বেকারদের যৌক্তিক দাবির প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন
আমাদের দেশের একটি চিরাচরিত রূপ হলো এখানে আন্দোলন ছাড়া কোন কিছু অর্জিত হয় না, দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিকতার প্রত্যক্ষ ফল হয়তো এটা। কিন্তু রাষ্ট্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি যেমন সংশ্লিষ্টদের পূর্বেই জ্ঞাতব্য থাকা প্রয়োজন তেমনি আন্দোলনকারী রাষ্ট্রের সঞ্জীবনী শক্তির উপর পুলিশি চড়াও কতটা সর্বসম্মত সেটাও ভেবে দেখা আবশ্যক ।
বেকারত্ব আমাদের দেশে একটি চলমান সমস্যা, সেই সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সেশনজট, করোনাকালীন পড়াশোনার ব্যাঘাত, উচ্চশিক্ষার হার, সার্বিক গড় আয়ু বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে বেকারত্বের সংখ্যা ক্রমেই হুহু করে বাড়ছে। আবার, আমাদের দেশে চাকরিতে প্রবেশে বয়সের বেড়াজাল, বেকারদের জন্য যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা!
আরও পড়ুন: দরখাস্ত করে পাওয়া পুরস্কার আমার দরকার নেই
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৪০ রয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ৪০ বছর, শ্রীলঙ্কায় ৪৫ বছর, ইন্দোনেশিয়ায় ৪৫ বছর, ইতালিতে ৩৫ বছর, ফ্রান্সে ৪০ বছর, যুক্তরাষ্ট্রে ৫৯ বছর, কানাডা ও সুইডেনে ৪৭ বছর, কাতার ও নরওয়েতে ৩৫ বছর, এঙ্গোলায় ৪৫ বছর এবং তাইওয়ানে ৩৫ বছর। শুধুমাত্র আমাদের দেশেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর, যা বেকারত্বের সংখ্যাকে আরও আকাশ সমান করে তুলেছে। এর ফলে যে শুধুমাত্র একজন প্রতিভাবান ছেলে বয়সের হেরফেরের কারণে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা নয়, রাষ্ট্রও তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দিনশেষে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উভয়েই।
গত ১৯ শে আগস্ট, ২০২১ এ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় তাতে কিয়দংশ ব্যতীত সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত চাকরি প্রত্যাশীদের ২১ মাস বয়স ছাড়ের (২৫/০৩/২১ থেকে ৩১/১২/২১) কথা বলা হয়। এ প্রক্রিয়ায় যাদের বয়স ৩০ পার হয়েছে, তাদের ৪ মাসের জন্য কোনো রকম উপকার হলেও যাদের বয়স এখন ২৭, ২৮ বা ২৯ তারা চরমভাবে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার হবে এবং ৩০ ঊর্ধ্ব যারা, তারা ৩২ বছরের সুযোগ পাচ্ছে। অপরদিকে ৩০ এর নিচে যারা, তারা প্রকৃতপক্ষে ২৮ বছরের সুযোগ পাচ্ছে, যা সম্পূর্ণ সমানাধিকার ও সংবিধান পরিপন্থী।
আরও পড়ুন:‘পত্রিকা খুললেই পরীমনি, খুকুমণি, দীপু মনি’
এমনকি আমাদের দেশেও ডাক্তারদের আবেদনের বয়স ৩২ বছর। নার্সদের ৩৬ বছর। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিতে আবেদনের ৩০ বছর হলেও বিসিএস স্বাস্থ্য, জুডিশিয়ারি ও বিদ্যমান কোটার ক্ষেত্রে সে সুযোগ ৩২ বছর পর্যন্ত। অথচ সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হয়। এই বৈষম্য, সংবিধান পরিপন্থী এবং গর্হিত কাজ একদম-ই অনভিপ্রেত।
পাশাপাশি মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি অর্থাৎ ২০১১ সালে অবসরের বয়সসীমা ৫৭ থেকে ৫৯ বছর ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ৬০ বছরে উন্নীত করা হয়। কিন্তু ১৯৯১ সালে যখন মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর তখন সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা শেষবারের মতো বাড়িয়ে ৩০ বছরে উন্নীত করা হলেও গত ৩০ বছরে গড় আয়ু ১৬ বছর বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু বাড়ানো হয়নি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারীর শুরুতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বছর করার দাবি উত্থাপিত হলেও তা আজও অধরাই রয়ে যায়। অথচ বর্তমান সরকারের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লিখিত অন্যতম একটি প্রতিশ্রুতি ছিল, পরিস্থিতি অনুযায়ী বাস্তবতার নিরিখে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধিতে যুক্তিসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু চরম দুর্ভোগের দীর্ঘ সেশনজট ও করোনায় প্রায় ২ বছর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চরম বাস্তবতাতেও ৩ বছর পূর্বে ছাত্রসমাজকে দেওয়া সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার এখনো বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়নি।
আরও পড়ুন: ‘ড্যাম কেয়ার’ দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যরা
শুধু তাই নয়, বেকারদের ৪ দফা যৌক্তিক দাবী (সকল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি, প্রশ্নফাঁস ও নিয়োগ দুর্নীতি বন্ধ, চাকরিতে আবেদনের ফি সর্বোচ্চ ১০০ টাকা এবং সমন্বিত নিয়োগ পরীক্ষা ব্যবস্থা প্রনয়ণ) মেনে না নিয়ে বরঞ্চ তাদের দমনের অপপ্রয়াস চালানোর মাধ্যমে দেশের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে বলে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি। এর মাধ্যমে আমরা রাষ্ট্রীয় মেধাযন্ত্রে কুঠারাঘাত করছি না তো?
লেখক:ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী।