ফ্যাসিবাদের জন্ম: নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম
- সাইদুর রহমান
- প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০০ PM , আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৫ PM
বিগত সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদ চরিত্র থেকে বের হতে পারছে না আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলো। চট্টগ্রামে হিন্দুদের সংগঠন ইসকন কর্তৃক সরকারি আইনজীবী নিহতের ঘটনায় দায়িত্বজ্ঞানহীন সাংবাদিকতা পরিলক্ষিত হয়েছে। কয়েকটি টেলিভিশন চট্টগ্রাম আদালতের ঘটনাটি নিয়ে যা করেছে তা উদ্বেগের।
সংবাদপত্রগুলোয় সরকারি আইন কর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় ইনিয়ে বিনিয়ে ফ্যাসিবাদের দোসরদের বয়ান প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালিয়েছে। গণমাধ্যমগুলোয় পরিচালনায় এখনও ফ্যাসিবাদের উৎকৃষ্ট দোসররা বসে থাকায় সাংবাদিকতার স্বাধীনতা প্রকারান্তে পরাধীনতার পথে। নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতা থেকে মুক্ত বা স্বাধীন সাংবাদিকতার নামে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠাতা চেষ্টার আত্মহত্যার শামিল। মনে রাখতে হবে কাণ্ডজ্ঞানহীন অপ-সাংবাদিকতা মুক্ত সংবাদমাধ্যমের পথ রুদ্ধ করতে পারে। ওদের কারণেই আবার নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতা ফিরে আসার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ফ্যাসিবাদকে উৎসাহিত করে।
বিগত সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশের গণমাধ্যম ছিল অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই, তথ্য মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বিএসএস) নগ্নভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে দুইভাবে একটি সরাসরি সরকারের সংশ্লিষ্টদের চাপে আরেকটি নিজ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক স্বেচ্ছায়। তবে ক্ষেত্র বিশেষ যতটা এসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়েছে তার চেয়ে আবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরকারি সুবিধাভোগী কিছু চিহ্নিত দালাল সাংবাদিকরা নিজেরাই সেন্সরশিপ আরোপ করেছিলেন।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২৪ সালের এই সূচকে বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম। স্বাধীনতার পর থেকে গণমাধ্যমকে সব সরকারই যোগাযোগের উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করেছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করলে তারাও ব্যতিক্রম ছিল না। তবে গণমাধ্যমকে কঠোরহস্তে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিগত সময়ে দলের লোকেরা প্রায়শই তাদের অপছন্দের সাংবাদিকদের ওপর সহিংস হামলা করেছে। ভয়ভীতি দেখিয়েছেন, চাকুরিচ্যুত করেছেন। একই সাথে নির্দিষ্ট কিছু সাংবাদিকের ওপর ‘নীরবে বিচারিক হয়রানি’ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: সরকার ভুল পথে গেলে পথ হারাবে বাংলাদেশ
সরকারি নিয়ন্ত্রণে অসহায় আত্মসমর্পণ পেছনে মেরুদণ্ডহীন সাংবাদিক সমাজই দায়ী। সাংবাদিকদের সমাজের দর্পণ বলা হলেও সেই দর্পনই অবৈধ সরকারের রেজিমভুক্ত হয়ে যায়। বিগত ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার ডামি নির্বাচনে ভাগবাটোয়ারা ক্ষেত্রে তারাও পিছিয়ে ছিল না। বাংলাদেশের দেড় ডজন মিডিয়ার মালিক হাসিখুঁশিতে ডামি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। এটি যে কোন জাতির জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছু হতে পারে না। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ছাড়া সাজানো পাতানো ডামি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের কারণে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমে প্রকাশ করেনি। ডামি নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট মিডিয়া হাইজে ডামি সাংবাদিকতায় করা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে পাতানো, সাজানো নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার সব চেষ্টা করানো হয় গণমাধ্যম দিয়ে।
