জীবন চালাতে হিমশিম মেসের শিক্ষার্থীদের, খাবারের ব্যয়ে কাটছাঁট
‘সবকিছুর দাম এত বেশি বেড়েছে যে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা আমাদের মত মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছে। মেসে কোনরকমে মিল চালাই। আলুভর্তা, আলুভাজি, পাতলা ডাল, শাকসবজি, ডিম ভাজি অথবা রান্না ডিমই এখন নিত্যদিনের খাবার। মেসে খাবার খরচ বাঁচাতে এখন আর আমরা মাছ-মাংস খাই না। কম টাকায় কীভাবে মাস পার করা যায়; সবাই সেই চেষ্টা করছি।’
সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে মেসের পাল্টে যাওয়া খাবার মেনু বা খাদ্যাভ্যাসের কথা এভাবেই বলছিলেন রাজধানীর একটি সরকারি কলেজের স্নাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থী মো. আব্দুল্লাহ।
শুধু তিনিই নয়, মেসের অন্য শিক্ষার্থীরাদেরও একই অবস্থা। তারা বলছেন, গত কয়েক মাসে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। যার প্রভাবে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উচ্চশিক্ষা নিতে আসা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েছেন। খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। কোনোরকমে জীবন পরিচালনা করতে গিয়ে খরচ কমাতে খাবার ও পরিবহন ব্যয় সংকুচিত করেছেন তারা।
কেউ কেউ সকালের অথবা রাতের খাবার কমিয়ে দিয়েছেন। গাড়ি অথবা রিকশার বদলে পায়ে হেঁটেই গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছেন। তাছাড়া এই বছরে মেস ভাড়া, সার্ভিস চার্জ, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, প্রতিষ্ঠানের খরচেও যুক্ত হয়েছে বাড়তি ব্যয়। সবমিলিয়ে জীবন চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
আরও পড়ুন: দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, হালের জীবনব্যবস্থা ও প্রতিকার
পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েকমাসে বর্হিবিশ্বে অস্থিরতা, ডলার সংকট, এলসি খুলতে না পারা, ব্যয়বহুল খাদ্য পরিবহন ব্যবস্থাপনা, বাজার নিয়ন্ত্রণ না করতে পারাসহ বিভিন্ন কারণে দেশের খুচরা বাজারে নিত্যপণ্যের দাম আগের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে।
এমন অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের মেয়ে শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, আগের বছর স্বাভাবিক জীবনমান চালানোর যে পরিমাণ ব্যয় ছিল এখন সেটি অনেক বেড়ে গেছে। খণ্ডকালীন চাকরি কিংবা টিউশনির যাদের প্রয়োজন হয়নি বর্তমান উর্ধ্বগতির বাজারে সেটি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।
সায়মা নাহার নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, হুহু করে বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যের দাম। পিছিয়ে নেই শিক্ষা উপকরণও। গত কয়েক মাসে আগের তুলনায় বই, খাতা, কলমের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। বাড়তি ব্যয়ের তালিকায় রয়েছে বাসাভাড়া, খাবার খরচ, পরিবহন ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, প্রতিষ্ঠানের খরচ। আমরা কিভাবে সামলাবো তা জানিনা। এখন খাদ্য যোগানোই বেশি টাকা চলে যাচ্ছে। তাছাড়া অন্যান্য খরচ তো রয়েছেই। সামনে রোজায় হয়তো ঢাকায় থাকাটাই কষ্ট হয়ে পড়বে।
আরও পড়ুন: দ্রব্যমূল্য অসহনীয়, মন্ত্রী বলছেন 'অপেক্ষা করুন'
অবশ্য শিক্ষার্থীদের এমন শঙ্কার বাস্তবতাও রয়েছে বাজারে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রকাশিত ঢাকা মহানগরীতে গতকাল সোমবারের (২০ মার্চ) খুচরা বাজার দরের তালিকা অনুযায়ী, পাম অয়েল লুজ, আমদানি করা দেশী পিয়াজ দেশী আদা, জিরা, লবঙ্গ, এলাচ, ব্রয়লার মুরগীর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আসন্ন রোজার আগেই আরো একদফা এসব পণ্যের দাম বাড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, প্রতি কেজি সরু নাজিরশাইল বা সরু মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৭৫ টাকা কেজি, পাইজাম ও মোটা স্বর্ণা, চায়না চাল বিক্রি হয়েছে ৫০-৫৬ টাকা কেজি। ভোজ্য তেলের মধ্যে সয়াবিন তেল (লুজ) প্রতিলিটার ১৬৮ টাকা, সয়াবিন তেল (বোতল) ৫ লিটার ৮৭০ টাকা, সয়াবিন তেল (বোতল) ১লিটার ১৮০ টাকা, পাম অয়েল (লুজ) প্রতি লিটার ১২৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
আরও পড়ুন: দ্রব্যমূল্য আজ ক্রয় ক্ষমতার বাইরে: মির্জা আব্বাস
মাছ ও মাংসের মধ্যে রুই মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৩৫০ টাকায়, ইলিশ মাছ প্রতি কেজি ৬০০ টাকায়, গরুর মাংস কেজি প্রতি ৭২০ টাকায়, খাসির মাংস প্রতি কেজি ১ হাজার টাকায়, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ২৪০ টাকায় এবং দেশি মুরগি প্রতি কেজি ৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য পণ্যের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বাজার দর তো রয়েছেই।
এমন পরিস্থিতিতে মেসে বা হলে থাকা মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন চরম কষ্টে। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রৌদ্র রহমান পিয়াল বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে সবকিছুর দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। ষাট টাকার নিচে একটা সাবানও কেনা যাচ্ছেনা৷ আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা বেকায়দায় রয়েছি। বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণের দামও অনেক বেড়েছে। দরকারি জিনিসপত্র কিনতেই রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে।
পিয়াল বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতেও যাতায়াত খরচ বেড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে বেড়েছে মানসিক অবসাদ-অবসন্নতা। তাছাড়া ঢাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলাতে যেসকল ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনা করেন, তাদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। বর্তমান এই অবস্থা সার্বিক জীবনযাত্রায় মারাত্নক প্রভাব ফেলেছে।
তারেক আজিজ সুমন নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বাজারের ঊর্ধ্বগতিতে আমরা শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। যেসকল শিক্ষার্থীদের পরিবার মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত তাদের পরিবারের পক্ষে খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। যারা বিভিন্ন মেসে থাকে সেসকল শিক্ষার্থীদের মেস ভাড়া, খাবার খরচও অনেক বেড়েছে। যার ফলে শুধু ক্ষুধা নিবারনের জন্য সকাল-বিকেল অতি সাধারণ খাবার খেয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
অপরদিকে শিক্ষার্থীদের স্বচ্ছলতা বা স্বাভাবিকতা আনতে এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষার্থীদের জন্য কর্ম পরিবেশ তৈরি করা বা কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর বিকল্প নেই বলে মনে করেছেন শিক্ষাবিদরা।
শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বর্তমান পরিবেশে নানান কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মত অবস্থা তৈরি হয়েছে। তবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যে পরিমাণ কর্মসংস্থান প্রয়োজন ছিল সেটি এখন নেই। যার ফলে শিক্ষার্থীরা এমন অবস্থার মধ্যে পড়েছে। রাষ্ট্রের উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু সে অনুযায়ী কাজ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তাছাড়া শিক্ষার সাথে জীবিকার যে সম্পর্ক আমাদের দেশে সেটিও খুব বেশি সুবিধাজনক না। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্র তৈরি করা বা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার বিকল্প নেই।