ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে গেলেন জহির রায়হান

  © সংগৃহীত

‘আমার সোনার দেশের, সোনার মাটিকে কলঙ্কিত হতে দিতে চাইনা বলেই তো দেশ দেশ করি, মাটির কথা বলি।’ /‘কি দিয়েছি আর কি পেয়েছি তার হিসেব করতে গেলে তো আর দেশকে ভালোবাসা যাবে না। দেশকে ভালোবাসতে হয় নিঃস্বার্থ ভাবে।’ জহির রায়হান তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় দেশের প্রতি ভালোবাসাকে এভাবেই বিধৃত করেছিলেন। বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের কালজয়ী এই পথিকৃতের ৮৮তম জন্মদিন আজ।

জহির রায়হান ১৯৩৫ সালে আজকের এইদিনে ফেনী জেলার মজিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক ও ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। জহির রায়হান শুরুতে কলকাতায় মিত্র ইনিস্টিউটে ও পরে আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। ভারত বিভাগের পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিজ গ্রামে চলে আসেন।

তিনি মাত্র ৩৭ বছরের স্বল্পকালের জীবনে যে সৃষ্টি রেখে গেছেন তা অসামান্য। তাঁর উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ‘ওদের জানিয়ে দাও’ কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘মরা মানুষগুলোতে কেমন জীবন এসেছে।’ ১৯৬১ সালে তিনি অভিনেত্রী সুমিতা দেবীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৬৮ সালে অপর অভিনেত্রী সুচন্দাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।

মাত্র ২০ বছর বয়সে প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ লেখেন। আর দুই দশকে সাতটি উপন্যাস, দুটি গল্পগ্রন্থ লিখেছেন। মাত্র ২৬ বছর বয়সে প্রথম চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এছাড়া এক দশকে বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষার ১০টি চলচ্চিত্র পরিচালনা, প্রযোজনা করেছেন। প্রবাহ ও এক্সপ্রেস–এর মতো সাময়িকপত্র সম্পাদনার স্মরণীয় কীর্তিও দেখিয়েছেন। পেয়েছেন সেরা চলচ্চিত্র ও বইয়ের পুরস্কার।

তিনি ১৯৫০ সালে আমিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ঢাকায় কলেজে ভর্তি হন। আই.এসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। অল্প বয়সেই তিনি কম্যুনিস্ট রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। তখন কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় গোপন পার্টিতে তাঁর নাম রাখা হয় ‘রায়হান’। আসল নাম ছিল জহিরুল্লাহ। পরবর্তীতে জহির রায়হান নামে পরিচিত হন।

আরও পড়ুন: আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুম-খুনে জড়ালেও জবাবদিহি করা হয় না: যুক্তরাষ্ট্র

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যে ১০ জন প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন তিনি তাঁদের অন্যতম। তাঁকে মিছিল থেকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়। ১৩৬২ বঙ্গাব্দে তাঁর প্রথম গল্পসংগ্রহ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদীর মতো প্রখ্যাত সাহিত্য সৃষ্টিও রয়েছে। হাজার বছর ধরে উপন্যাসের জন্য তিনি আদমজী পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭২ সালে পান বাংলা একাডেমী পুরস্কার।

কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই জহির রায়হানকে নিয়ে লেখেন, ‘আমাদের সবার জহির ভাইকে নিয়ে পঞ্চাশের দশকে একটি গল্প চালু ছিল। তিনি নাকি তাঁর গল্পের সাধারণ মানুষের মুখের কথা শোনার জন্য চায়ের দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। উপযুক্ত সংলাপ শুনলেই নোটবইতে টুকে নিতেন।’

১৯৬১ সালে তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্র কখনও আসেনি মুক্তি পায়। তারপর কাজল, কাঁচের দেয়াল, বেহুলা, জীবন থেকে নেয়া, আনোয়ারা, সঙ্গম এবং বাহানা তৈরি করেন। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসনকে চিত্রিত করা হয় এবং জনগণকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে উদ্বুদ্ধ করে।

এছাড়া তিনি লেট দেয়ার বি লাইট নামে ইংরেজি ছবি নির্মাণ শুরু করলেও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তা শেষ করতে পারেননি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর কলকাতায় গিয়ে স্টপ জেনোসাইড নির্মাণ করেন। সেটি পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি কাঁচের দেয়াল ছবির জন্য অনেক পুরস্কার লাভ করেন।

জহির রায়হান তাঁর চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে ভাঙতে চেয়েছেন মানবিক সম্পর্কের মধ্যে থাকা বিচ্ছিন্নতার অতিসূক্ষ্ম ‘কাচের দেয়াল’। একুশের মতোই ধারণ করেছেন একাত্তরের আগুন। একাত্তরের মার্চে গঠিত ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’–এর অন্যতম সদস্য ছিলেন। একুশ ও একাত্তরের জহির রায়হান যেন তাঁর গল্প-উপন্যাসের চরিত্রেও একাকার।

১৯৭১ সালে জহির রায়হানের বড় ভাই আরেক প্রখ্যাত লেখক শহীদুল্লা কায়সারকে দুর্বৃত্তরা তাঁর বাসভবন থেকে তুলে নিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর খবর পান, শহীদুল্লা কায়সারকে মিরপুরে রাখা হয়েছে। তিনি তখন তাঁকে উদ্ধারের জন্য যান। কিন্তু আর ফিরে আসেননি। ওই দিনটিই জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

‘জহির রায়হান: জীবনের একটু আগুন চাই’ লেখায় মতিউর রহমান বলেন, ‘আর কতদিন-এর নায়ক তপুকে দেখতে পাই জহির রায়হানের একুশের গল্প-তেও। সেই তপু আবার ফিরে আসে আর কতদিন–এর নায়ক হয়ে। অথচ স্বাধীনতার পর অগ্রজকে খুঁজতে গিয়ে তিনিই তো আরেক তপু হয়ে যান।’


সর্বশেষ সংবাদ