চব্বিশের আন্দোলন বিপ্লব নাকি অভ্যুত্থান?
জুলাই বিপ্লব কি আসলেই একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল নাকি অভ্যুত্থান হয়েছিল এই নিয়ে আলোচলান ও সমালোচনা, তর্ক ও বিতর্ক যেনো পিছুই ছাড়ছে না আমাদের সমাজের। আমার ধারণা মতে অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই, তবে কিছু জটিল সমীকরণের পার্থক্য আছে যা বিপ্লবকে জনগণের সর্বোচ্চ মুক্তির পথ বলা হয়।
বাংলাদেশের জনগণ এক পক্ষ দাবি করছে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, আরেক পক্ষ দাবি করতেছে এইটা একটা গণঅভ্যুত্থান। বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থান এই নিয়ে যারা দাবি করছে তারা আমাদের তৃণমূলের জনসাধারণ নয়, এই দুইটা পক্ষের মধ্যে একটি হচ্ছে যারা সম্মুখ সারিতে থেকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে তারা দাবি করছে এইটা একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। আরেক পক্ষ বাংলাদেশের তথাকথিত রাজনীতিবিদরা দাবি করছে এইটা একটা অভ্যুত্থান। তার মধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ (বিএনপি) তারা দাবি করছে এইটা বিপ্লব না এইটা একটি গণঅভ্যুত্থান। বাম সংগঠনের নেতা, কর্মীর থেকে কঠোর ভাবে বলা হচ্ছে এইটা একটা সাধারণ অভ্যুত্থান।
এখন কথা হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনায় এইটা গণঅভ্যুত্থান না বিপ্লব। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও ভৌগলিক বিবেচনায় ৩৬জুলাই বাংলাদেশে একটা বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। আমাকে যদি হাজার বার কেও বলতে বলে এইটা কি গণঅভ্যুত্থান না বিপ্লব, আমি হাজার বলব এইটা বিপ্লব, বিপ্লব, বিপ্লব।
এইটা নিয়ে আমাদের তথাকথিত সুশীলরা খুব কম কথা বলতেছে তার কারণ তারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিজের দুরত্ব বাড়াতে চায় না। একটু শুদ্ধ ভাবে বললে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ সবসময় রাজনৈতিক দলের পা চাটতে চায়। আমাদের সুশীলরা চাটাচাটি তে বিশ্বাসী। এখন কেনো সুশীলরা এই বিষয়ে কথা বলতে চায় না তার কারণ বের করা যাক, তার অন্যতম কারণ ৩৬জুলাই বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো এইটাকে বিপ্লব না বলে বলছে অভ্যুত্থান। আর রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু এইটাকে অভ্যুত্থান বলতেছে তার জন্যে সুশীলরা এই বিষয়ে কথা বলছে না।
এইবার আসি বিপ্লব ও অভ্যুত্থান এর মধ্যে সাধারণ কয়েকটা পার্থক্য যা এর আগে বাংলাদেশে ঘটেছে এবং আমাদের দেশের ভৌগলিক, অর্থনীতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের জন্যে বুঝার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিপ্লব দিয়ে আমরা যা বুঝি সাধারণত আমূল পরিবর্তন। বিপ্লব যা তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ে ঘটে যখন জনগণ চলমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জেগে উঠে। এরিস্টটল দুই ধরনের রাজনৈতিক বিপ্লবের বর্ণনা দিয়েছেন:
১। এক সংবিধান থেকে অন্য সংবিধানে পূর্ণাঙ্গ পরিবর্তন।
২। একটি বিরাজমান সংবিধানের সংস্কার।
ক্রেন ব্রিনটনের মতে,
প্রতিষ্ঠিত সরকারকে বিধিবহির্ভূতভাবে সশস্ত্র উপায়ে পরিবর্তন করাই হলো বিপ্লব। সাধারণ বাঙালি বিপ্লব মনে যা বুঝে সেটা হলো, বিপ্লব এর মধ্যে শোষিত শ্রেনী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে ও শাসকগোষ্ঠীকে হত্যা করবে এবং শাসকের রক্ত নিয়ে বিপ্লবীদের হলি খেলা হচ্ছে বিপ্লবের সর্ব উৎকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য (আজ থেকে ২০০ বছর আগের যে শোষিত শ্রেনী শোষকের বিরুদ্ধে বিপ্লব করতে তার ইতিহাস পড়লে বুঝা যায়)। স্বৈরাচার এর যত চিহ্ন ছিল সব ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলতে হবে এবং রাষ্ট্র যন্ত্র দখল নিয়ে পরিচালনা করা লাগবে। আমরা এই কয়েকটি বিষয় বুঝি বিপ্লব মানে ।
