জন কিটস: ডাক্তারি ছেড়ে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন যিনি

জন কিটস
জন কিটস  © সংগৃহীত

অপরূপ সুন্দর কবি জন কিটসের জন্ম আজ থেকে প্রায় সোয়া দুই শ বছর আগে, ৩১ অক্টোবর ১৭৯৫ সালে, বিলেতে। তাঁকে সুপুরুষ না বলে সুন্দর বলার পেছনে কারণ আছে। প্রচলিত অর্থে যাকে বলা হয় পৌরুষ, সেটা তাঁর মধ্যে ছিল না। গড়পড়তা পুরুষের তুলনায় তাঁর শারীরিক উচ্চতা ছিল কম। শীর্ণকায় আয়ত চোখ ও কোঁকড়ানো লালচে খয়েরি চুলের এই কবি ছিলেন অসম্ভব মায়াময়। ৮ বছর বয়সে বাবা আর ১৪ বছরে মাকে হারিয়ে ছোট ভাইবোনদের নিয়ে বেড়ে ওঠা জন কিটসকে পরবর্তী সময়ে সবাই চিনেছেন সৌন্দর্যের কবি বলে। তাঁর কবিতা যিনি কখনোই পড়েননি, তিনিও শুনেছেন 'এন্ডিনিয়ন' কবিতার বিখ্যাত সেই চরণ, 'আ থিং অব বিউটি ইজ আ জয় ফর এভার’ । ব্রাইট স্টার সংকলনের কবিতা আর পত্রাবলি পড়লে তো মনে হবে, শুধু সৌন্দর্য নয়, তিনি প্রেমেরও কবি।

তবু এই সামান্য বর্ণনায় যেমন মনে হচ্ছে, তেমন স্বপ্নময় আ শান্ত তিনি ছিলেন না মোটেও। ছিলেন বরং বেশ মারকুটে ধরনের। বেপরোয়া ছিল তাঁর চালচলন। ছোট ভাই টমের পক্ষ নিয়ে স্কুলে কিংবা পথের বিড়ালছানাকে বিরক্ত করতে থাকা দশাসই চেহারার কসাই পুত্রের সঙ্গে বচসা থেকে হাতাহাতি বেধে গিয়ে রীতিমতো মারপিট করার রেকর্ড পাওয়া যায় তাঁর সম্পর্কে। নাচতে পছন্দ করতেন না। উচ্চতা কম ছিল বলে নারীদের সঙ্গে যুগল নাচে তাঁকে লাগত বেখাপ্পা। এমন আলাভোলা ছিলেন যে ভুলে যেতেন নিজের জন্মদিনটিও। জন্মতিথির উদ্‌যাপনও ভালো লাগত না তাঁর।

অনাথ অবস্থায় মাত্র ১৬ বছর বয়সে কিটসকে এক শল্যচিকিৎসকের সহকারী হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে পাঠানো হয়।অতি অল্প বয়সে রীতিমতো শক্ত পরীক্ষায় পাস করে যিনি চিকিৎসাশাস্ত্র আয়ত্ত করেছিলেন। অনুমান করা যায়, পর দায়িত্ব আর আর্থিক প্রতি নিজের ইচ্ছা তিনি নির্বাহের জন্য এ পেশা বেছে নেননি। নিলে হয়তো সফল পারতেন। কে জানে, হয়তো বেঁচেও থাকতে পারতেন আরও কয়েক বছর বেশি, অন্তত সচ্ছলতা থাকত জীবনে। তবে সাহিত্যের জগতে বিরাট এক ক্ষতি হয়ে যেত। কবিতার আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র' হয়ে জ্বলতে থাকা কিটসকে দেখতে পেত না এ পৃথিবী। সেই পেশা ছেড়ে তিনি কবিতা লেখাতেই মনোযোগ দেন।

