ছাত্রতন্ত্র   

সায়দুল হক খান
সায়দুল হক খান  © সংগৃহীত

'৭১ এর পর ছাত্র-মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন কোনও কাজে লাগানো হয়নি যদিও সিরাজুল আলম খান প্রমুখ পরামর্শ দিয়েছিলেন। ছাত্র-মুক্তিযোদ্ধারা তাদের টাটকা এবং জ্বলন্ত-আবেগ নিয়ে দেশ পুনর্গঠনের কাজে সুযোগ পায়নি, জাসদ হয়তো সে কারণেই হয়েছিল। জ্বলন্ত-আবেগকে পুঁজি করে বাড়ন্ত কিছু করিয়ে নেবার পন্থা বের করা যায়নি, তাই খুব সহজেই '৭৫ ঘটে এবং টিকে যায়। অথচ এই ছাত্ররাই '৫২ থেকে '৭১ পর্যন্ত ঐতিহ্যগতভাবে শানিত ও প্রাত্যহিকভাবে উত্তপ্ত হয়েছিল, কিন্তু চার বছরের মাথায় '৭৫-এ, বয়সে-নবীন কিন্তু মননে-স্থবির, 'অস্ত্র-জমা-দেয়া কিন্তু ট্রেনিং-জমা-না-দেয়া' এই যোদ্ধাদের চোখের সামনে  ১৫ আগস্ট ঘটে, ৩ নভেম্বর ঘটে...ঘটেই চলে।
  
ইদানীং সবাই ‘কোমলমতি’ শব্দটা ব্যবহার করে ছাত্রদেরকে বুঝিয়ে থাকেন যদিও এই কোমলমতিদের প্রত্যেকেই সাবালক, ভোটার এবং এদের পূর্বসূরিরাই তাদের কোমলমতি সময়ে পতাকা তুলেছেন, স্বাধীনতা ঘটিয়েছেন, পাকিস্তান ভেঙেছেন ও বাংলাদেশ ঘটিয়েছেন। '৭১ এর স্বাধীনতা যদি ছাত্ররূপী-কোমলমতিদের অব্যাহত-রক্তদানের অর্জনই হয়, তবে মানতেই হবে, সেই কোমল-বয়সীদের-প্রয়োজন বুঝতে আমাদের পঞ্চাশ বছর লাগলো এবং যে বোঝের কারণেই সম্ভবত এ দফায় (২০২৪) সেই কোমলমতিদের দু'জন রাষ্ট্র পরিচালনায় সরাসরি অংশীদার হতে পেরেছেন এবং অন্যরাও অংশীদার হবেন বলে শোনা যাচ্ছে।  

আরও পড়ুন : উপাচার্যদের পদত্যাগের হিড়িক কেন?

এই কোমলমতিদের উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনাকে কোনখাতে প্রবাহিত করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে, যেটা '৭১-পরবর্তী কোমলমতিদের নিয়ে ভাবা হয়নি। ইদানীংকার কোমলমতিরা লেখাপড়াকে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং ও রিওয়ার্ডিং মনে করে উঠতে পারছে না বলে এদের সারপ্লাস এনার্জি অব্যবহৃত থেকে থেকে অপব্যবহৃত হবার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এরা বেশ বোঝে তবে জানে কম, কারণ 'জানা'র যে চিরায়ত-পন্থা অর্থাৎ লেখা ও পড়া সেটা আকর্ষণীয় হয়ে উঠেনি। তাই,  ইন্টারনেট বিছিয়ে অন্তরজ্বালা মেটানোর একটা ভুবনে নিজেরা গভীর-রাত্রিতে বিচরণ করে, কথা শোনে, কথা বলে। পথবন্ধ ও দমবন্ধ একটা সমাজে ইন্টারনেটেরর ভুবন একটা ভার্চুয়াল ফিল্ড যেখানে 'কোথাও-আমার-হারিয়ে-যেতে-নেই-মানা' আবার যেখানে কখনও কখনও 'নিজেকে-হারিয়ে-যেন-পাই-ফিরে-ফিরে'। এই যেমন গত কিছুদিন আগে বিপ্লবের ডাক শুনে নিজেদেরকে তারা ফিরে পেল। ফিরে পেয়ে, এ দফায় তারা শুধু রক্ত দেয়নি, রক্ত নিয়েছেও বটে। যে সংখ্যক পুলিশের রক্ত নেয়া হয়েছে, সেটা অবিশ্বাস্য! ভেবে দেখুন, এ দেশীয় পুলিশরা আত্মসমর্পণ করার পরও কোমলমতিদের ক্ষমা পায়নি, কিন্তু '৭১-এ পাক-মিলিটারি ও তাদের দোসররা এই কোমলমতিদের-পূর্বসূরির কাছেই ক্ষমা পেয়েছিল! এই কোমলরা কালক্রমে কতটা কঠিন হয়েছে সেটা এক আতঙ্ক এবং কতটা সক্ষম হয়েছে সেটা এক বিস্ময়!