অভ্যুত্থান হচ্ছে হঠাৎ ও অবৈধভাবে নির্বাচিত সরকারের রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে দলগতভাবে কোন গোষ্ঠীর অবস্থান ব্যক্ত করে ক্ষমতাচ্যুত করা কিংবা জোরপূর্বক পদত্যাগ করতে বাধ্য করা। অভ্যুত্থান একটি সাধারণ কু এর মধ্যে দিয়ে সংঘটিত হতে পারে আবার রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান হতে পারে। অভ্যুত্থানের পর অনেক সময় দেখা যায় সামরিক বাহিনীর বা আধা সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে এছাড়াও যে গোষ্ঠী অভ্যুত্থান সংঘটিত করে শুধুমাত্র তারাই ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্র পরিচালনা করে।
এটা সত্য যে স্বৈরাচার হাসিনা অবৈধ নির্বাচিত (ভোট চোর) সরকার ছিল। অভ্যুত্থানের সাধারণ সংজ্ঞা অনুযায়ী অভ্যুত্থান করেন দলগত, গোষ্ঠীগত বা সামরিক বাহিনী দ্বারা সংঘটিত। আমরা স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের দেখেছি যে সেখানে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, বাম রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব স্বৈরাচার পতন হয়েছিল। যা আমাদের কে ৯০ এর আন্দোলন কে স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থান বলতে আমাদের বিবেকে কোনো দ্বিধাবোধ করে না। ৯০ এর আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের রক্ত ঝড়লেই আমরা স্বৈরাচার এর রক্ত নিয়ে রাজ পথ রাঙ্গাতে পারি নাই, যা অভ্যুত্থানের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য যে সেটা রক্তপাতহীন ছিল। এরপর রাজনৈতিক দল গুলোর মতামত এর ভিত্তি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। যা সবথেকে বড় কথা হচ্ছে সেখানে স্বৈরাচার পদত্যাগ করে এবং স্বগৌরবে স্বৈরাচার দেশে অবস্থান করে আবার রাজনীতি তে ফিরে আসে। ৯০ এর আন্দোলনকে আমরা সবাই উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে বিবেচনা করে এই আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থান বলা হয়।
এইবার আসি ৯০ এর আন্দোলন এবং ২৪ এর আন্দোলন এর বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে ২৪ এর জুলাই আন্দোলন বিপ্লব না অভ্যুত্থান তা বলা হবে। ৯০ এর অভ্যুত্থানের বৈশিষ্ট্যের সাথে যদি ২৪এর জুলাই আন্দোলন বৈশিষ্ট্যের মিল থাকে তাহলে আমরা নির্দ্বিধায় এইটাকে অভ্যুত্থান বলতে পারি। আর যদি বৈশিষ্ট্যের সাথে মিল পাওয়া না যায় তাহলে ২৪ এর বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে আমরা সেটাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিবো, এটাই আমাদের কাম্য।আমরা আগেই জেনেছি যে ৯০ এর আন্দোলন যে গণ অভ্যুত্থান ছিল। ৯০ এর আন্দোলনে রাজনৈতিক দল গুলোর নেতৃত্বে সংঘঠিত হয়েছিল আর অপরদিকে ২৪ এর জুলাই আন্দোলন রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা অপরিসীম কিন্তূ আন্দোলন তো সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছে। যা বিপ্লবের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
২৪ জুলাই আন্দোলনের স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য যা দেখে আমরা তাকে বিপ্লব বলতে বাধ্য। ওইযে কিছুক্ষণ আগে বললাম বিপ্লব বলতে বাঙ্গালী বুঝে যে, "বিপ্লব এর মধ্যে শাসকঘষ্টি হত্যা করতে হবে এবং শাসকের রক্ত নিয়ে বিপ্লবীদের হলি খেলা হচ্ছে বিপ্লবের সর্ব উৎকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য " এইটা ৩৬ জুলাই বাংলাদেশে হইতো জনগণ হাসিনা মেরে তার লাশ নিয়ে হলি খেলতো যদি সে না পালিয়ে যেতো এবং বিপ্লব পরিপূর্ণ লাভ করতো। তবে উন্নত বিশ্বে এই বিপ্লব আর কখনও সংঘটিত হবে না, তার কারণ স্বৈরাচার গুলা সব আকাশ পথে পালিয়ে যায় । তাই বলা যায়, আকাশ পথ আবিষ্কার হওয়ার পর স্বৈরাচার