ঘটনার কথাও আমি শুনেছি। এগুলো অনেক অনুপ্রেরণামূলক কাহিনি এবং আমি আসলে তাদের কাহিনি শুনতে চাই। [সূত্র: বিবিসি বাংলা]


সর্বশেষ সংবাদ