ক্ষয়রোগ হয়েছিল কিটসের। তাঁর মূর্তিময়ী প্রেরণা যে ফ্যানি ব্রাউন, তাঁর সঙ্গে বাগদানের পর পর এ ক্ষয়রোগ আরও বেড়ে যায়। তবে এর উল্টোদিকে ফ্যানি ব্রাউনের সঙ্গে পরিচয়ের পর এই ক্ষণজন্মা কবির কবিতা স্ফূরিত হয়ে উঠেছিল তীব্রভাবে। ফ্যানিকে লেখা তাঁর চিঠি সর্বকালের সেরা প্রেমপত্রের তালিকায় স্থান পেয়েছে। ১৮২১ সালে মাত্র ২৫ বছর ৪ মাস বয়সে রোমে মারা যান কিটস। তাকে সমাহিত করা হয়েছিল প্রিয়তমা ফ্যানির একগুচ্ছ চুল আর না খোলা চিঠিসহ। ফ্যানি তাঁর আঙুলে আমৃত্যু পরে থাকেন কিটসের দেওয়া বাগদানের আংটিটি। কিটস ফ্যানিকে লিখেছিলেন, 'প্রায়ই মনে হয়, আমরা দুজন যদি প্রজাপতি হতাম, আর বাঁচতাম গ্রীষ্মের মাত্র তিনটি দিন; অমন তিনটি দিনই তোমার সঙ্গে যে আনন্দে ভরিয়ে তুলতে পারতাম, যেটি হতো সাদামাটা ৫০টি বছরের চেয়েও ঢের বেশি।

আরও পড়ুন: ক্ষমা চাইলেন জাস্টিন বিবার

কিটসের মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক আর জল্পনার অন্ত নেই। ২০১২ সালের এক গবেষণায় নিকোলাস রো কিটসের ব্যক্তিজীবনের কিছু তথ্য খুঁজে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, উচ্চাভিলাষী এই কবির মৃত্যুর পেছনে ক্ষয়রোগ ছাড়াও আরও কিছু কারণ ছিল। রোর মতে, কিটস ছিলেন সুরা আর আফিমে আসক্ত। যক্ষ্মার উপশমের জন্য নয়, সম্ভবত সিফিলিস বা গনোরিয়া ধরনের কোনো রোগের জন্য তিনি ব্যবহার করতেন পারদযুক্ত কোনো ওষুধ। কোনো চিকিৎসকের পরামর্শে নয়, চিকিৎসক হিসেবে তিনি নিজেই জানতেন নিরাময়ের উপায় ও উপাদান সম্পর্কে। এ ধরনের কোনো রোগে তিনি নিজে আক্রান্ত হয়েছিলেন, নাকি সেটি বংশানুক্রমিকভাবে পেয়েছিলেন— তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে এবং সন্তানদের ছেড়ে যাওয়ার ঘটনায় শৈশবেই ক্রনিক্যাল অ্যাংজাইটিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। ১৮১৮ সালে ছোট ভাই টম কিটসের মৃত্যুশোক ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল তাঁকে। যৌবনের প্রারম্ভে অমিত সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশের আগেই তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। তবু তাঁর অনন্য সৃষ্টিগুলোর জন্য সর্বকালের সেরা ইংরেজ কবিদের তালিকায় তাঁর নাম চিরস্থায়ী হয়ে আছে।

এ সময়ের পাঠকের কাছেও কিটস অসম্ভব জনপ্রিয়। দুই শ বছর পরের পাঠকও যে তাঁর কবিতায় তৃপ্তি পাচ্ছেন, তার পেছনে অনেক কারণ আছে। রোমান্টিক কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য অনুভূতির সরস বর্ণনা– হোক তা প্রেমের, বিষাদের বা হতাশার যেকোনো আবেগ, মুগ্ধতা বা উচ্ছ্বাসের সাবলীল - প্রকাশ। কিটসের কবিতায় এ উপাদান প্রচুর। কবিতা সম্পর্কে তাঁর মতামত ছিল সোজাসাপ্টা, খুব স্পষ্ট। প্রকাশক জন টেইলরকে এক চিঠিতে বলেছিলেন, 'গাছের পাতা যেমন প্রাকৃতিক উপায়ে জন্মায়, কবিতারও তেমনই স্বাভাবিকভাবে জন্ম নিতে হয়, নতুবা সে কবিতার না আসাই ভালো।' [ সংক্ষিপ্ত]

সাজ্জাদ শরিফ সম্পাদিত ‘ভালোবাসার তারুণ্য: পৃথিবী পাল্টে দেয়া তরুণেরা’ বই থেকে


সর্বশেষ সংবাদ