আরও পড়ুন : জোরপূর্বক পরীক্ষা বাতিল হলে এ ব্যাচের উপর নেগেটিভ ট্যাগ লেগে যাবে: সাইয়েদ আব্দুল্লাহ 

কদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পুরোদমে চালু হবে এবং এই সমস্ত কোমলমতি  জেন-জি মুক্তিযোদ্ধারা, তাদের পূর্বসূরি-মুক্তিযোদ্ধাদের মত নিজস্ব ক্যম্পাসে ফেরত এসে ধুমধুরুম করবেন, এটা নাড়বেন, ওটা কাড়বেন এবং সমস্ত ক্ষোভ এই ক্যম্পাসসমূহে বিভিন্নভাবে ঝাড়বেন। যে শিক্ষকদের থেকে শিক্ষা নিতে হবে সেই শিক্ষকরাও রেহাই পাবেন না, যেমন পায় নি '৭১-এ। বিদ্যা যদি গুরুমুখী হয় তবে গুরু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে, প্রকারন্তরে বিদ্যা থেকেই মুখ ফিরিয়ে নেয়া হয়। শিক্ষা-ব্যবস্থাপনায় জড়িত সব্বাইর এগুলো ভাবা দরকার এবং ভাবতে যেয়ে '৭১ পরবর্তী ক্যম্পাসসমূহের চিত্র মাথায় রাখা সহায়ক হবে। বিশেষ করে ভেবে দেখুন, এই কোমলমতিরা পঞ্চাশ-বছর-আগের-কোমলমতিদের উচ্ছ্বাস স্বচক্ষে দেখেননি, তেমন কিছু জানেনও না কিন্তু বুঝতে এক মুহূর্ত দেরী হয়নি, অটো-পাস ইত্যাদি চেয়ে বসেছেন এবং পেয়েও গেছেন। এ বুদ্ধি তাদের কে দিল? কোথায় পেলেন? অনুমান করি, এগুলো কেউ তাদের বলেনি, নিজেরাই বুঝে নিয়েছেন, কারণ ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে’। যদিও সময়, শ্রম ও অর্থসাপেক্ষ তবুও অর্থবহ ‘সংস্কার’ প্রয়োজন সেই অন্তরে।

আরও পড়ুন :  আমাদের রেনেসাঁ, দেশ এবং দুধের মাছি সমাচার

এই কোমলমতিদের এখনই  ক্যম্পাসে ফেরত না পাঠিয়ে অন্য কোনও ব্যবস্থার অধীনে রেখে একদিকে, এদেরকে কুল-ডাউন করানো যায় ও অন্যদিকে, তাদেরকে দিয়ে, প্রাইমারি স্কুলগুলোতে ইন্টার্ন হিসেবে চাকরি দিয়ে, সেটাকে কোকারিকুলার কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, তার ক্রেডিট দেয়া যায়।      

আরও পড়ুন : মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের শিক্ষার্থীদের সমস্যার সমাধান কবে হবে? 

আচ্ছা,কোমলমতিদের বিপরীতে দামড়াদের বাটপাড়িটা লক্ষ্য করেছেন? স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচার করে, সাধারণ-নির্বাচন খেলো করে, সংসদকে তস্করদের-মস্করার আঙ্গিনা বানিয়ে, সমস্ত কিছুকে অকার্যকর অবস্থায় এনে, কোমলমতিদের-মধ্যেও-কোমলতম, জেন-জিদের কাঁধে ভর দিয়ে কোঁকাচ্ছে ‘নাতি ভাইয়েরা, আমরা আর পারছি না, বাঁচাও’। এই দাদুরা কখনও বলে কুকুর ঢিলাও, কখনও বলে রক্ত দাও, কখনও বলে গণতন্ত্র আনো, কখনও বলে রাস্তা-পরিষ্কার রাখো, কখনও বলে রাষ্ট্র-সংস্কার করো। কিন্তু এখনও বলে না, ‘গাড়ী, বাড়ি,নারী বাদ দিয়ে, সংসদে নিজেরা জারী থাকো’। ক্যয়সা টাউট! এদ্দিন নাতির বাবাচাচাকে খেলিয়েছে, এবার নাতিপুতিকে খেয়ে দিয়ে, পুরো একটা জাতিকে অপদার্থ প্রমাণের ধান্দা ফেঁদেছে। এই ফাঁদ এড়িয়ে যাবার অথবা কেটে বের হবার শক্তি, সাহস ও বুদ্ধি কোমলমতিদের হবে বলে আশা করা যায়। কারণ প্রথমত এরা কাউকে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করার কোনও যুক্তিও পায় না তাই নিজের উপর বিশ্বাস বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, এ দফায়, ইতোমধ্যেই তারা যা করেছে এবং যেভাবে করেছে সেটা অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয়! কোনও স্টান গ্রেনেড ছাড়াই পুলিশ, মিলিটারি, ক্যডার, র, ডিবি,ডিজি, সব্বাই স্টান্ড!

লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