চার অধ্যাপকের ৩ জনেরই মৃত্যু এক মাসে, আশার প্রদীপ রফিক স্যার
- ইলিয়াস শান্ত
- প্রকাশ: ১৪ মে ২০২০, ১০:৪৫ PM , আপডেট: ১৫ মে ২০২০, ১২:২৪ AM
জাতীয় অধ্যাপক। পদবীর শুরুটা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৭ মার্চ; শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, শিক্ষকদের শিক্ষক অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ও পরিসংখ্যানবিদ কাজী মোতাহার হোসেনকে দিয়ে। এরপর বেশ কয়েকদফা তথা ১৯৮৪, ১৯৮৭ ও ১৯৯৩ সালে এই নিয়োগ সম্পন্ন হলেও প্রথম নারী হিসেবে জাতীয় অধ্যাপক হন সুফিয়া আহমেদ, ১৯৯৪ সালে। এরপর এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার গতি মন্থর হলেও থেমে থাকেনি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জাতীয় অধ্যাপক নির্ধারণ কমিটির হাত ধরে সর্বশেষ এই নিয়োগ হয় ২০১৮ সালের ১৯ জুন। এদিন নিয়োগ পান প্রবীণ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। সে সময় এই তিনজনকে নিয়ে জাতীয় অধ্যাপকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ জনে। তবে নতুন খবর হলো- এই চার অধ্যাপকের তিনজনই প্রায় এক মাসের ব্যবধানে চলে গেলেন। একমাত্র আলোর প্রদীপ হয়ে রইলেন দেশের প্রথম নজরুল গবেষক প্রবীণ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
একটি তথ্যে জানা যায়, জাতীয় অধ্যাপক মূলত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি নির্ধারণ নিয়োগ দিয়ে থাকে। কমিটির সদস্য হিসেবে থাকেন শিক্ষামন্ত্রী, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দুই জন সাবেক জাতীয় অধ্যাপক। কিন্তু পরপর তিন অধ্যাপক চলে যাওয়ায় নতুন জাতীয় অধ্যাপক নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্ধারিত কমিটিও পূর্ণতা পাবে না। তথ্যমতে, সাধারণত শিক্ষামন্ত্রী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এই কমিটির সিদ্ধান্ত ও মনোনয়ন অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি এই নিয়োগ সম্পন্ন করেন।
অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ: ১৯৯৪ সালে ভাষা সৈনিক ও জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ মারা যান গত ৯ এপ্রিল। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর প্রায় একমাস রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। যদিও মৃত্যুর দিন তিনি হার্ট অ্যাটাক করেন বলে পরিবার সূত্র জানায়।
সুফিয়া আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তার স্বামী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। বাবা বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ম ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি)।
জীবনী থেকে জানা যায়, ১৯৩২ সালের ২০ নভেম্বর ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন সুফিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ও কারফিউ অমান্য করা নারী ভাষা সৈনিকদের মধ্যে সুফিয়া ছিলেন অন্যতম। ৬০-এর দশকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০০২ সালে একুশে পদক ও ২০১৫ সালে সুফিয়া কামাল পদক লাভ করেন এই কৃতী শিক্ষক।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী: জামিলুর রেজা চৌধুরী একাধারে গবেষক, শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁর বাবা আর ভাইসহ তার পরিবারের অনেক সদস্যই প্রকৌশলী ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, স্বাধীনতার পর এ দেশে যত বড় বড় ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির সঙ্গেই জামিলুর রেজা চৌধুরী কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিলেন। যুক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে। হাত দেন পদ্মা সেতু নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞে।
জামিলুর রেজা চৌধুরী একসময় যুক্তরাষ্ট্রে কাজের ডাক পেয়েছিলেন বিখ্যাত আরেক বাংলাদেশি প্রকৌশলী এফ আর খানের কাছ থেকে। একসময় বুয়েটে অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। দায়িত্ব পেয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও। উপাচার্য ছিলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির।
সর্বশেষ ১৪ মে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ২৭ এপ্রিল ৮৩ বছর বয়সী এই অধ্যাপককে রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আনিসুজ্জামনকে। ৯ মে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে। তিনি চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। বর্তমানে বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
আশার একমাত্র প্রদীপ রফিকুল ইসলাম: ১৯৩৪ সালে জন্ম নেওয়া রফিকুল ইসলাম দেশের প্রথম নজরুল গবেষক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক ও অত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নজরুল-গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক। স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কার রয়েছে তার ঝুলিতে। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে পুরস্কৃত করে। ২০০৩ সালে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর’ বই লিখে লেখক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান।
সাহিত্য চর্চা ও গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রেও অসাধারণ অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশের “সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার” হিসাবে পরিচিত “স্বাধীনতা পুরস্কার” প্রদান করা হয় তাকে। এছাড়াও তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং নজরুল একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছেন। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের অধ্যাপক ইমেরিটাস ও বাংলা অধ্যয়ন কেন্দ্রের উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত রয়েছে।
প্রসঙ্গত, জাতীয় অধ্যাপক দেশের এম বিশেষ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা যা বাংলাদেশ সরকার কতৃর্ক শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণার জন্যে দেশের বিশিষ্ট পণ্ডিত, চিন্তাবিদ এবং শিক্ষকগণকে প্রদান করা হয়। সাধারণত পাঁচ বছর মেয়াদের জন্যে কোনো ব্যক্তি জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্তি পেয়ে থাকেন, তবে ক্ষেত্রবিশেষে দীর্ঘতর মেয়াদের জন্যেও পুনর্নিয়োগ দেয়া হয়। মেয়াদ না থাকলেও পদবী থেকে যায় আজীবন।