যেভাবে ঈদ উদযাপন করতেন রাসুল (সা.) ও সাহাবিরা

ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। আর এ ঈদুল ফিতর হলো মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের একটি। বছরে দুবার ঈদ আসে। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আজ বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) দেশে উদযাপিত হচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর।

মহিমান্বিত দিনটির আনন্দ-উৎসবে ভিন্নমাত্রা যোগ করবে রাসুল (সা.)-এর ঈদের দিনের বিশেষ কিছু আমল। ঈদের দিনের এই আমল আমাদের ঈদ আনন্দ বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে ইনশাআল্লাহ। চলুন ঈদকে সত্যিকারার্থে আনন্দময় করে তুলতে ঈদ উপলক্ষ্যে রাসুল (সা.)-এর করা আমলগুলো জেনে নেওয়া যাক।

গোসল করা ও পবিত্রতা অর্জন করা

ঈদের নামাজের জন্য গোসল করা সুন্নাত। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে- ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- নবী (সা.) ঈদুল ফিতর ও আজহার দিন গোসল করতেন। (বোখারি : ১/১৩০)

মুয়াত্তা মালেকসহ অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে সহিহ সূত্রে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) ঈদের দিন ইদগাহে যাওয়ার আগে গোসল করতেন। (মুয়াত্তা, হাদিস : ৪২)

আরও পড়ুন: ঈদের নামাজ যেভাবে পড়বেন

নাফে হতে বর্ণিত আছে যে, আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) ঈদের দিন ইদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। (মুয়াত্তা মালেক, হাদিস : ৩৮৪)

আলবানি (রহ.) ‘ইরওয়াউল গালিল’ নামক গ্রন্থে ফারয়াবি সাঈদ ইবনুল মুসায়িব রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন- ঈদুল ফিতরের দিন তিনটি সুন্নাত। ১. হেঁটে ইদগাহে গমন করা ২. ইদগাহে যাওয়ার পূর্বে কোনো কিছু খাওয়া। ৩. গোসল করা।

সুন্দর ও উত্তম পোশাক পরিধান করা

মুসলমানদের প্রধান দুই ধর্মীয় উৎসব তথা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর ও সাধ‌্যের ভেতর সবচেয়ে উত্তম পোশাক পরিধান করা সুন্নত। উত্তম পোশাক বলতে আমরা অনেকে নতুন পোশাক বুঝে থাকি। কিন্তু উত্তম পোশাক বলতে পরিষ্কার ভালো পোশাক বুঝানো হয়ে থাকে।

জাফর ইবনু মুহাম্মদ তার পিতা থেকে, তার পিতা তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) প্রতিটি ঈদে সুন্দর পোশাক পরিধান করতেন। (সুনানে বায়হাকি, হাদিস : ৬৩৬৩)

ঈদগাহে যাওয়ার আগে পানাহার করা

ঈদুল ফিতরের দিন ইদগাহে যাওয়ার পূর্বে সামান্য কিছু পানাহার করা সুন্নত। তবে ঈদুল আজহার দিন পানাহার ব্যতীত ঈদগাহে গমন করা ও নামাজের পর নিজের কোরবানির গোশত দিয়ে প্রথম খাবার গ্রহণ করা সুন্নাত।

আনাস (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজি (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন সকালে কিছু খেজুর খেতেন। অন্য এক বর্ণনামতে, তিনি বেজোড় সংখ্যক খেজুর খেতেন। (বুখারি, হাদিস : ৯৫৩)

ঈদগাহে যাতায়াতের সময় তাকবির বলা

ঈদের দিন বেশি বেশি তাকবির পাঠ করে আল্লাহকে ডাকার মধ্যেই প্রকৃত আনন্দ। তাই ঈদগাহে যাতায়াতের সময় ঈদুল ফিতরের দিন তুলনামূলক নিম্বস্বরে তাকবির বলা আর ঈদুল আজহার দিন উচ্চস্বরে তাকবির পাঠ করা সুন্নত। তাকবির-اَللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَر لَا اِلَهَ اِلَّا اللهُ وَاللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَروَلِلهِ الْحَمْد  (উচ্চারণ : ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’)

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যাতে তোমরা গণনা পূরণ করো এবং তোমাদের হেদায়াত দান করার দরুন আল্লাহ তাআলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)

জুহরি থেকে বর্ণিত আছে যে, নবীজি (সা.) ঈদের দিন তাকবির পাঠ করতে করতে ঈদগাহের দিকে গমন করতেন এবং নামাজ পড়া অবধি এ তাকবির অব্যাহত রাখতেন। নামাজ শেষ হলে তাকবির পাঠ বন্ধ করে ফেলতেন। (সিলসিলাতুল আহাদিস আস সহিহাহ : ১৭১)

