বন্ধুত্ব ভাঙার যন্ত্রণা নিয়ে কথা বলি না কেন?

বন্ধুত্ব
বন্ধুত্ব  © সংগৃহীত

২০১৯ সালের এক বসন্তকালীন দিন। ঠিক তখনই জীবনের প্রথম বড় বন্ধুত্বটি ভেঙে যায় আমার। তিক্ত বাকবিতণ্ডা, অশ্রু ও হতাশার মধ্য দিয়ে সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটে। তারপর থেকে আর কখনও কথা হয়নি আমাদের।

এই ভাঙনের বেদনাবোধ বহুদিন আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। আজ পাঁচ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, তবুও কখনও কখনও মনে পড়ে সেই বন্ধুর কথা। ভাবি, আদৌ কি কোনোদিন আবার যোগাযোগ হবে আমাদের?

তবে এখন এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই একধরনের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা জন্মেছে। যতদিন সম্পর্ক ছিল, সেটা ছিল অসাধারণ—এই স্বীকৃতিই যেন সান্ত্বনা।

মজার বিষয় হলো, এই ঘটনার ঠিক পাঁচ মাস পরই আমার প্রথম প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্কও শেষ হয়ে যায়। কিন্তু অবাক করার মতোভাবে প্রেমের বিচ্ছেদটিকে মোকাবিলা করা অনেক সহজ লেগেছিল আমার কাছে।

এর কারণ খুঁজে পাই সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতায়। সিনেমা, গান, বই—সবখানেই প্রেমের বিচ্ছেদ বারবার উঠে এসেছে। প্রেম হারানোর গল্প যেন খুব পরিচিত, আমরা যেন সেই বেদনার জন্য প্রস্তুত থাকি। কিন্তু বন্ধুত্ব ভাঙা? সেটি নিয়ে তো আমরা প্রায় কথাই বলি না।

বন্ধুত্ব নিয়ে গবেষণা কম, অনুভব অনেক
ইতিহাস কিংবা মনস্তত্ত্বের পাতায় অন্য সম্পর্ক নিয়ে বিস্তর গবেষণা থাকলেও বন্ধুত্বের ওপর মনোযোগ তুলনামূলকভাবে কম। অথচ বন্ধুত্ব মানসিক প্রশান্তি, সামাজিক সমর্থন এবং সামগ্রিক সুস্থ জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গ্রেস ভেইথ, ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটার একজন সামাজিক মনোবিজ্ঞানী, বন্ধু বিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করছেন। তার মতে, ‘মানুষ হয়তো অবাক হবেন যে বন্ধুত্বও ভেঙে যায়! গবেষণার ক্ষেত্রেও এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।’

বন্ধুত্ব ভাঙার পর কীভাবে মানিয়ে নেওয়া যায়, কীভাবে সেই আবেগীয় দুঃখ সামলানো যায়—এখনো সেই পথে আমরা অনেকটাই অন্ধকারে। কেননা বন্ধুত্বের সমাপ্তির কোনো নির্দিষ্ট রীতি নেই, কোনো চেনা কাঠামো নেই।

বন্ধু মানেই অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক?
প্রথম সামাজিক সম্পর্ক হয় আমাদের পরিবারে—পিতামাতা কিংবা অভিভাবকদের সঙ্গে। তবে কৈশোরে পা দিয়েই আমরা দৃষ্টি ফেরাই সমবয়সীদের দিকে। তখন সামাজিক মর্যাদা, গ্রহণযোগ্যতা হয়ে ওঠে মুখ্য।

কেইটলিন ফ্ল্যানেরি, নিউ ইয়র্কের স্টেট ইউনিভার্সিটি কলেজ, কোর্টল্যান্ডের সহকারী অধ্যাপক, বলেন, “বন্ধুরা আমাদের আত্ম-পরিচয় গঠনে সহায়তা করে। তারা আমাদের জীবনের আয়না, দিকনির্দেশক, এবং স্বীকৃতিদাতা।”

ভেইথ বলেন, বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে মিলের ওপর ভিত্তি করে—ব্যক্তিত্ব, আগ্রহ, পারিপার্শ্বিকতা। কিন্তু এই সম্পর্কগুলো সবসময় টেকে না।

গবেষণা বলছে, শিশুবয়স ও কৈশোরে বন্ধুত্ব ভাঙা খুবই সাধারণ ঘটনা। উদাহরণস্বরূপ, মিজ ফ্ল্যানেরির গবেষণায় দেখা গেছে, ১১–১৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ৮৬ শতাংশ জানায়, তারা কোনও না কোনও বন্ধুত্ব শেষ করেছে।

কারণ? অধিকাংশ সময়েই ঝগড়া বা বিশ্বাসঘাতকতা। কখনও আবার বন্ধুর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সমর্থন না পাওয়া বা সম্পর্কের আনন্দ হারিয়ে ফেলা।

সব বিচ্ছেদ এক নয়
বন্ধুত্ব ভাঙলে শুধু বেদনা আসে না—আসে স্বস্তি, কখনও আনন্দও। বিষয়টা নির্ভর করে কী কারণে সম্পর্ক ভেঙেছে, কে সেটা শেষ করেছে, এবং কীভাবে সেটা ঘটেছে।

