মাদ্রাসা উচ্চশিক্ষায় আগ্রহ কমছেই

মাদ্রাসা শিক্ষার্থী
মাদ্রাসা শিক্ষার্থী  © সংগৃহীত

আলিয়া মাদ্রাসার সর্বোচ্চ শিক্ষা ফাযিল-কামিল। এই দুই ডিগ্রীকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ন্যায় ডিগ্রী এবং মাস্টার্সের সমমান দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ফলে ফাযিল-কামিল সার্টিফিকেটধারীরাও সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে আবেদন করার সুযোগ পায়। তা সত্ত্বেও দিনদিন মাদ্রাসা ধারার উচ্চশিক্ষা তথা ফাযিল-কামিলের ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশ কমছে।

ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, আলিম পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফাযিলে ভর্তি হন না। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রতিযোগিতার বাজারে আধুনিক কারিকুলামে পিছিয়ে থাকা এবং ধর্মীয় শিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থী কমে যাওয়াই এই নিম্নমুখীতার জন্য দায়ী। এর ফলে আলিম পরীক্ষা দেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা তথা বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল ধারার উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থায় শিফট হয়ে যাচ্ছে। 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে,  অনেক মাদরাসায় ফাজিল ও কামিলে ১ম, ২য় ও ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী নেই, তবে পরীক্ষার্থী কিছু রয়েছে। ‌'শিক্ষার্থী না হয়েও কীভাবে পরীক্ষার্থী' বিষয়টির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করা শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনার্স-মাস্টার্স করলেও পাশাপাশি মাদ্রাসার ফাযিল-কামিলে রেজিস্ট্রেশন করেন। শুধু পরীক্ষার বিনিময়ে মাদ্রাসার 'নিয়মিত ছাত্র' হিসেবে ফাযিল-কামিলের সার্টিফিকেট অর্জন করেন তারা। যা তাদের এনটিআরসিএসহ বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতেও সহায়তা করে।

মাদ্রসা শিক্ষক এএসএম আব্দুল্লাহ দাবি করেন, ফাজিলে অনার্স চালু হওয়া মাদ্রাসা ছাড়া প্রায় সকল ফাযিল-কামিল মাদ্রাসায় এই দুই ক্লাসে নিয়মিত শিক্ষার্থী শুন্য। আলিম পাশের পর মেধাবী শিক্ষার্থীদের অনেকেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন, আবার কিছু শিক্ষার্থী ফাযিলের অনার্সে ভর্তি হচ্ছেন। আর বাদ পড়া শিক্ষার্থীদের খুঁজে খুঁজে ভর্তি করিয়ে তাদের মাধ্যমেই চলছে ফাযিল-কামিল মাদরাসার উচ্চশিক্ষার পরিবেশ। একই কারণে ঠিক থাকছে শিক্ষকদের বেতন-ভাতাও।

২০২০-এ ৮৮ হাজার ৩৪৭ জন আলিম পরীক্ষা দিলেও ফাযিলে এসে প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যায় 

ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মনে করেন, ঝরে পড়ার রীতি শুধু মাদ্রাসায় নয়, সব ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার মত, দাখিল-আলিমের পর অনেক কলেজে চলে যান, কেউ বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ভর্তি হন স্নাতকে ভর্তি হয়। তবে প্রকৃত তথ্য জানতে গবেষণা করতে হবে।

চিত্র বলছে, দাখিলের পর থেকেই  মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা ঝরতে থাকে। আবার অনেকেই উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর কামিল পর্যন্ত মাদ্রাসায় থাকছে না। এদের অধিকাংশ শিক্ষা জীবনের মাঝে এসে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেন। আবার অনেকে শিক্ষাজীবন সম্পন্ন না করেই চলে যান কর্মজীবনে। ফলে দাখিলের ব্যাচে থাকা শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশকে আলিমে পাচ্ছে না মাদ্রাসা বোর্ড। আবার আলিম সম্পন্ন করে আসলেও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফাযিলে থাকছে না এসব শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশ। 

‘ঝরে পড়ার রীতি শুধু মাদ্রাসায় নয়, সব ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে। দাখিল-আলিমের পর অনেক কলেজে চলে যান, কেউ বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ভর্তি হন স্নাতকে ভর্তি হয়। তবে প্রকৃত তথ্য জানতে গবেষণা করতে হবে।’— ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়

দেশের শিক্ষাখাতের তথ্য ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ, সংকলন এবং প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) প্রকাশিত বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২২-এ দেয়া তথ্যে মাদ্রাসার উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের বিমুখিতার এই চিত্র উঠে এসেছে। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে মোট ৯ হাজার ২৬৫টি  দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদরাসায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এতে নারী-পুরুষ মিলে মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৯২৭ জন শিক্ষক রয়েছেন। এসব মাদ্রাসায় বিভিন্ন শ্রেণীতে ২৭ লাখ ৫৫ হাজার ১৫০ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছেন। এসব শিক্ষার্থীর ৫৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ ছাত্রী, সবমিলে নারী শিক্ষার্থী রয়েছে মোট ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৪৭১ জন।