পালিয়ে যে আনন্দ মিছিল হয় যা আগের সেই হলি খেলার সমান আনন্দ । তাই এটিকে আমরা বিপ্লব বলতে পারি । যদি এরশাদের মত হাসিনা দেশে থেকে যেতো এবং পদত্যাগ করতো তাহলে এইটা একটা সাধারণ অভ্যুত্থান হতো, যা হয়নি। বিপ্লবের মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন হয় এবং স্বৈরাচার যত চিহ্ন আছে সব ভেঙে গুড়িয়ে ফেলা হয়। আমরা দেখেছি ৩৬ জুলাই পর হাসিনার যত চিহ্ন ছিল সব গুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, এবং আমূল পরিবর্তন চলমান এই থেকে বলা যায় ৩৬ জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল ।
বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর বিপ্লবীরা রাষ্ট্র পরিচালনা কাজ করে থাকেন যা বিপ্লবের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য, বর্তমানে সরাসরি রাজপথের তিনজন বিপ্লবী রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। যা আমাদেরকে ৩৬ জুলাই আন্দোলনকে বিপ্লব বলতে বাধ্য করবে।
ক্রেন ব্রিনটনের মতে, বিপ্লব সশস্ত্র উপায়ে হয়। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে আমাদের জুলাই আন্দোলন কি সশস্ত্র ছিল? আমি বলি এইটা সশস্ত্র ছিল, তাহলে কিভাবে ছিল ! এখন আমি বলি আওয়ামী লীগ,ছাএলীগ, পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আমাদের আন্দোলনকারী ভাইদের উপর যুলুম অত্যাচার করছে এবং কি প্রায় ২০০০ মানুষ হত্যা করছে। আর আমরা অপরদিকে ছিলাম আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া ,আমাদের হাতে ছিল লাটি, পাইপ , বাঁশ, বাড়ির আসবাবপত্র ( বিশেষ করে মেয়েদের হাতে ছিল রান্না করার বিভিন্ন জিনিস) এইগুলো ছিল আন্দোলনকারীদের অস্ত্র । তাদের ছিল গোলাবারুদ বিপ্লবীদের ছিল ইট পাটকেল। এই অস্ত্র দিয়ে সম্মুখ সারির যুদ্ধার মতো লড়াই করে গেছে আন্দোলকারীরা । স্বৈরাচার টিয়ার শেল মারছে আন্দোলনকারীরা সেটা ক্রিকেট ব্যাটিংয়ের মতো বাঁশ দিয়ে তাদের দিকের ছুঁড়ে মারছে (জাবির একটি ঘটনা) । এইটা যে একটি বিপ্লব ছিল তা, ক্রেন ব্রিনটনের সেই উক্তি থেকে বলা যায়। জুলাই আন্দোলনকারীরা সংবিধান পরিবর্তন করলে বিপ্লবের চূড়ান্তরূপ লাভ করবে।
এরিস্টটল দুই ধরনের রাজনৈতিক বিপ্লবের বর্ণনা দিয়েছেন: ১. এক সংবিধান থেকে অন্য সংবিধানে পূর্ণাঙ্গ পরিবর্তন, ২. একটি বিরাজমান সংবিধানের সংস্কার।
জুলাই আন্দোলনের বিপ্লবীরা অ্যারিস্টটলের রাজনৈতিক বর্ণনা দিকে অবিরাম ছুটে চলতেছে, বিপ্লবীরা বর্তমান সংবিধান পূর্ণাঙ্গ পরিবর্তন বা বিরাজমান সংবিধান সংস্কার করতে চাচ্ছে। তারা জুলাই বিপ্লব নিজেদের মধ্যে ধারণ করে এরিস্টটলের মতো রাজনৈতিক বিপ্লব করতে চায়। কিন্তূ তার অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো।
রাজনৈতিক দল গুলো কেনো রাজনৈতিক বিপ্লব করতে চায় না তার অনেক গুলো কারণ আছে, তার মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে এই বিপ্লবের পর রাজনৈতিক দল গুলা রাজনীতির মাঠে খুব বেশি ফাংশন করতে পারবে না( বর্তমানে রাজনৈতিক দল গুলোর অসামাজিক কার্যকলাপ দেখে জনগণ তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে)। তার কারণ নতুন সংবিধানে রাজনৈতিক দলগুলোকে যদি রিফর্ম করতে বলে এই ভয়ে তারা সংবিধান পরিবর্তন বা বিরাজমান সংবিধান সংস্কার চাচ্ছে না । রাজনেতিক দল গুলোর চাওয়া যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিবে তত ভালো তাদের জন্য কারণ তারা গিয়ে বাংলার মসনদে বসবে।বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল গুলো রাজনীতি বলতে শুধু বুঝে টেম্পু স্ট্যান্ড আর ব্যাংক দখল ।
আর এভাবেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল গুলো রাজনৈতিক বিপ্লব করতে না দিয়ে জুলাই বিপ্লব কে জুলাই অভ্যুত্থান রূপ দিচ্ছে।
লেখক: মো. আতাউল্লাহ
সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।