এবার অন্তত মিলেমিশে দেশটাকে বাঁচাই

ডক্টর তুহিন মালিক
ডক্টর তুহিন মালিক  © ফাইল ফটো

আমরা কি এখনও বুঝতে পারছি? কি হতে যাচ্ছে সামনের দিনগুলোতে? দিনে দিনে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। ধাপে ধাপে বাড়ছে লক ডাউন। যদিও সরকার এর নাম দিয়েছে সাধারণ ছুটি। এবার ২৫শে এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হলো। করোনা আক্রান্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে অনুমান করা যেতে পারে। লকডাউন আরো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। যেভাবে সংক্রামণ ছড়াচ্ছে। আল্লাহ না করুক। ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়তে পারে গোটা জাতি।

আমরা হয়ত বুঝতে পারছি না। অথবা আমাদের হয়ত বুঝতে দেয়া হচ্ছে না। না হলে, দায়িত্বপ্রাপ্তরা কেন এতটা নির্ভার, অর্বাচীন। না হলে, গরীবের বেঁচে থাকার ত্রানের চাল চুরি করতেও আমাদের হাত কেন কাঁপে না! না হলে এই কঠিন মুহুর্তে আমরাই বা কিভাবে এগুলো নিয়ে এভাবে হাসি-ঠাট্টা-ট্রল করতে পারি!

আমরা হয়ত বুঝতে পারছি না, সময় খুব দ্রুত আমাদের হাত থেকে চলে যাচ্ছে। হয়ত অনেকটাই চলে গেছে। হ্যাঁ, একথা সত্য যে, সরকার শুরুতে যথেস্ট অবহেলা করছে। সবকিছু রাকঢাক ও লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। এখনও করছে। বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। তখন আমাদের একমাত্র এজেন্ডা ছিল উৎসব আয়োজন! কিন্তু মার্চের ১৭ তারিখের পর তো সরকার করোনাকে গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু তারপরও কেন বিমানবন্দরে কোনরকম পরীক্ষা ছাড়াই ঢুকতে দেয়া হলো অসংখ্য প্রবাসীকে। প্রবাসীদের দোষ না দিয়ে সেসময় যদি রাজধানীটা লকডাউন করা হতো। প্রবাসীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও উন্নত জায়গায় কোয়ারেন্টাইনের পেছনে সর্বোচ্চ অর্থ ব্যায় করা হতো। তাহলে হয়ত আজকে গার্মেন্টসের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেবার প্রয়োজন হতো না।

এরপর করোনার প্রকোপ যখন বাড়তে থাকলো। তখন সবকিছু লুকিয়ে না রেখে হাসপাতালগুলোতে দ্রুত কিট, পিপিই আর চিকিৎসা সুবিধা ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে আজকে হয়ত পরিস্থিতি এতটা ভয়ানক হতো না।

যখন সরকারের মধ্যে সবচাইতে বেশী প্রয়োজন ছিল সমন্বয়ের। তখন পুলিশকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়া হলো মানুষ পেটানোর জন্য। প্রশাসন ব্যস্ত হয়ে গেলো মানুষকে কান ধরানোর জন্য। লাখ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিককে ঢাকায় আসতে বাধ্য করা হলো। সরকারের ভেতরে সমন্বয়হীনতা এতটাই প্রকট যে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার নেতৃত্বে কমিটির সিদ্ধান্তের কথাই জানেন না! এই যে এতদিন ধরে টিভির সামনে মিথ্যা পরিসংখ্যান দেয়া হলো। কিন্তু বাস্তবে জনগণ কি দেখেছে? প্রতিদিন পাল্লা দিয়ে মানুষ মরছে। আর সরকার বলছে, সর্দি-কাশিতে মরছে। মিডিয়া সাবধানে বলছে, করোনার লক্ষণ নিয়ে মারা যাচ্ছে। যে লোকগুলো এগুলো নিয়ে সরকারের সমালোচনা করেছে রাতের অন্ধকারে তাদের বাড়িতে পুলিশ গিয়ে ধরে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কি লাভ হলো এগুলো করে?