পড়ুন: নামাজ আদায় করে সাইকেল উপহার পেলো ১৭০ ছাত্র

জানা যায়, দাখিল পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমতে থাকে। আলিম পরীক্ষার পর অধিকাংশ শিক্ষার্থী হারায় মাদ্রাসাগুলো। ক্রমান্বয়ে প্রত্যেক শ্রেণিতেই উল্লেখযোগ্য হারে কমতে থাকে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। শেষ পর্যন্ত ফাযিল (পাস/ স্নাতক) শেষ করে আসা কামিল (মাস্টার্স)-এ এসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা পৌঁছায় সর্বনিম্ন স্তরে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাধ্যমিক স্তর তথা দাখিল সম্পন্ন করে অনেক শিক্ষার্থী বোর্ড স্থানান্তর করে। মাদরাসা থেকে দাখিল সার্টিফিকেট নিয়েই বিভিন্ন বোর্ডের অধীনে কলেজগুলোয় ভর্তি হন অনেক শিক্ষার্থী। আবার যারা উচ্চ মাধ্যমিক স্তর তথা আলিম পরীক্ষায় অংশ নেয়, এর বিশাল একটি অংশ আলিম সম্পন্ন করে মাদ্রাসা শিক্ষার ইতি টানেন। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদরাসা শিক্ষার ইতি টেনে সাধারণ শিক্ষায় স্থানান্তরিত হয়ে কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি হয়ে ভিন্ন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এছাড়াও কর্মমুখী শিক্ষার ঘাটতি থাকায় প্রতিযোগিতার বাজারে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে অনেকেই স্থান পরিবর্তন করে। আবার সব শ্রেণীতেই কিছু শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ে এবং নানা ধরণের কর্মক্ষেত্রে জড়িয়ে পড়ে বলেও মত তাদের। 

সারাদেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে মোট ৯ হাজার ২৬৫টি  দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদরাসায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এতে নারী-পুরুষ মিলে মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৯২৭ জন শিক্ষক রয়েছেন। এসব মাদ্রাসায় বিভিন্ন শ্রেণীতে ২৭ লাখ ৫৫ হাজার ১৫০ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছেন। 

তাদের ভাষ্য, মূলত আলিম পরীক্ষার পর থেকেই বেশি পরিমাণে ‍শিক্ষার্থী কমা শুরু হয় মাদ্রাসায়। আলিম পাস শিক্ষার্থীদের অনেকেই মাদরাসা শিক্ষাকে বিদায় জানিয়ে চলে যান কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে ফাযিল (পাস) এবং ফাযিল (স্নাতক) পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা থাকে নিম্নমুখী। 

ভর্তি হিসেব অনুযায়ী, সর্বশেষ ভর্তি সম্পন্ন হওয়া ২০২০-২১ সেশনের ফাযিল প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ৫৮ হাজার ৯৪৯ জন। ২০২০ সালে ৮৮ হাজার ৩৪৭ জন আলিম পরীক্ষা দিলেও ফাযিলে এসে কমে যায় প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এর আগে ২০১৯ সালে ৮৬ হাজার ১৩৮ জন আলিম পরীক্ষায় অংশ নিলেও ২০১৯-২০ সেশনে ফাযিল ১ম বর্ষে ভর্তি হন ৫৮ হাজার ৭০৩ শিক্ষার্থী। এই ব্যাচে ফাযিলে এসে কমে প্রায় ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী। ২০১৮-১৯ সেশনে ফাযিল প্রথম বর্ষে ৫৭ হাজার ৫৪৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। এই ব্যাচের  ৯৭ হাজার ৭৯২ জন ২০১৮ সালের আলিম পরীক্ষায় অংশ নিলেও ফাযিলে এসে তা থেকে ৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী কমে যায়। ২০১৭-১৮ সেশনে ৫৪ হাজার ৮৬ শিক্ষার্থী ফাযিল প্রথম বর্ষে ভর্তি হলেও এই ব্যাচে আলিম ২০১৭-তে অংশ নিয়েছিল ৯৬ হাজার ৮০২ জন পরীক্ষার্থী। এই ব্যাচে আলিম থেকে ফাযিলে আসতে কমে ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। 

১৭৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত সরকারি মাদ্রাসা-ই আলিয়া এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা হিসেবে বিবেচিত

২০১৫-১৬ সেশন থেকে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফাযিল (পাস) এবং ফাযিল (স্নাতক) এর কার্যক্রম শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, প্রথম বর্ষে মোট ৫২ হাজার ৭২৭ জন শিক্ষার্থী প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়। অথচ এই ব্যাচে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন শিক্ষার্থী আলিম পরীক্ষায় অংশ নেয়, আলিম থেকে ফাযিলে আসতে কমে ৩৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ৮৯ হাজার ৬০৩ জন আলিম পরীক্ষার্থী থেকে ৩৭ শতাংশ কমে ২০১৬-১৭ সেশনে ফাযিলে ভর্তি হয় ৫৬ হাজার ২২৯ জন শিক্ষার্থী।

‘খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে, আলিমে ভর্তি হওয়া ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফাযিলে ভর্তি হন না। এদের বড় একটি অংশই চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিকেল ধারার উচ্চশিক্ষায়’

শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ জানার কারণ জানার জন্য বিষয়টি গবেষণা করে দেখতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, সাধারণত ঝরে যাওয়ার একটি রীতি সবধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে। দাখিলের পর অনেক শিক্ষার্থী কলেজে চলে যায় এবং আলিমের পর বড় একটি অংশ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে ভর্তি হয়। অনেকে এলাকা পর্যায়ে মাদ্রাসা, মসজিদসহ বিভিন্ন কর্মে জড়িয়ে যায়। মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেকের বিয়ে হয়ে যায়। 

পড়ুন: শিক্ষক, ল্যাব ও রাসায়নিক সংকট নিয়ে চলছে ফার্মেসি শিক্ষা

নিচের দিকের শ্রেণীর মত উচ্চশিক্ষা পর্যায়েও বৃত্তির ব্যবস্থা থাকলে শিক্ষার্থী সংখ্যা আরও বাড়তো বলে মনে করেন ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ। তবে প্রকৃত সমস্যা খুঁজে বের করতে গবেষণা করা দরকার বলে মনে করছেন তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