ডিপ্লোমা উত্তীর্ণরা কেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে না

উচ্চশিক্ষার পথে বৈষম্য নিরসন জরুরি

এস এম আতিয়ার রহমান
এস এম আতিয়ার রহমান  © টিডিসি ফটো

উচ্চশিক্ষালাভে দেশে শিক্ষার্থীদের বিপুল আগ্রহ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক সামর্থের চাইতেও বেশি। এদেশের একজন কৃষক, শ্রমিক, রিকশাওয়ালার মতো কম আয়সম্পন্ন মানুষের সন্তানও আজ উচ্চমাধ্যমিক পাস করে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধারভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষালাভ করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস দিয়ে বা ব্যাংকসহ বিভিন্ন পেশায় গিয়ে জীবনের স্বপ্ন পূরণ করতে পারছে। হয়তো সামগ্রিকভাবে এ সংখ্যা কম। যে সংখ্যায় পাস করছে সেই তুলনায় বেকারের সংখ্যা বেশি। 

তবে বেসরকারি চাকরি ছাড়াও স্বকর্মসংস্থান ও উদ্ভাবনমূলক পেশাতেও যুক্ত হচ্ছে উচ্চশিক্ষিত তরুণরা, আবার বিদেশেও যাচ্ছে অনেকে। এই যে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের সন্তান আজ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে এটার ইতিবাচক দিকই বেশি। বেকার বা কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে অনেকেই বলে থাকেন সবার উচ্চশিক্ষার দরকার নেই। কিন্তু কাকে আপনি বাঁধা দেবেন, বারিত করবেন? 

তবে এটা ঠিক বিপুল সংখ্যক উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশী তারুণ্যকে বিশ্বের চাহিদার দিকে সঙ্গতি রেখে কারিগরি শিক্ষার সুযোগ দিলে তারা দক্ষ জনসম্পদে পরিণত হতে পারে। বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষা দর্শনে আমরা দেখতে পাই ন্যায্যতা, সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা। একথা বলতে গিয়ে তিনি সবসময়ই কৃষক, শ্রমিকের কথা বলেছেন, তাদের সন্তানদের শিক্ষার কথা চিন্তা করেছেন। তাঁর আজীবন সেই নায্যতা ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্নের বড় প্যারামিটার হচ্ছে সাধারণ মানুষ, সাধারণ শ্রেণি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ড. কুদরত-ই খুদার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু যে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করেন সেই কমিশনের রিপোর্টে উচ্চশিক্ষার সুযোগে নানামাত্রিক দিকনির্দেশনা ছিলো। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি।

জাতিসংঘে শিক্ষাকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একথাও বলা হয়েছে যে, শিক্ষালাভে কাউকে বারিত করা যাবে না। অর্থাৎ কেউ চাইলে শিক্ষার পরবর্তী স্তরে যেতে পারবেন, বয়স সেখানে কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ অবারিত রাখতে হবে। আমাদের দেশে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর ৮০-৮৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষালাভে আগ্রহী হয়। এটা বিশ্বজনীন উপাত্তে অনেক উপরের স্থান। উচ্চশিক্ষালাভে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ভর্তি হতে না পেরে, সামর্থ ও সামাজিক কারণ, অথবা উপার্জনের চিন্তায় ১৫-২০ শতাংশ শিক্ষার্থী ডিপ্লোমা বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কোর্সে ভর্তি হয়ে থাকে। এই সংখ্যাও প্রায় দুই লাখের বেশি। এদের মধ্যেও মেধাবী আছে। 

নিবন্ধের শিরোনামে যে বিষয়টিতে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে সেখানে প্রাসঙ্গিকভাবেই দেশে ডিপ্লোমা শিক্ষার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি, ফিশারিজ, ফরেস্ট্রি, মেডিকেল এ্যাসিসট্যান্টের মতো অনেক বিষয়ে যারা চারবছর মেয়াদী কোর্স সম্পন্ন করে তারা কিন্তু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না। কেবল ডুয়েটে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা শিক্ষার্থীরা কিছু আসনে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়। কিন্তু, কৃষি ডিপ্লোমা,ম্যাটস বা অন্যান্য ডিপ্লোমাধারীরা এক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। দীর্ঘদিন ধরে অনেক শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ এমনকি শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেকেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগের ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া উচিৎ বলে উল্লেখ করেছেন। 

তবে বিষয়টিতে কেউ আপত্তি করেন না, কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীরা তো চার বছরের কোর্স সম্পন্ন করে। উচ্চমাধ্যমিকের তুলনায় তাদের কোর্সক্রেডিট বেশি। তা ছাড়া তারা তো বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণদের সমমানের ওপরে। একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জানিয়ারিং পাস, ডিপ্লোমা কৃষি, অথবা এ্যাসিসট্যান্ট মেডিকেল কোর্স সম্পন্নকারীর বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অবশ্যই বেশি। তারা ডিপ্লোমা পাস করে সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি বা এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির সুযোগের দাবি রাখে। তারা যদি উক্ত কোর্সে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হতে পারে তবে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণদের থেকে পিছিয়ে থাকবে না বা খারাপ করবে না এটা ধরে নেওয়া যায়। সেটা অবশ্য দেখার বিষয়। 

