৮ই এপ্রিল একটি সংখ্যা নয়, নতুন এক ইতিহাসের সূচনা!

ফারুক হাসান
ফারুক হাসান   © ফাইল ফটো

বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৭ই ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তে শুরু হয় এক মহাপ্লাবন (কোটা সংস্কার আন্দোলন)। এই প্লাবনের ঢেউ আছড়ে পরে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষকরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শুরু হয় আন্দোলনের ঢেউ। এই কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারনে চোঁখের সামনে দেখেছি সহস্র বিবস্ত্র অবস্থা, দেখেছি ভূমিকম্পের ন্যায় সরকারের পেটুয়া পুলিশ বাহিনীর সীমাহীন বর্বরতা।

৮ই এপ্রিল, আমি দেখেছি শিলাবৃষ্টির মতো পুশিলের টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপের বর্বরতা। পুলিশ নামক পেটুয়া বাহিনীর বর্বরতার সামনে গায়ের শার্ট খুলে বুক পেতে দিয়েছিলাম আর বলে ছিলাম আমরা চালাও গুলি যতো আছে তোমাদের ভান্ডারে। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আকাশে বাতাসে শুধু বারুদের গন্ধ আর জনহাহাকার বিরাজমান ছিল। রক্তচোষা পুলিশ বাহিনীর রাবার বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল অসংখ্য মানুষের দেহ, তবুও থেমে ছিলো না তারুণ্যের সেই তেজোদৃপ্ত আন্দোলন।

১৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে চলে আসা এই আন্দোলনের ৫ দফা দাবি আমরা দিয়েছিলাম। তারমধ্যে প্রধান দাবিটি ছিল, কোটা ব্যবস্থা ৫৬% থেকে কমিয়ে ১০% এ নিয়ে আসতে হবে। এই দাবিকে সামনে রেখে শুরু হয় দুর্বার আন্দোলন। চলে আসে ৮ই এপ্রিলের সেই ভয়ার কালরাত্রি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নারী হল গুলো থেকে আমার বোনেরা গভীর রাতে হলের গেইট ভেঙ্গে হুরহুর করে বেরিয়ে আসে রাজপথে। আমার মনেহয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটিই প্রথম ঘটনা যা ঢাবির সব নারী হলের মেয়েরা গভীর রাতে গেইট ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে।

১৯৭১ সালের পরে বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন আর কখনোই হয় নি। এই আন্দোলনে সকল দলমত নির্বিশেষে মানুষের অংশগ্রহণ ছিলো।

সরকার যখন কোনভাবেই আন্দোলন দমাতে পারছিল না, তখন ভিন্ন এক পথ অবলম্বন করলেন ক্ষমতাসীনরা। শুরুতে বলতে থাকলেন এই আন্দোলনে বিএনপি-জামাতের ইন্ধন আছে। যখন এটিও ধোপে টিকলো না তখন ব্লেম দিলেন লন্ডন থেকে নাকি কোন একজন এই আন্দোলনে ১২৫ কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছে। যাইহোক আল্লাহর অশেষ রহমতে ক্ষমতাসীনদের সকল ব্লেইম গেম মিথ্যা প্রতিপন্ন হলো।

অবশেষে দেশের নির্বাহী প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহান জাতীয় সংসদে কোটা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা দিলেন ১১ এপ্রিল, ২০১৮।

এরপর শুরু হলো নতুন আরেক নাটক। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেওয়ার পরেও আর প্রজ্ঞাপন দিচ্ছে না সরকার। আমরা আবার প্রজ্ঞাপনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে নামি। এবার আমাদের উপর সরকারের পেটুয়া বাহিনী ছাত্রলীগ কর্তৃক শুরু হয় ইতিহাসের বর্বরোচিত জঘন্য আক্রমণ। ৩০ জন ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে বর্তমান ডাকসুর ভিপি সহযোদ্ধা নুরুল হক নুরসহ আমাদের অনেক সহযোদ্ধাকে মেরে রক্তাক্ত করে ছাত্রলীগ।

এই আক্রমণের ফলে সমগ্র বিশ্বে সরকারের দমন নীতির কড়া সমালোচনার ঝড় উঠে, কিন্তু সরকার হয়ে উঠে আরো বেপরোয়া। রাশেদসহ অনেককেই গ্রেপ্তার করে। আমরা বর্বর এই আক্রমণে প্রতিবাদে এবং কারাবন্দীদের মুক্তির দাবিতে ২ এপ্রিল বিক্ষোভের ডাক দেয়। ২ এপ্রিল বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করার জন্য সকাল সকাল কেন্দ্রীয় শহীদমিনারের দিকে যায় আমি হাসান আল মামুন, সাইফুলসহ অনেককেই।

এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার, এই সময়ে সমগ্র দেশে একটি চরম ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল সরকার।কেউ ভয়ে কথা বলার সাহস পর্যন্ত করেনি। এযেন ছিলো ১৯৭১ সালের ন্যায় জীবন্ত এক যুদ্ধ। কেউ সাহস করে কথা বললেই সরকারের পেটুয়া বাহিনী বর্বর আক্রমণ চালাত।

যায়হোক, আমরা শহীদমিনারে পৌঁছানোর সাথে সাথেই ছাত্রলীগের শতাধিক কর্মী আমাদের ঘিরেধরে। আমাকে একজন এসে বলে ফারুক ভাই আপনি সোজা মেডিকেলের দিকে দৌড় দেন তা না হলে ওরা আপনাকে জীবন্ত মেরে ফেলবে।আমি তখন বললাম আজকে মরতে হলে মরবো তবুও ছাত্রলীগের এই গুন্ডাদের ভয়ে পালাবো না। আমার উপর শুরু হয়ে গেলো শিলাবৃষ্টির মতো আক্রমণ। ক্ষতবিক্ষত আমার শরীরে রক্ত ঝাড়ছে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম, যখন আমার জ্ঞান ফিরল তখন দেখলাম আমি রাজধানীর হলিফ্যামিলি হাসপাতালে।

সেখানে ২ দিন রাখার পরে আমাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হলো কেন্দ্রীয় কারাগারে। কারাগারে গিয়ে দেখি আমার অনেক সহযোদ্ধায় সেখানে বন্দী। যায়হোক খারাপ লাগলেও সকলকে এক সাথে পেয়ে খারাপ লাগা গুলোকে আসতে আসতে ভালোলাগাতে পরিনত করতে থাকলাম।

এরপরে শুরু হলো আমাদের রিমান্ড, রিমান্ডের কানিনী আর বর্ণনা করলাম না। যারা রিমান্ডে গেছে শুধু তারাই জানে রিমান্ড আসলে কতটা ভয়াবহতার এক জীবন্ত আগ্নেয়গিরির নাম। প্রায় দীর্ঘ দুই মাসের কারাজীবন শেষ করে আমরা কুরবানি ইদের একদিন আগে কারাগার থেকে বের হই।

৮ই এপ্রিল আসলেই চোঁখের সামনে ভেসে উঠে সহস্র স্মৃতি।

লেখক: যুগ্ম আহবায়ক, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ।


সর্বশেষ সংবাদ