মেডিকেলে পদোন্নতিতে বাধা

বিশেষজ্ঞ জ্ঞান কম পাচ্ছেন হবু ডাক্তাররা

সরকারি মেডিকেল কলেজ
সরকারি মেডিকেল কলেজ  © লোগো

দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে সিনিয়র শিক্ষক (অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক) সঙ্কট চরমে পৌঁছেছে। ক্লিনিক্যাল বিষয়সমূহের মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মেডিসিন বিভাগেও চলছে একই সঙ্কট। বিভাগটিতে সহকারী অধ্যাপক পদে অতিরিক্ত শিক্ষক থাকলেও বাকি সিনিয়র দুই পদে চরম সঙ্কট তৈরি হয়েছে।

মেডিসিন বিভাগে অধ্যাপক সঙ্কট থাকা বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে আলাপকালে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের ঘাটতির কথা উঠে আসে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ কলেজে কোন অধ্যাপক না থাকায় সহকারী অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপকদের পাঠদান দিয়েই এমবিবিএসসহ বিভিন্ন উচ্চতর ডিগ্রি পাশ করে বের হচ্ছে এসব মেডিকেল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা।

দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে চার পদের শিক্ষক থাকেন। প্রতিটি বিভাগে সর্বোচ্চ এক বা একাধিক অধ্যাপক, এরপর সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক পর্যায়ের শিক্ষকরা থাকেন। জানা গেছে, শিক্ষক সঙ্কটে থাকা এসব কলেজে যথাযথ বিশেষজ্ঞ জ্ঞান পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা। ঘাটতি অবস্থাতেই ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছেন তারা।

বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজের লোগো

জানা যায়, দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগে ২৪৬ পদের বিপরীতে সিনিয়র দুই পদে (অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক) রয়েছে মাত্র ৮৬ জন শিক্ষক। বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের এই দুই পদের ১৬০টিতেই ফাঁকা। এরমধ্যে অধ্যাপক পদে ৬৪টি এবং সহযোগী অধ্যাপক পদে ৯৬টিতে ফাঁকা রয়েছে। ২৩০ জন সহকারী অধ্যাপক থাকলেও এতে রয়েছে ১৭৯টি পদ। অতিরিক্ত ৫১ জন সহকারী অধ্যাপক সহ সারাদেশের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এই বিভাগটিতে মোট ৩১৬জন শিক্ষক রয়েছে। 

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। চলতি বছরের মার্চ মাসের হিসেব অনুযায়ী তৈরি করা এই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক সবমিলে পদসংখ্যা ৪২৫টি হলেও মোট পূরণকৃত পদ ৩১৬; অর্থাৎ ১০৯টি শূন্য পদ নিয়েই চলছে বিভাগটির কার্যক্রম।

আরও পড়ুনঃ যাকে-তাকে দিয়ে হাত-পা টেপাতেন ছাত্রলীগ নেতা, ব্রাশও করাতেন

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে শুধুমাত্র ২টি প্রতিষ্ঠানের মেডিসিন বিভাগেই পর্যাপ্ত অধ্যাপক রয়েছে। মানিকগঞ্জের কর্ণেল মালেক মেডিকেল কলেজ এবং রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে এই বিভাগে ১টি করে পদ রয়েছে। পদ সংখ্যা অনুযায়ী অধ্যাপক নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে শুধুমাত্র এই দুই প্রতিষ্ঠানের মেডিসিন বিভাগ। এছাড়া দেশের ৩৫ মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগেই পদসংখ্যার বিপরীতে অধ্যাপক পদে অপ্রতুলতা রয়েছে। এরমধ্যে শূন্য অধ্যাপক নিয়েই চলছে ২২ মেডিকেল কলেজের এই বিভাগ। 

মেডিসিন বিভাগে কোন অধ্যাপক না থাকা কলেজগুলোর মধ্যে রয়েছে নোয়াখালীর আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ, সুনামগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ, চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, যশোর মেডিকেল কলেজ, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ, মাগুরা মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, নওগাঁ মেডিকেল কলেজ, নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজ, নীলফামারী মেডিকেল কলেজ, পাবনা মেডিকেল কলেজ, পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, জামালপুর শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, টাঙ্গাইল শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ এবং বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ।  

দু’টি মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগে সর্বোচ্চ ৬টি করে অধ্যাপক পদ ফাঁকা রয়েছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ এবং বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের এই বিভাগটিতে ৬ পদের সবকটি ফাঁকা রয়েছে। ৬ পদ থাকলেও ১জন অধ্যাপক নিয়ে চলছে রংপুর মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগ। এই বিভাগে বাকি ৫টি অধ্যাপক পদ-ই ফাঁকা রয়েছে। ৯টি পদ থাকলেও ৫জন অধ্যাপক নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগ। এই বিভাগটিতে অন্য ৪টি পদ ফাঁকা রয়েছে। ৪ পদ ফাঁকা রয়েছে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগেও। ৬ পদ থাকলেও ২ জন নিয়ে চলছে এই বিভাগ।

ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

এছাড়া ৬ মেডিকেলেই অধ্যাপক পদসংখ্যার বিপরীতে ৩টি করে ফাঁকা রয়েছে। গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল ও দিনাজপুরের এম আব্দুর রহীম মেডিকেল কলেজে ৩ পদের সবক‘টি ফাঁকা। রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজেও অধ্যাপক পদে ৩টি করে ফাঁকা রয়েছে। ৬টি করে পদ থাকলেও এই তিন নামকরা মেডিকেলে ৩জন করে শিক্ষক রয়েছেন শীর্ষ বিশেষজ্ঞ এই পদে। ৪টি পদ থাকলেও ১জন অধ্যাপক নিয়ে চলছে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ। এই কলেজেও শীর্ষ এই পদের ৩টিই ফাঁকা।