তবে এটা ঠিক বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন, জাতিসংঘের সনদ ও সামাজিক ন্যায্যতা ও সমতার বিচারে দেশে ডিপ্লোমা উত্তীর্ণরা পরবর্তী শিক্ষার ধাপ উচ্চশিক্ষা লাভের অধিকার রাখে। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খানের সাথে এ ব্যাপারে কথা হলে তিনি বলেন ‘এটা ঠিক ডিপ্লোমা উত্তীর্ণদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ অবারিত রাখার দরকার। এটা অনেক স্তরেই আলোচিত হয়। কিন্তু, তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কেবল ডুয়েটে এবং বেসরকারি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সুযোগ আছে। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজে নেই। তিনি আরও বলেন, তারা মেধার ভিত্তিতেই প্রতিযোগিতা করবে। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যকও যদি ভর্তি হতে পারে তবে অসুবিধা কোথায়? বরং, এটা ডিপ্লোমা শিক্ষার মর্যাদা ও আগ্রহ বাড়াবে।’

 বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটিশন কাউন্সিলের সাবেক সদস্য, সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. সঞ্জয় কুমার অধিকারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বিষয়টির যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেন যে, তিনি সদস্য হিসেবে কাজ করার সময় বিষয়টি সামনে এনেছিলেন। কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দ এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন। তারা উচ্চশিক্ষার যে নতুন বিশ্বমানের কারিকুলার গাইডলাইন ওেড়ান্ত করেছেন সেখানে এ সুযোগ রাখার বিষয়টি সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলে আশা করছেন। এটা অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কমিটি বিবেচনা করলেই হয়-অভিমত দিলেন তিনি।

আগামী বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কথা ভাবা হচ্ছে। ইতোমধ্যে শিক্ষামন্ত্রণালয় ও ইউজিসি বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। সেখানে ডিপ্লোমা উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের ভর্তিপরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হোক এটা প্রত্যাশা অভিজ্ঞমহলের। একই সাথে এমবিবিএস কোর্সে যে ভর্তি পরীক্ষা হয় সেখানে তদসংশ্লিষ্ট ডিপ্লোমা উত্তীর্ণদেরকেও ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। 

বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব সরকার। শিক্ষা ক্ষেত্রে এসময় জেলায় জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ঘোষণা দিয়ে কাজ করছেন সেখানেই বোঝা যায় বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন প্রতিফলনের অভিলক্ষ্য রয়েছে। কেবল বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনই নয়, বিশ্বের সমসামিয়ক সময়োপযোগী ও প্রয়োজনমুখী শিক্ষার ধারা অন্তর্ভুক্ত করে আমাদের বিপুল সংখ্যক তরুণ সমাজকে শিক্ষিত ও দক্ষ বিশ্বজনীন জনশক্তি রূপে গড়ে তুলে বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট ও উন্নত  করতে কাজ করে যাচ্ছেন। আশা করা যায় এদেশে বেশ কয়েকটি কোর্সে যারা ডিপ্লোমা পাস করেন তাদের দীর্ঘ দিনের দাবি উচ্চশিক্ষায় ভর্তির সুযোগে অন্তত ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারটি তিনি দেখবেন। 

একই সাথে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের ডুয়েটে উচ্চশিক্ষা লাভে সুযোগদানের মতো কৃষি প্রশিক্ষায়তনের কোনো একটি বা দুইটিতে অনুরূপ রূপান্তর করা যেতে পারে। মেডিকেল প্রসঙ্গেও একই নীতিমালা অনুসরণ করা যেতে পারে। বর্তমান সরকার ডুয়েটের মতো রংপুর ও রাঙ্গামাটিতে নতুন ২টি ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং এ উচ্চশিক্ষার যে সুযোগ সৃষ্টির উদ্যোগ নিচ্ছে সে ক্ষেত্রে কৃষি, চিকিৎসা বা অন্যান্য ডিপ্লোমা উত্তীর্ণদের জন্য এরূপ প্রতিষ্ঠান তৈরি করে বিশেষায়িত শিক্ষার সুযোগ রাখা যায়। 

তবে সমন্বিত ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা, কৃষি গুচ্ছ বা মেডিকেলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আওতায় সুযোগ রাখা হলে নতুন কোনো নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে এ সুযোগ না রাখলেও চলে। সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সাথে বসে একটি সমাধানে আসা যায় বলে অভিজ্ঞ মহলের অভিমত।

লেখক: পরিচালক (পিআরএল), জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় 


সর্বশেষ সংবাদ