ধোঁয়ার কুন্ডুলি দেখতে গিয়ে শহীদ হয় ছায়াদ, পায়ের জুতা দেখে লাশ শনাক্ত

ছায়াদ মাহমুদ খান (১২)
ছায়াদ মাহমুদ খান (১২)  © সংগৃহীত

বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ির ছাদে খেলছিল ছোট্ট ছায়াদ। রাস্তায় ধোঁয়ার কুন্ডুলি দেখে খেলা ফেলে দেখতে গিয়েছিলো সে। তাই নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠেন বাবা-মা ও শিক্ষক। শেষ পর্যন্ত সে উৎকন্ঠাই সত্য হলো। প্রতিবেশীর মোবাইলে তোলা ছবিতে পায়ের জুতা দেখে মা-বাবা শনাক্ত করলেন ছেলের লাশ। 

সাভারের চাপাইন এলাকার জাবাল-ই-নূর দাখিল মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছায়াদ মাহমুদ খান (১২)। মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার ধল্লা, খানপাড়ার বাহাদুর খান (৪০) ও মা হালিমা আক্তার (৩৯)-এর একমাত্র ছেলে। সাভার পৌরসভার চাপাইন সড়কের শাহীবাগের আলমগীর মিয়ার বাড়ীর ভাড়াটিয়া। খান বাহাদুর দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবাসী। এ ঘটনার কিছুদিন আগেই  দেশে আসেন।  তিন ভাইবোনের মধ্যে ছায়াদ দ্বিতীয়। বড় বোন তাসলিমা খানম নাজনীন (২০) ও  ছোট বোন আফরোজা খানম নুসরাত (১০)। 

ছায়াদের মা হালিমা আক্তার বলেন, ২০ জুলাই আমার ছেলে বাসার ছাদেই তার বন্ধুদের সাথে খেলছিল। বাইরে হইহুল্লো আর গোলাগুলির শব্দ শুনে ছুটে যায় দেখার জন্য। কিছুক্ষণ পরই ওদের মাদ্রাসার শিক্ষক মো. ইব্রাহিম আমাকে ফোনে জানান, এখানে গোলাগুলি হচ্ছে, ছায়াদ কি বাসায় ফিরেছে? এর কিছুক্ষণ পর আবারও ওই শিক্ষক ফোনে জানতে চান, এখানে মাদ্রাসার এক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছে, ছায়াদ কি বাসায় ফিরেছে? তখন আমি ওর বাবাকে ছায়াদের বাসায় না ফেরার খবর জানাই। ওর বাবা বাসায় ফিরে আসেন। আমরা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করতে থাকি। এর কিছুক্ষণ পর মোবাইলে ছবি দেখে জানতে পারি ছায়াদ গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

আরও পড়ুন : এক কোটি ৭১ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন

ছায়াদের বাবা বাহাদুর খান বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালীন ২০ জুলাই ছায়াদের মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় বাড়িতেই ছিল সে। বাবা-ছেলে একসাথে বসে দুপুরের খাবার খেয়েছি। দুপুরের খাওয়া শেষে ছায়াদ ওর বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ির ছাদে যায় খেলতে। এর কিছুক্ষণ পর আমিও মেয়ের জন্য ওষুধ কিনতে বাড়ির বাইরে যাই। তখন সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ চলছিল। এসময় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের নিউমার্কেটের সামনের ওভার ব্রিজে ধোঁয়ার কুন্ডুলী দেখে তা দেখার জন্য বিকেল ৫টার দিকে বাড়ীর ছাদে খেলতে থাকা ছায়াদ নিচে নেমে নিউমার্কেটের সামনে চলে যায়। 

তিনি বলেন, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলে আমরা ছায়াদকে খুঁজতে শুরু করি। এসময় আমি স্থানীয় একটি মসজিদের সামনে দাঁড়াই যাতে ও নামাজ পড়তে গেলে বের হওয়ার সময় দেখতে পাই। এসময় বিভিন্নজনকে ছায়াদের কথা জিজ্ঞেস করে খোঁজ করতে থাকি। তখন এক ব্যক্তি তার মোবাইল ফোনে তোলা একটি ছেলের গুলিবিদ্ধ ছবি দেখায় যেখানে শুধু ওর পা আর পায়ের জুতো দেখা যাচ্ছিল। তখন আমি আর আমার স্ত্রী চিনতে পারি এটা আমাদের ছেলের জুতো। জানতে পারি ও গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তখন স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর নিয়ে পার্শ্ববর্তী শাহীবাগের প্রজন্ম স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে যাই। সেখান থেকে হাসপাতালের লোকজন আমাদের জানায়, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একটি ছেলেকে এখানে নিয়ে এসেছিল স্থানীয়রা। তবে অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে আমরা সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছি। তখন আমি এনাম হাসপাতালের পাশেই থাকা আমার ভাগ্নে নাহিদকে ছায়াদ মাহমুদের গুলিবিদ্ধের খবর দিয়ে ওর চিকিৎসার খোঁজ-খবর নিতে বলি। আমি আর আমার স্ত্রীও দ্রত এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যাই। হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পাই সেখানকার বারান্দায় আমার ছেলের নিথর দেহ পড়ে আছে। চিকিৎসক জানান, পায়ের উপরের অংশ গুলিবিদ্ধ হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে ছায়াদ মারা গেছে। 

একমাত্র ছেলের এমন মৃত্যুতে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন ছায়াদের বাবা-মা। ছায়াদের বাবা বাহাদুর খান শুধুই ছেলের স্মৃতিচারণ করতে করতে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন।

আরও পড়ুন : আন্দোলনে শহীদদের নামে স্টেডিয়ামের নামকরণ হবে: আসিফ মাহমুদ

হালিমা আক্তার বলেন, আমার ছেলেটি ছিল অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের। ফুটবল খেলার প্রতি ছিল ওর ঝোঁক। পড়াশোনায়ও ছিল অত্যন্ত ভালো। ছায়াদদের মৃত্যু কখনো বৃথা যেতে পারে না, সমাজ থেকে বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমেই ছায়াদরা জায়গা করে নেবে মানুষের অন্তরে।

জানা গেছে, জাবাল-ই-নূর মাদ্রাসা থেকে ছায়াদের পরিবারকে নগদ ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। এছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক বা সরকারি সহযোগিতা তারা পাননি। 


সর্বশেষ সংবাদ