সড়কে আহতদের ক্ষতিপূরণ বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে সংশয়

  © সংগৃহীত

সরকার ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তার যে বিধান যুক্ত করেছিল, তার আওতায় ক্ষতিপূরণ দেওয়া শুরু হচ্ছে। সূত্র জানিয়েছে, আগামী ২২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এককালীন সহায়তা দেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন বলে কথা রয়েছে। তবে সড়ক দূর্ঘটনায় আহতদের ক্ষতিপূরণ বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা । 

দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে তাঁর পরিবার পাঁচ লাখ টাকা এবং আহত ব্যক্তি সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারের উদ্যোগটি ভালো। তবে কিছু আশঙ্কা রয়েছে।

প্রথমত, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মতো যথেষ্ট টাকার সংস্থান নেই। ক্ষতিপূরণের জন্য প্রয়োজন হতে পারে বছরে অন্তত ৪০০ কোটি টাকা। জোগাড় হতে পারে ১৫০ কোটি টাকা। সরকারের কাছে এবারের বাজেটে (২০২৩-২৪) এককালীন ১০০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল। সরকার দেয়নি। দ্বিতীয়ত, দরিদ্র মানুষের পক্ষে আবেদন করে তার পেছনে লেগে থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়া কঠিন হতে পারে। তৃতীয়ত, শত শত মানুষের আবেদন পর্যালোচনা করার মতো জনবল ও সক্ষমতা রয়েছে কি না, সেটিও প্রশ্ন।

৩১০টি আবেদন

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে বিধিমালা জারি হয় গত ২৭ ডিসেম্বর। এরপর গত ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন জমা পড়েছে ৩১০টি। এর মধ্যে ৬৩টি আবেদনের অনুসন্ধানপ্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। নিহত ৩৮ জনের পরিবার ও আহত ২৫ জন ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য বলে প্রাথমিকভাবে ঠিক করা হয়েছে।

দেশে যে পরিমাণ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত হন, তাঁদের সবাইকে সহায়তা দেওয়ার মতো তহবিল নেই। কারণ, আইনে যে যে খাত থেকে অর্থ আসার কথা ছিল, তা পাওয়া যায়নি। এমনকি সরকারও কোনো টাকা দেয়নি। ফলে গুরুত্বপূর্ণ এই উদ্যোগ কোনো রকমে চালু হচ্ছে।

বিআরটিএর হিসাব বলছে, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৬৩৮ জন। আহত ৪ হাজার ৬৪৮ জন। এই হিসাবে বছরে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে লাগবে ২৩২ কোটি টাকা। আহত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ দিলে ব্যয় হবে প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা। এর সঙ্গে যোগ হবে ট্রাস্টের খরচ। সব মিলিয়ে বছরে ৪০০ কোটি টাকার বেশি লাগবে।

বেসরকারি হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০২২ সালে সড়কে মৃত্যু হয়েছে ৭ হাজার ৭১৩ জনের। আহত হয়েছেন সাড়ে ১২ হাজারের বেশি মানুষ। বেসরকারি হিসাব আমলে নিলে বছরে ক্ষতিপূরণের জন্য প্রয়োজন হতে পারে ৮০০ কোটি টাকার মতো।

কত টাকা উঠবে

সরকার এখন যে প্রক্রিয়ায় তহবিল গঠন করছে, তাতে বছরে দেড় শ কোটি টাকার মতো সংগ্রহ যেতে পারে। সড়ক পরিবহন আইনে ক্ষতিপূরণের জন্য গঠিত তহবিলের টাকা কোন কোন খাত থেকে আসবে, তার বিস্তারিত বলা হয়েছে। খাতগুলো হলো সরকারের দেওয়া অনুদান, মোটরযানের মালিকের কাছ থেকে তোলা চাঁদা, সড়ক পরিবহন আইনের মাধ্যমে আদায় করা জরিমানার অর্থ, মালিক সমিতি থেকে দেওয়া অনুদান, শ্রমিক সংগঠন বা শ্রমিক ফেডারেশন থেকে দেওয়া অনুদান, অন্য কোনো বৈধ উৎস থেকে পাওয়া অর্থ।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত শুধু যানবাহনের মালিকের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই খাত থেকে তহবিলে জমা হয়েছে ৯৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।

সরকার চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) প্রায় ৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য গঠিত তহবিলে কোনো টাকা বরাদ্দ দেয়নি। যদিও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ১০০ কোটি টাকা এককালীন চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিল।

সড়ক পরিবহন আইনে জরিমানা আদায় করে পুলিশ ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। সড়ক আইন মেনে এই টাকা পেতে গত ২০ মার্চ সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় ক্ষতিপূরণের তহবিল পরিচালনাকারী ট্রাস্টি বোর্ড; কিন্তু এখনো এই খাতের কোনো টাকা জমা হয়নি।]

বিআরটিএ সূত্র জানায়, সংস্থাটির ম্যাজিস্ট্রেটরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে। রাস্তায় পুলিশের মামলা ও জেলা পরিষদের ম্যাজিস্ট্রেটদের অভিযানে যে জরিমানা হয়, এর হিসাব বিআরটিএতে নেই।

ট্রাস্টি বোর্ড ও বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, তহবিল আস্তে আস্তে বড় হবে। সরকারের কাছে টাকা চেয়েছি। আবার সড়ক আইনে মামলার ফলে যে জরিমানা আদায় হয়, সেটিও পাওয়ার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর সারা দেশে এর প্রচার বাড়বে। তখন সবাই ক্ষতিপূরণের আবেদন করতে উৎসাহী হবে।’

আবেদন যেভাবে

সড়ক আইন অনুসারে, আর্থিক সহায়তা পেতে নির্ধারিত ফরমে দুর্ঘটনার সর্বোচ্চ ৩০ দিনের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে। ফলে যেসব দুর্ঘটনায় ৩০ দিন পেরিয়ে গেছে, সেগুলোতে আর আবেদনের সুযোগ নেই। আবেদন দাখিলের দিন থেকে ১০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন। এই কমিটি ৩০ দিনের মধ্যে আবেদনকারীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে প্রতিবেদন জমা দেবে।

প্রতিবেদন দাখিলের ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ড আবেদনকারীর ব্যাংক হিসাবে ‘প্রাপকের হিসাবে প্রদেয়’ চেকের মাধ্যমে টাকা দেবে। অর্থাৎ দুর্ঘটনার দুই মাসের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব।

দুর্ঘটনার পর ক্ষতিপূরণের বিষয়ে তদন্ত করে সুপারিশের জন্য ১৪ সদস্যের কমিটি আছে। ঢাকার বাইরে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট সহকারী পরিচালক হবেন সদস্যসচিব। পুলিশ, পরিবহনমালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিরা সদস্য হিসেবে থাকবেন।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি যদি মনে করেন, নির্ধারণ করা ক্ষতিপূরণ পর্যাপ্ত নয়, তাহলে আপিল করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া দুর্ঘটনার খবর পেয়ে বা আবেদন পাওয়ার পর ট্রাস্টি বোর্ড চিকিৎসাসহ আনুষাঙ্গিক ব্যয় মেটাতে অগ্রিম টাকা দিতে পারবে। 


সর্বশেষ সংবাদ