ঈদগাহে আসা-যাওয়ার রাস্তা পরিবর্তন করা

ঈদগাহে যাতায়াতের রাস্তা পরিবর্তন করা সুন্নাত। যাওয়ার সময় এক রাস্তা দিয়ে গমন করা আর প্রস্থানের সময় অন্য রাস্তা ব্যবহার করা সুন্নত।

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- নবীজি (সা.) ঈদের দিন ঈদগাহে আসা-যাওয়ার রাস্তা পরিবর্তন করতেন। (বুখারি, হাদিস : ৯৮৬)

হেঁটে ঈদগাহে গমন

কোনো ধরনের অপারগতা না থাকলে, হেঁটে ইদগাহে গমন করা সুন্নত। ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) হেঁটে ঈদগাহে গমন করতেন এবং হেঁটে ঈদগাহ থেকে প্রত্যাগমন করতেন। (তিরমিজি, হাদিস : ১২৯৫)

ঈদগাহে যেতে শিশু ও নারীদের সঙ্গে নেওয়া

আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) দুই ঈদের দিন ঈদগাহে যাওয়ার সময় ফজল ইবনু আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস, আব্বাস, আলি, জাফর, হাসান, হোসাইন, উসামা ইবনু জায়দ, জায়দ ইবনু হারিসা, আয়মান ইবনু উম্মু আয়মান (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে উচ্চস্বরে তাকবির ও তাহলিল পাঠ করতে করতে বের হতেন। অতঃপর তিনি কামারদের রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে উপস্থিত হতেন এবং প্রত্যাবর্তনের সময় মুচিদের রাস্তা দিয়ে ঘরে আসতেন। (সুনানে কুবরা বায়হাকি, হাদিস : ৬৩৪৯)

নারীদের ঈদগাহে যাওয়ার বিষয়ে হযরত উম্মে আতিয়্যাহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ঈদের দিন আমাদেরকে বের হওয়ার আদেশ দেয়া হতো, আমরা কুমারী মেয়েদের, এমনকি ঋতুবতী মহিলাদেরও ঘর থেকে বের করতাম। অতঃপর পুরুষদের পেছেনে থেকে তাদের তাকবিরের সাথে সাথে তাকবির পড়তাম এবং তাদের দোয়ার সাথে সাথে আমরাও ঐ দিনের বরকত ও পবিত্রতা লাভের দোয়া করতাম। (সহিহ বুখারি ৯৭১)

এ হাদিসটিসহ আরো অনেক হাদিসে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, ঋতুবতী মহিলারাও ঈদগাহে উপস্থিত হতেন। অথচ, শরিয়তে ঋতুবতী মহিলাদের জন্য নামাজ পড়া সম্পূর্ণ হারাম। সুতরাং, তাদের ঈদগাহে বা জামাতে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি যদি শুধুমাত্র নামাজের জন্য হতো, তবে ঋতুবতী মহিলারা ঈদগাহে উপস্থিত হতেন না।

ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা

ঈদের দিন একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে শুভেচ্ছা বিনিময় করা সুন্নত। হাদিস শরিফে এসেছে- জুবাইর ইবনু নুফাইর (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেন- নবীজী (সা.)-এর সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন পরস্পর সাক্ষাৎ হলে বলতেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়ামিন কুম’ আল্লাহ আমার এবং আপনার যাবতীয় ভালো কাজ কবুল করুক। (ফাতহুল কাদির, ২ খণ্ড, ৫১৭)

ঈদের খুতবা শোনা

ঈদের নামাজ শেষে খুতবা মনোযোগ সহকারে শোনা। হাদিসে এসেছে- আবদুল্লাহ ইবনু সায়িব থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে আমি ঈদগাহে উপস্থিত হলাম। এরপর তিনি আমাদের নামাজ পড়িয়েছেন। অতঃপর তিনি বলেন: “আমরা নামাজ শেষ করেছি। যার ইচ্ছা সে খুতবা শোনার জন্যে বসবে, আর যার চলে যাওয়ার ইচ্ছা, সে চলে যাবে।’ (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ১০৭৩)

ঈদগাহ থেকে ফিরে নফল আদায় করা

ঈদের নামাজের আগে-পরে ঈদের নামাজের স্থানে যে কোনো ধরনের নফল নামাজ আদায় করা মাকরুহ। ঈদের নামাজের পরে ঈদগাহ থেকে বাড়ি ফিরে দুই রাকাত নফল আদায় করা সুন্নত। হাদিসে এসেছে-

আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- নবী করিম (সা.) ঈদের নামাজের আগে কোনো নামাজ পড়তেন না। তবে নামাজের পর ঘরে ফিরে করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১২৯৩)

পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম। তবে জাকাতের মতো সে সময়ের আগে রমজান মাসেও তা আদায় করা যায়।

ঈদের দিনের এই আমলগুলো আমাদের ঈদ আনন্দ বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সবাই তাওফিক দান করুক। আমিন।


সর্বশেষ সংবাদ