আরও ৬টি মেডিকেলে ২টি করে পদ ফাঁকা থাকায় পদসংখ্যা অনুযায়ী অপর্যাপ্ত রয়েছে অধ্যাপক। এসব কলেজের মধ্যে রয়েছে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ, খুলনা মেডিকেল কলেজ, গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ, বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ এবং কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ।  

ডাক্তার হতে যথাযথ বিশেষজ্ঞ জ্ঞান বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের। এই কলেজের ৪র্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, আমাদের মেডিসিন বিভাগে কোন অধ্যাপক নেই। ফলে এই বিভাগের সংশ্লিষ্ট কোর্সসমূহ বিভাগের জুনিয়র শিক্ষকদের দ্বারাই পড়ানো হয়। তিনি বলেন, একজন জুনিয়র শিক্ষক কখনোই একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের ন্যায় পাঠদান করাতে পারবে না। মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরকে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কিছুদিন আগে এই কলেজের অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে সিনিয়র শিক্ষক সঙ্কটের কথাও জানানাে হয়েছে বলে জানিয়েছে এই শিক্ষার্থী। 

“আমাদের এমবিবিএস, এমডি এবং এফসিপিএস একসঙ্গে পড়াতে হয়। এতে কম সংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষক হওয়াতে সব শ্রেণিতে পাঠদান করাতে হিমশিম খেতে হয়। অধ্যাপক থাকলে আরেকটু গুণসম্পন্ন শিক্ষা এবং চিকিৎসা দেওয়া যেত-অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল কাদের, অধ্যক্ষ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ

অধ্যাপক সঙ্কট রয়েছে বিধায় মেডিসিনের কোর্সসমূহ সহকারী অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপকরাই নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেলের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মনির হোসাইন। তবে এই শিক্ষার্থীর ভাষ্যমতে, ওই শিক্ষকরা জুনিয়র পদগুলোতে থাকলেও সিনিয়র অধ্যাপকদের মতই পাঠদান করেছেন। 

অনেক শিক্ষক অধ্যাপক পদে পদন্নোতি পাওয়ার সকল যোগ্যতা পূর্ণ করলেও যথাসময়ে পদোন্নতি পাচ্ছে না বিধায় এমন সঙ্কট তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পদোন্নতিজনিত সমস্যার ফলে সিনিয়র পদগুলোতে সঙ্কট দেখা দেয় বলে মন্তব্য করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ। তিনি বলেন, অনেক শিক্ষক রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েও পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন। এটা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি জুনিয়রদের সময়মত পদোন্নতি হয়ে গেলে এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠা সহজ হবে।

অধ্যাপকদের পাঠদান জুনিয়র শিক্ষকদের চেয়ে ভিন্ন হবে বলে মনে করছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল কাদের। তিনি বলেন, আমাদের জুনিয়র পদে শিক্ষক যারা আছেন তাদের অভিজ্ঞতাও বেশ ভালোই। তবে আমাদের অধ্যাপক পদসমূহ পরিপূর্ণ হলে আরও ভালো শিক্ষা ও চিকিৎসা দেওয়া যেত। 

তিনি আরও বলেন, আমাদের এমবিবিএস, এমডি এবং এফসিপিএস একসঙ্গে পড়াতে হয়। এতে কম সংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষক হওয়াতে সব শ্রেণিতে পাঠদান করাতে হিমশিম খেতে হয়। অধ্যাপক থাকলে আরেকটু গুণসম্পন্ন শিক্ষা এবং চিকিৎসা দেওয়া যেত। এখন চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোয়ান্টিটি ঠিক থাকলেও কোয়ালিটি অনেক সময় ঠিক থাকে না। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকটি সরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, সময় মত পদোন্নতি বোর্ডগুলো হলে এই সমস্যা অনেকটাই কেটে যেত। যেখানে ৩ বছর পরেই একজন সহকারী অধ্যাপক পদোন্নতি পেয়ে সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার কথা। সেখানে যথাসময়ে পদোন্নতি না হওয়াতে ৭-৮ বছরেও তারা পূর্বের পদেই থেকে যান। 

তিনি আরও বলেন, অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় সময় পার হয়ে গেলেও বোর্ড না হওয়াতে ঠিকমতো পদোন্নতি পাচ্ছেন না। আবার যখন পদোন্নতি বোর্ডের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাওয়া হয়, তখন দেখা যায় অনেকের সময় পূর্ণ না হওয়া সত্বেও প্রভাব খাটিয়ে পদোন্নতির জন্য আবেদন করেন। ফলে নানাবিধ সমস্যার কারণে পদোন্নতি বোর্ড ঠিকমত হয় না। ফলে দেখা যায় যিনি ৮ বছরে প্রফেসরের জন্য আবেদন করতেন। তাঁর এই পদে আবেদন করতে সময় লেগে যায় ১২-১৪ বছর। এতে দেখা যায় সিস্টেম লসের কারণে এই সমস্যাটি দেখা দেয়। 

দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজের তুলনায় সিনিয়র শিক্ষক কম রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। তিনি মনে করেন, সক্ষমতা বৃদ্ধি না করে নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠা করাতে এই সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

তিনি বলেন, নতুন মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করার আগে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করার পাশাপাশি সিনিয়র শিক্ষক বাড়ানো দরকার। 


সর্বশেষ সংবাদ