জয়নবের চূড়ান্ত সাফল্য দেখার আগে মৃত্যু সংবাদ কেন শুনতে হবে?

অথৈ আদিত্য
অথৈ আদিত্য  © সংগৃহীত

রমনা পার্কে হাঁটতে যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে আমি শিল্পকলা একাডেমিতে ঢুঁ মারি। ভাবখানা হচ্ছে, দেখে আসি ভিতরে কী চলছে এ মুহূর্তে। কোনদিন ভিতরে গিয়ে লোকগানের আসরে বসে গান শুনি, কোনদিন চিত্রপ্রদর্শনী দেখি, একদিন দু'দিন নাটকও দেখেছি। শরীর সুস্থ থাকলে এবং বেঁচে থাকার মতন পকেটে অর্থ থাকলে ঢাকায় বসবাস মন্দ নয়। Life is beautiful after all.

এইতো সেদিনের ঘটনা, ভিতরে গিয়ে দেখি, শিল্পকলা একাডেমিতে ‘ভ্রমণ কন্যা’ নামক নারীদের একটি অনলাইন সংগঠনের চিত্র প্রদর্শনী চলছে। আগ্রহ নিয়ে যথারীতি প্রবেশ করলাম এবং প্রবেশ করেই শাড়ি পরিহিত ছিমছাম যে মেয়েটি হাসিমুখে এগিয়ে এলো, প্রথমে চিনতে পারি নি কিন্তু ভাল করে তাকিয়ে দেখি, এ আমাদের জয়নব। আমার রৌমারী উপজেলার জয়নব। আরো স্পষ্ট করে বললে, আমার জয়নব।[ রৌমারীর প্রতিটি সন্তানকে আমি আমার আপন ভাই বা বোন বা সন্তানের মতন দেখি। 

জয়নবের সাথে আমার আমার পরিচয় প্রায় অর্ধ-যুগ। ইউএনও থাকাকালীন পদাধিকারবলে রৌমারীর প্রধান দুটি কলেজের সভাপতি হওয়ায় ওরা আমার সবাই সরাসরি শিক্ষার্থী, পরবর্তীতে কলেজে ক্লাসও নিয়েছি। জয়নব ঢাবির ক্রিমিনোলোজি (অপরাধ বিজ্ঞান) বিভাগে পড়াশুনা করে, থাকে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে, টিউশনি করে পড়াশুনা করে, সামনে ওর অনার্স ফাইনাল। দারিদ্র্য বা অভাব-অনটনের বিপরীতে রৌমারীর যে ক'জন ছেলে-মেয়ে কঠোর পরিশ্রম ও মেধাকে পুঁজি করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসেছে, জয়নব সেই অল্প ক'জনের একজন।

আমার সাথে দেখা হলে ওকে আমি ধরে নিয়ে গিয়ে এলিফ্যান্ট রোডের স্টারে খাওয়াতাম আর বলতাম, ‘তুমি জানো, তুমি আমার মোটিভেশনাল গল্পের অন্যতম উদাহরণ বা মডেল’। জয়নবের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যেতো, বলতো, ‘স্যার, আমি কী পারবো?’

তপোবন-২ নামক একটি অনলাইন গ্রুপে (তপোবন-১ হচ্ছে আমার নিজ গ্রামের ভার্সিটি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের গ্রুপ) আমি রৌমারীর কতিপয় ভার্সিটি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখাতাম। জয়নব গ্রুপের বাইরে মেসেঞ্জারে নক দিয়ে ইংরেজির এটা-ওটা জানতে চাইতো আর বলতো, ‘ইংরেজিটা আমাকে শিখতেই হবে, স্যার যেভাবেই হোক’ জয়নবের এই দৃঢ় সংকল্পের ঘোষণা আমার খুশি হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল। আমি ওকে বলতাম, জয়নবের জয় হবেই হবে!

তবে এই যে ঢাবির চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জয়নব শিল্পকলা একাডেমিতে আমাকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে জানালো, সে ভ্রমণ কন্যার একজন সদস্য বা স্বেচ্ছাসেবক এবং হঠাত করে আমাকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত জয়নব সেই সংগঠনের এর কাছে ওর কাছে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, আমি তার মেন্টর, সে আমার শিষ্য। আমি একটুও খুশি হলাম না।
চিত্র প্রদর্শনী বাদ দিয়ে জয়নবকে আমি আড়ালে ডেকে নিয়ে প্রায় রাগত স্বরে বললাম, এটি তোমার কোন ইয়ার, জয়নব? ফোর্থ ইয়ার, তাই না? তোমার এখন সময় আছে এসব করার? এসব কাজ প্রথম বর্ষ থেকে থার্ড ইয়ার পর্যন্ত করা ঠিক আছে। এখন তো তোমার মুখ বুঁজে পড়ার টেবিলে থাকার কথা, বিসিএস দিবা না?

কে না জানে, I am always good at giving advices! বলাই বাহুল্য, জয়নবের মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। জয়নবের মন খারাপের আরো একটি কারণ হচ্ছে, আমিই তাদেরকে বিভিন্ন সময় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার পরামর্শ দিয়ে এসেছি, আজ একই মুখে ভিন্ন কথা।

জয়নবের সাথে এটি আমার শেষ দেখা। এর মধ্যে ওর অনার্স শেষ হয়েছে, সেই খবর পেয়েছি কিন্তু আমি মন্ত্রীর পিএস হওয়ায় এবং ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় ওর সাথে দেখা করে ওকে অভিনন্দন জানাতে পারিনি। দুপুরে যখন প্রথমে রুনা ফোন দিল, ওর কান্নাজড়িত কথা বুঝতে পারিনি, ঢাবিতে সজীবকে কলব্যাক করলাম (সে আমাকে চেষ্টা করেও ফোনে পায়নি), কল পেয়ে সজীব বিস্তারিত জানালো।

ওদের দু’জনের কথা আমি একটুও বিশ্বাস করলাম না। আমি ফোন দিলাম বান্দরবনের রুমা উপজেলার ইউএনও মাহবুবকে, সে তখনই জানালো, ‘ইয়েস, চান্দের গাড়ী নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে গিয়ে যে দু'জন পর্যটক মারা গেছে তাদের মধ্যে একজন ছাত্রী’। ভয়ে আমার হাত কাঁপতে লাগলো, গলা শুকিয়ে গেল, কোন মতন বলতে পারলাম, ওর নাম জানতে পেরেছো? ‘জ-য়-ন-ব.....জয়নব, স্যার! বয়স আনুমানিক ২৪!’

আমি স্তম্ভিত হয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। আমার কেবলই মনে হতে লাগলো, জয়নবের এ মৃত্যুর জন্য কিছুটা আমি নিজে দায়ী। সেদিন শিল্পকলা একাডেমিতে ওকে যদি আমি নির্দেশ দিতাম, আজকেই তোমার সংগঠন করার শেষ দিন, তাহলে নিশ্চয়ই সে আজকে ভ্রমণ কন্যার সাথে বান্দরবান ঘুরতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে আসতো না আর আমাকে এই খবরও শুনতে হতো না। জয়নবের চূড়ান্ত জয় বা সাফল্য দেখার আগে ওর মৃত্যু সংবাদ আমাকে কেন শুনতে হবে? এ আমি কেমন অভিভাবক!

সাবেক ইউএনও, রৌমারী

(ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত)


সর্বশেষ সংবাদ