গণঅভ্যুত্থানে শহীদের কথা
বাবা প্যারালাইজড, মা অসুস্থ—শহীদ সবুজের পরিবারকে দেখার কেউ নেই
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৩ PM , আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪০ PM
শান্ত ও ভদ্র প্রকৃতির এক কিশোর সবুজ মিয়া। বয়স তার ১৮। এইচএসসি পরীক্ষা যখন দিচ্ছিলেন, তখন সারা দেশে শুরু হয় ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ, বিক্ষোভ। শুরু হয় ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গণজাগরণ। সবুজের মন বসছিল না পড়ায়, বই-খাতা ছেড়ে যোগ দেন দেশের ডাকে আন্দোলনে।
আন্দোলনের কথা শুনে মা নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন, বাবা যাস নে। তোকে হারালে যে আমাদের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে। ছেলে কথা শোনেনি মায়ের। জীবিত আর ঘরে ফেরা হলো না তার। মায়ের দুনিয়া সত্যিই অন্ধকার হয়ে গেল। বলছিলাম সবুজ মিয়ার কথা। আন্দোলনে যোগ দিয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হয়েছেন তিনি।
শহীদ সবুজ মিয়া শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার খড়িয়াকাজিরচর ইউনিয়নের রূপারপাড়া গ্রামের আজহার আলী (৫০) ও সমেজা খাতুন (৩৮) দম্পতির ছেলে। তিনি এ বছর শ্রীবরদী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। পরীক্ষায় জিপিএ ৪ দশমিক ৩৩ ‘এ’ গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণও হয়েছেন।
শহিদ সবুজের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবুজ দ্বিতীয়। বোনের বিয়ের পর বাবা প্যারালাইজড হয়ে পড়েন। এরপর পরিবারের সকল দায়িত্ব নেন সবুজ। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি ফার্মেসিতে কাজ করতেন। পরিবারের খরচ চালানোর পাশাপাশি নিজের আয়ে পড়াশোনাও করতেন।
সবুজের চাচাতো ভাই রাশেদুজ্জামান রিফাত বলেন, সবুজের বাবা দীর্ঘদিন থেকে প্যারালাইজড থাকায় সংসারের পুরো দায়িত্ব ছিল সবুজের কাঁধে। এসএসসি পাশ করার পর পরিবারের খরচ বহন করতে সবুজ চলে যায় ঢাকায়। দীর্ঘদিন চাকুরি করার পর সে শেরপুর ফিরে এসে শ্রীবরদি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়। পড়ালেখার পাশাপাশি সবুজ শ্রীবরদি উপজেলার লংগরপাড়া বাজারের একটি ফার্মেসিতে চাকুরি করতো। তার বেতন ছিল মাত্র ৬ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়েই তার অসুস্থ বাবার চিকিৎসা, পরিবার ও তার পড়াশোনার খরচ চলতো।
শহীদ সবুজ মিয়া ও তার মা সমেজা খাতুন।
সবুজের মা সমেজা খাতুনও (৩৮) অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ছেলের জন্য প্রায় সারাক্ষণ কাঁদেন। তিনি বলেন, গত ৪ আগস্ট সবুজ সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আমি তাকে যেতে নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম, বাবা যাস নে। শোনেনি আমার কথা। সে সময় আমার দেশ প্রেমিক ছেলে বলেছিল, ‘সবাই যদি ভয়ে ঘরে বসে থাকে তাহলে আওয়ামী সরকারের পতন হবে না। আর আমরা কখনো আমাদের যৌক্তিক দাবিগুলো শেখ হাসিনাকে দিয়ে মানাতে পারবো না।’ সেদিন সবুজ বলেছিল, ‘মা চিন্তা করো না। আমি মিছিল শেষ করে বাড়ি ফিরে আসবো।’ ছেলে আমার ঠিকই বাড়ি ফিরেছিল। তবে লাশ হয়ে।
সমেজা আরও জানান, আমার ছেলে আমাকে খুবই ভালোবাসতো। কখনো বাড়ি এসে দেখতে না পেলে এদিক সেদিক খুঁজতো। সবুজ ভাল কবিতা লিখতো। মাঝে মধ্যে আমাকে তার লেখা কবিতা পড়ে শুনাতো। দেশের প্রতি তার খুব টান ছিল। সবুজ খুব সাহসীও ছিল। তার স্বপ্ন ছিল সে একদিন বড় ব্যবসায়ী হবে। তখন আমাদের কোন দুঃখ কষ্ট থাকবে না। আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য যারা সত্যিই দায়ী আমি তাদের বিচার চাই।
জাহিদ মেডিকেলের স্বত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আলম (৩৫) সম্পর্কে সবুজের চাচা হন। তিনি বলেন, ছেলেটা খুবই ভদ্র ও বিনয়ী ছিল। সে আমার ফার্মেসীতে চাকুরি করত। ছোটবেলা থেকে সবুজ অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছে। সবুজ তার বাবার চিকিৎসার খরচ চালানোর জন্য ঢাকায় গিয়েছিল। সেখানে সে বাড়ির কেয়ারটেকারের কাজ করেছে। এরপর অনেকদিন গার্মেন্টসেও কাজ করেছে। তার স্বপ্ন ছিল সে একদিন বড় ব্যবসায়ী হয়ে পরিবারের দুঃখ ঘুচাবে। কিন্তু অসময়ে তার এ মৃত্যুতে সব শেষ হয়ে গেছে।
শেরপুর জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা হাফিজুর রহমান বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ হতে আমরা শহিদ সবুজের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছি। তার পরিবারের হাতে নগদ ২ লাখ টাকা তুলে দিয়েছি। ভবিষ্যতে যে কোন প্রয়োজনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী শহিদ সবুজের পরিবারের পাশে থাকবে।
পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো বড়ই প্রয়োজন। না হলে যে সবুজের অসুস্থ বাবার চিকিৎসা আর হবে না। এমনকি পরিবারের সদস্যদের বেঁচে থাকাই দায় হয়ে যাবে।
(তথ্যসূত্র: বাসস)