বিগত সরকারকে টিকিয়ে রাখতে বা সরকারের পক্ষে পাবলিক এজেন্ডা সেটিং থিওরি প্রয়োগ করা হয়। ভোট সংক্রান্ত গুরুতর অনিয়মগুলো কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। বোকা বানানো সহজ সরল জনগণকে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা ভোট, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বিতর্কিত তিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে ধরনের সাংবাদিকতা করার কথা ছিল তা করতে পারেনি গণমাধ্যম। ২০১৮ সালের নির্বাচনের অনিয়ম সংক্রান্ত নিউজ না করতে সরকার থেকে সরাসরি চাপ প্রয়োগ করা হয়। এমনকি বাংলাদেশের একটি প্রথমসারির বাংলা পত্রিকার প্রেসে হামলা চালিয়ে পত্রিকা ছাপানো বন্ধ রাখা হয়। সরকারের চাহিদা অনুযায়ী নতুন ডামি করে পত্রিকা বাজারে ছাড়া হয়।
গত রমজান মাসে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে ফোন করে গণমাধ্যমগুলোয় ‘রমজান মাসে ইফতারের নামে বিএনপির চাঁদাবাজি’ নিউজ করতে বাধ্য করা হয়। এরই অংশ হিসেবে কয়েকটি গণমাধ্যম নিউজও করেছিল। বাংলা ইনসাইডার নামের একটি প্রোপাগান্ডার ভিত্তিক নিউজ পোর্টালের লিংক পাঠিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় নিউজ করবার জন্য চাপ প্রয়োগের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেস রিলিজ না ছাপাতে সরকারি এজেন্সি দিয়ে চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি বিএসএস থেকে তদবির চালানো হয়। বিগত সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশে যে ধরনের সাংবাদিকতা হওয়ার কথা ছিল তার যৎসামান্যও হয়নি। সাংবাদিকতা যখন ক্ষমতাসীনদের তল্পীবাহকে পরিণত হয়ে যায়, তখন জনগণের অধিকার একের পর এক ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে। সেটিই হয়েছে বাংলাদেশে। ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখার ঢাল ছিল গণমাধ্যম। আমাদের দেশের গণমাধ্যম ফ্যাসিবাদের প্রচার মাধ্যমে পরিণত হয়েছিল।
রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি গণমাধ্যমের আমূল সংস্কার কার্যক্রমে হাত দিতে হবে। বিগত সময়ে কারা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করেছিল, কারা কারা (সাংবাদিক) সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে বিশেষ সুবিধা নিয়েছিলো, তার তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। দালাল সাংবাদিকরা দেশ, জাতি ও জনগণের দুশমন। অর্ধশিক্ষিত, চিটার, অশিক্ষিতদের সাংবাদিকতার মতো মহান পেশায় সম্পৃক্ত করে সাংবাদিকতাকে কলুষিত করেছিলো ফ্যাসিবাদ। ঢাকা থেকে মফস্বল পর্যন্ত দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে সাংবাদিকতার কলম তুলে দেয়া হয়েছিল। বড় বড় সাংবাদিকরা ফ্যাসিবাদের মুখপাত্র হয়ে গিয়েছিলেন। ফ্যাসিবাদের গুণগান ছাড়া কিছুই বুঝতেন না তারা।
দিনে সাংবাদিক সংগঠনগুলোয় বা সচিবালয় বিকালে অফিসে আর রাতে নাইটক্লাব বা ফাইভস্টার হোটেলে প্রতাব বিস্তার করাই ছিল আওয়ামী লীগের লেবিসধারী দুর্নীতিবাজ এসব সাংবাদিকদের প্রধান কাজ। লাইফ স্টাইল ছিল সদ্য জন্ম নেয়া জমিদানের সন্তান। দ্রুত দলীয় পরিচয়ধারী এসব অপসাংবাদিকদের পাশাপাশি দালাল সাংবাদিকদের অস্বাভাবিক আয়-ব্যয়ের হিসাব গ্রহণ করতে হবে। তাদের ব্যাংক লেনদেনের হিসাব বিশ্লেষণের পর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে অসৎ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করতে হবে।
সাংবাদিকতা অর্থ ইরকামের ঢাল নয়। যারা এটিকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছে, করছে বা আগামীতে করবে সকলকেই আইনের আওতায় আনতে হবে। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণকারী এবং মহান পেশার বিকৃতকারীদের চিহ্নিত করতে না পারলে সাংবাদিকতা সবসময় নিয়ন্ত্রিতই থাকবে। বর্তমান সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ থাকবে দ্রুত গণমাধ্যমে শুদ্ধি অভিযান শুরু করুন। সাংবাদিকতাকে পরিশুদ্ধতায় রূপ দিন।