আসলে, এখন আর সময় নেই সরকারের ভুলত্রুটি ধরার। যা ঘটার সেটা তো ঘটেই গেছে। সামনের কঠিন সময়ে সরকারের নিজের মধ্যে সমন্বয় যেমন প্রয়োজন। তেমনি আসন্ন দূর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের একটি সমন্বিত কর্মপন্থাও প্রয়োজন। সরকারকে সবার আগে ভাবতে হবে, দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনে কোটি কোটি রোজগারহীন মানুষের মুখে কিভাবে খাদ্যের যোগান দিবে। কোটি কোটি কর্মহীন শ্রমিকের বেতন কিভাবে নিশ্চিত করবে। দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের রেশন সুবিধা কখন নিশ্চিত করবে। আগামী মাসে ধান কাটার মৌসুমে ধান কাটার লোকের যোগান কিভাবে দিবে। গতবছর যেহেতু ধান কাটার লোকের অভাবে কৃষকরা ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। এমনটা যেন এই দূর্যোগের বছরে আর না হয়, সেটা এখন থেকেই নিশ্চিত করতে হবে।

যেভাবে হুহু করে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাই ডাক্তারদের সাথে ঝগড়া না করে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতাল, বেড, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, ঔষধ ও চিকিৎসাসুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সকল বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ এখনই স্হগিত করে জরুরী ভিত্তিতে স্বাস্থ্য খাতে সেই টাকা ব্যায় করতে হবে। সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালগুলোকে এখন থেকেই প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও প্রয়োজন সাপেক্ষে আর্থিক যোগান দিতে হবে।

বুঝতে পারছি কি, পুরো বিশ্ব অর্থনীতি আজ ধ্বংস প্রায়। এর ধাক্কা সামাল দেয়া কি বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব হবে? গার্মেন্টসের অর্ডার বাতিল হলে, গার্মেন্টসের চাকা না ঘুরলে, ৩৪ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্সের কি হবে? কোটি প্রবাসী আজ প্রবাসেই কর্মহীন। প্রবাসীরা কোথা থেকে রেমিটেন্স পাঠাবে? তাদের পরিবারগুলোও এখন কিভাবে চলবে? গার্মেন্টস বন্ধ হলে সাথে সাথে শত শিল্প প্রতিষ্ঠানের দরজায়ও তালা লাগবে! শিল্পই যখন নাই আর মানুষের খাবারের টাকাই যখন নাই! ব্যবসা হবে কি দিয়ে? চাল ডালের চাহিদার সময় কি শিল্প ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যাবে?

অভুক্ত মানুষের পেটের দায় তখন পুলিশের লাঠি ও জেলের ভয়ের কাছে নতি স্বীকার করবে না! কিসের রাজনীতি, কিসের দল, কিসের নেতা- এগুলোর খবর কেউ তখন রাখবে না! সরকার হয়ত সামাল দিতে না পারলে পালিয়ে যাবে। কিন্তু দেশের মানুষগুলো তো রয়ে যাবে। এতদিন ধরে অনেক অবিচার, লুটপাট, দুর্নীতি তো আমরা সবাই মিলেই করেছি। এখন অন্তত সবাই মিলে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে একটা দুর্যোগ মোকাবেলার প্লাটফর্ম তৈরি করি। জাতির এই কঠিন দুঃসময়ে এবার অন্তত সবাই মিলেমিশে দেশটাকে বাঁচাই। দেশের মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াই। এখন রাজনীতি করার সময় নয়। এখন সময় একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়াবার। যে সময়টা এখনও চলে যায়নি। তবে দ্রুত নিঃশেষের দিকে।

লেখক: ড. তুহিন মালিক, আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ


সর্বশেষ সংবাদ