এরপর সিস্টেম তোমাকে চেঞ্জ করে দেবে

আমিনুল ইসলাম
আমিনুল ইসলাম  © সংগৃহীত

থানা পর্যায়ের এক শহরে একটা রাজনৈতিক দলের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে একজন সিএনজি ড্রাইভারকে মার খেতে হয়েছে আজ। তার দোষ কি জানেন? একই দলের এই দুই গ্রুপের লোকজন সিএনজি স্ট্যান্ডের দখল কে নেবে; এই নিয়ে নিজেদের মাঝে মারামারি করছে গত কয়েক দিন ধরে। তো এই ড্রাইভার স্ট্যান্ড থেকে বের হবার সময় এক গ্রুপ এসে তাকে আচ্ছা মত মেরেছে। কারণ সে অন্য গ্রুপকে টাকা দিয়েছে! সে জানতো না- ঠিক কাকে টাকা দিতে হবে। এই ড্রাইভারকে আমি চিনি। কারণ সে আমার পরিচিত। 

তার মা আমাকে ফোন করে আজ বলেছে, ‘ওরা আমার ছেলেকে শুধু মারেই নাই, হুমকি দিয়েছে ওদিকে আবার গেলে নাকি ওর খবর আছে।’ 
আমি শেষমেশ ওই এলাকার ইউএনওকে জানিয়েছি। তিনি জানিয়েছেন- ব্যাপারটা  দেখবেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- অন্যান্য সিএনজি ড্রাইভার কিংবা এই শ্রেণীর মানুষদের কি একটা জীবন কাটিয়ে দিতে হবে দলগুলোর কাছে চাঁদা দিয়ে? 

ছেলেরা, তোমাদের কিছু কথা বলি। আগের সরকারের আমলেও লেখার মাধ্যমে পরামর্শ দিতাম, বার্তা দিতাম। উনারা বেশিরভাগ সময়ই আমলে নিত না। এখন পরাজিত হয়ে এই আমার মত লেখকদের ওপর অনেক ক্ষোভ উনাদের। যা ইচ্ছে বলে বেড়াচ্ছে। এতেও কিছু মনে করছি না; বললে বলুক। অতি ক্ষুদ্র একজন মানুষকে গুরুত্ব দিচ্ছে বলেই না বলে বেড়াচ্ছে। এখন এরা সমালোচনা করছে। আমি জানি, এরাই আবার দিন কয়েক পরে আমার লেখা পড়ে প্রশংসা করবে। তখন বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সরকারগুলোর সমালোচনা হয়ত করে বেড়াবো। এসবে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন এই যে তোমরা সেই আগের সিস্টেমের ফাঁদে পা দিয়েছ। এ থেকে কি তোমরা আদৌ বের হতে পারবে? বিপ্লব আর সংস্কারের মাঝে পার্থক্য টুকু কেন তোমরা প্রথম দিন থেকেই বুঝার চেষ্টা করলে না? 

তোমরা এখন যা করছো কিংবা করার চেষ্টা করছো; সেটাকে স্রেফ সংস্কারের চেষ্টা বলা যেতে পারে। একই সিস্টেমের মাঝে থেকে, একই পদ গুলো রেখে কিছু নতুন মানুষ বসিয়ে দিচ্ছ। অথচ বিপ্লব মানে হচ্ছে-একটা সিস্টেমের পুরো পরিবর্তন এবং সেটা করতে হবে দ্রুত। দেশের ক্লাস সিস্টেম, দেশের প্রশাসন, পুলিশ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ রুপে পাল্টে ফেলতে হবে এবং সেটা করা উচিত ছিল একদম সঙ্গে সঙ্গে। এতটুকু দেরি করাও উচিত ছিল না। 

কারণ দেরি করা মানেই হচ্ছে তুমি সিস্টেমে ঢুকে যাচ্ছ। এরপর সিস্টেম তোমাকে চেঞ্জ করে দেবে। তো, তোমরা কেন সেই একই পদ এবং প্রতিষ্ঠানগুলো রেখে সিস্টেমে ঢুকে গেলা? তোমরা কি পৃথিবীতে সফল যে বিপ্লবগুলো হয়েছে, সেগুলো নিয়ে সামান্য টুকু পড়াশুনাও করো নাই? 
আগে বিপ্লব; এরপর হচ্ছে বিবর্তন। এর মানে হচ্ছে একটা সরকার বদল মানেই বিপ্লব নয়। সেতো ৫৩ বছর ধরেই হচ্ছে। এরপর পুরো সিস্টেমকে সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে দিয়ে সেই সিস্টেমের বাইরে থাকা সম্পূর্ণ নতুন মানুষ দিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এরপর আস্তে আস্তে বিবর্তনের মাধ্যমে দেশ গঠন করা যেতে পারে যোগ্য এবং মেধাবীদের দিয়ে। অথচ তোমরা কি করলে?