সব বন্ধুত্ব নাটকীয়ভাবে শেষ হয় না। অনেক সময় তা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়, ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ থেকে নেমে আসে ‘সাধারণ পরিচিত’তে।

১৯৮০-এর দশকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের বন্ধুত্ব ভাঙার প্রধান পাঁচটি কারণ হলো: দূরত্ব, অপছন্দ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া, অন্য সম্পর্কের প্রভাব (যেমন প্রেম/বিয়ে), এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কের মলিন হয়ে যাওয়া।

দূরত্ব সাধারণ বন্ধুর ক্ষেত্রে বেশি প্রভাব ফেলে, কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে সংযোগের অভাব কিংবা প্রেমের প্রভাবই বড় কারণ।

তবে সত্যিকারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব অনেক সময় জীবনের বিবর্তনের মাঝেও টিকে থাকে। ভেইথ বলেন, “আমি যতবারই বন্ধুত্বের সমাপ্তি দেখি, বুঝি—বহুস্তরীয় জটিলতা আছে। আবার বহু উদাহরণ দেখি যেখানে পরিবর্তনের মাঝেও বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়েছে।”

নারী বনাম পুরুষ: ভিন্ন বাস্তবতা
বন্ধুত্বের কাঠামো এবং প্রত্যাশায় লিঙ্গভেদে বিশাল পার্থক্য দেখা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রাপ্তবয়স্কদের এক জরিপে দেখা যায়, অধিকাংশ মানুষের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা তাদেরই লিঙ্গের। মেয়েরা সাধারণত মানসিক ঘনিষ্ঠতায় বিশ্বাস করে, আর ছেলেদের বন্ধুত্ব নির্ভর করে একসাথে সময় কাটানো বা কার্যক্রমে অংশগ্রহণে।

ফ্ল্যানেরির মতে, মেয়েরা তাদের বন্ধুত্বে বেশি সময় দেয় এবং সম্পর্কের মানদণ্ডও বেশি কঠোর রাখে। তাই নারীদের বন্ধুত্বে বিরোধ হলে তা অনেক বেশি আবেগীয় প্রভাব ফেলে।

তারা ভোগে দীর্ঘস্থায়ী কষ্টে, অনুভব করে একাকিত্ব এবং মানসিক চাপ। ছেলেদের তুলনায় নারীরা অনেক সময় ঝগড়ার পরে মিটমাট করতেও বেশি সময় নেয়।

কখনও কখনও কিছু সম্পর্ক ছেড়ে দেওয়া ভালো। বিশেষ করে টক্সিক বন্ধুত্ব—যেগুলো দুঃখ, ক্লান্তি, বা আত্মবিশ্বাসে ঘাটতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে এমন সম্পর্ক শেষ করাটাও সহজ নয়। সরাসরি বিচ্ছেদের পরিবর্তে অনেকেই বেছে নেয় “ঘোস্টিং”—সম্পর্ক থেকে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।

১৮–২৫ বছর বয়সীদের এক জরিপে দেখা গেছে, বন্ধুত্ব ভাঙার পেছনে প্রধান কারণ ছিল বিষাক্ত পরিবেশ, আগ্রহ হারানো, বিরক্তি, এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষার প্রয়োজন।

অনেক সময় দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বও এইভাবে, ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে শেষ হয়ে যায়।

ভেইথের মতে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব রক্ষা করতে হলে আমাদের শিখতে হবে কনফ্লিক্ট হ্যান্ডল করা। প্রেমের সম্পর্কের মতোই বন্ধুত্বেও ঝগড়া সামলানো জরুরি।

“আমরা ধরেই নেই বন্ধুত্ব মানেই সবসময় আনন্দময় হতে হবে। তাই যখন মতবিরোধ আসে, আমরা সেটি মোকাবিলা না করে পিছু হটি।”

রোমান্টিক সম্পর্ক আর বন্ধুত্ব—দুই জায়গাতেই আবেগ থাকে। পার্থক্য হলো, প্রেমের ক্ষেত্রে একগামিতার প্রত্যাশা থাকে; বন্ধুত্বে নয়। ফলে যখন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নতুন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়, তখন অনেকেই ঈর্ষায় ভোগেন।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এক বন্ধুর ঘনিষ্ঠতা অন্য বন্ধুত্বকে হুমকির মুখে ফেলবে না।

আমরা কি পুরনো বন্ধুত্বে আবার ফিরে যেতে পারি? ফ্ল্যানেরি বলেন, “সবটা নির্ভর করে সেই সম্পর্কের গঠন আর আপনার বর্তমান অবস্থার ওপর।”

যদি সেই বন্ধুত্বের অভাব সত্যিই অনুভব করেন, যদি মনে হয় সেটি আপনার জীবনে ভালো প্রভাব ফেলত—তবে আবার চেষ্টা করা যেতেই পারে। কারণ, সত্যিকারের বন্ধুত্ব—সেইটিই তো জীবনকে সুন্দর করে তোলে।


সর্বশেষ সংবাদ