সেই আগের ন্যারেটিভ ধরে রাখলে। ‘যোগ্য ও মেধাবী’ খুঁজে বের করে তাদের ওই একই সিস্টেমের মাঝে বসতে বললে। তো, গত ৫৩ বছরও তো আমাদের ‘যোগ্য ও মেধাবীরাই’ শাসন করেছে। হয়েছে কোন কিছুর পরিবর্তন? অসফল বিপ্লবগুলোর ইতিহাসও পড়ে দেখো। ওরা সরকার পতনের পর সাধারণ মানুষকে আর এক করতে পারে নাই। আমি তো এখন প্রতিদিন দেখি- দেশের প্রান্তে থাকা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়করা সেন্ট্রালের সমন্বয়কদের এটা-সেটা নিয়ে সমালোচনা করছে। সমালোচনা করার অভ্যাস ভালো। কিন্তু কেন এমনকি তোমাদের সহযোদ্ধারা মাত্র দেড় মাসে তোমাদের অনেককে ঔউন করতে চাইছে না? এসব কি ভেবে দেখেছো? 

এই যে তোমরা একটা আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটালে। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এলো। সেটা কি একদিনে সম্ভব হয়েছে? তোমাদের মগজে কি করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এত দ্রোহ তৈরি হয়েছে? কারা সেই দ্রোহ তৈরি করেছে? সেটা কি তোমরা ভেবে দেখেছো? এদের কেউ কি তোমাদের বিপ্লবী সরকারে আছে? নাকি আছেন সেই ঘুরে-ফিরে একই সিস্টেমে থাকা সংস্কারপন্থীরা? আর দেশের বুদ্ধিজীবীরা তো সেই আগের মত সভা-সেমিনার করে বেড়াচ্ছেন- ‘কেমন হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ’ শিরোনামে। তোমরাও সে সব অনুষ্ঠানে যাচ্ছো! মাঝে মাঝে এসব দেখে খুব অবাক লাগে! দেশের বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীরা সব সরকারের আমলেই তাবেদার ছিল। এখনও এর কোন ব্যতিক্রম দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু অবাক হচ্ছি এটা দেখে- তোমরাও কিন্ত এদের ফাঁদে পা দিয়েছো। 

‘ভবিষ্যতের বাংলাদেশ’ কেমন হবে সেটার আগে বরং ‘বর্তমান বাংলাদেশকে’ কেমন দেখছি। সেটা নিয়ে আলোচনা করো। আজ যে ছেলেটা দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে মার খেয়েছে। কিংবা দুই দিন আগে যে ছেলেটাকে রাস্তায় ফেলে মেরে ফেলা হয়েছে। সে কিংবা তাঁর পরিবারের লোকজনদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। আছে বর্তমান নিয়ে। 

আজ যে মানুষটা বাজারে গিয়ে নিজের বাচ্চার জন্য খাবার কিনতে পারছে না। যে মানুষটা গতকাল কাজ হারিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়েছে। সে তোমাদের মত এসি রুমে বসে ‘ভবিষ্যতের বাংলাদেশ’ নিয়ে চিন্তিত হয়। সে চিন্তিত তার পরের বেলা খাবার আর বেঁচে থাকার চিন্তায়! মনে রেখো এই দেশটা যদি সবার না হয়। যেখানে কে কোন দল করে, মত করে, কার কি ধর্ম, পেশা কিছুই দেখা হবে না। সাধারণ পরিসরে সবার অধিকার হবে সমান। রাষ্ট্র যদি এর থেকে ১৯-২০ও করে। সেটা হবে বৈষম্যের ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্র। বিপ্লব তখনই কেবল সফল হবে যখন দেশটা হবে সবার। সবাই ভাবতে শিখবে বিপদে রাষ্ট্রই আমার দেখভাল করবে।


সর্বশেষ সংবাদ