‘কোটা পদ্ধতির কারণে বাড়ছে সামাজিক বৈষম্য’

বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা   © টিডিসি ফটো

বর্তমানে বাংলাদেশে বহুল আলোচিত বিষয় কোটা সংস্কার। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা প্রত্যাহারের দাবিতে সারা দেশে বিতর্ক ও বিক্ষোভ চলছে। একটি দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় সারা বিশ্বে কোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রচলিত। বাংলাদেশেও মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই এই ব্যবস্থা শুরু হয়। তবে ২০১৮ সালে প্রচলিত কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে সরকার কোটা প্রথা বাতিলও করে। তবে সম্প্রতি সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এরই প্রতিবাদে আবারও শুরু হয়েছে আন্দোলন। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) থেকেও শিক্ষার্থীদের বিগত বছরগুলোতে বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে যোগদানের নজির আছে। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় বুটেক্সের শিক্ষার্থীরাও বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থার সংশোধন চান। চলমান কোটা আন্দোলন নিয়ে বুটেক্সের শিক্ষার্থীদের মনোভাব তুলে ধরেছেন মো.রফিকুল ইসলাম

শুধুমাত্র সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য কোটা বহাল রাখা

বর্তমানে দেশে সরকারি চাকরিতে যে কোটা পদ্ধতি বহাল আছে তা বিলুপ্ত করা উচিত এবং প্রতিযোগিতার ন্যায্যতা ও মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালিত হওয়া উচিত। প্রচলিত কোটা ব্যবস্থার কারণে নিয়োগ বা ভর্তি প্রক্রিয়ায় মেধাবীদের তুলনায় কম যোগ্য প্রার্থীদের অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এর ফলে প্রকৃত মেধাবীরা সুযোগ হারায়, প্রতিযোগিতার ন্যায্যতা বিঘ্নিত হয় এবং দক্ষতাভিত্তিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কারণেই আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। তাদের অবদান কোনোভাবেই ভুলে যাওয়ার মত নয়। 

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সর্বোচ্চ তাদের সন্তানদের জন্য কোটা রাখা যুক্তিযুক্ত কিন্তু তাদের তৃতীয় প্রজন্মকে যেকোনো সরকারি চাকরির প্রতিযোগিতায় ৩০ শতাংশ কোটা সুবিধা দেওয়াকে আমি কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত মনে করি না। এটা যদি বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে তাহলে যেকোনো প্রতিযোগিতায় দেশের অদূর ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী কোটা থাকাটা বর্তমানে যুক্তিযুক্ত কারণ তারা সামান্য পরিমাণে হলেও সুবিধা বঞ্চিত।

এ. বি. এম. শাহরিয়ার হাবীব, অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। 

কোটা যেন রাষ্ট্রের জন্য এক অভিশাপ

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখনই আবার বাধা হয়ে দাঁড়ায় কোটা নামক অভিশাপ। একটা রাষ্ট্রকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সর্বোচ্চ মেধাবী ও যোগ্য সরকারি কর্মকর্তার, সেখানে ৫৬ শতাংশ কোটায় নিয়োগ রাষ্ট্রের পায়ে কুড়াল মারার মতো। সংবিধানের ২৯ নং অনুচ্ছেদের ১নং দফায় বলা আছে  “প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকদের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে” যা ৫৬ শতাংশ কোটার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। সংবিধানের একই অনুচ্ছেদের দফা ৩(ক) তে বলা হয়েছে নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্র নিবৃত্ত করিবে না। 
 
যা কোটার পক্ষে কথা বলে কিন্তু বাংলাদেশে এই ৫৬শতাংশ কোটার মধ্যে কত শতাংশ অনগ্রসর? স্বাধীনতার পরে প্রায় অর্ধ-শত বছর কোটা চালু রেখেও কি আমাদের অনগ্রসর গোষ্ঠী মূলধারায় ফেরেনি? সময়ের সাথে যখন অনগ্রসর গোষ্ঠী মূলধারায় ফিরে আসে তখন কোটাকে সমন্বয় করতে হয়। তাই অনতিবিলম্বে কোটা কে যৌক্তিক পর্যায়ে সংস্কার করা হোক। পরিশেষে একটা কথাই বলতে চাই, কোটা প্রথা নিপাত যাক, বাংলাদেশ মুক্তিপাক।

তাসনিমুল হাসান নিহাদ, ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।

সুযোগ পাওয়ার অনিশ্চয়তায় মেধাবীদের গন্তব্য বিদেশে

যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দেশটা স্বাধীন হয়েছিল সেই বৈষম্যই যদি বর্তমানে ঘুরেফিরে সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাথে করা হয় তাহলে এই স্বাধীনতার তাৎপর্য কি রইলো শেষ অবধি?

পৃথিবীতে কোনো উন্নত রাষ্ট্রে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোতে কোটা ব্যবস্থা আমাদের দেশের ন্যায় এতোটা বৈষম্যমূলক নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সর্বোচ্চ তাদের ছেলে-মেয়েদের এই সুযোগ দেয়া যায়। তবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই সুযোগ ভোগ করা নিতান্তই কাপুরুষোচিত,লজ্জাজনক আর চরম বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি ব্যক্ত করে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা কখনোই এই অনিশ্চয়তার আশায় বসে থাকবেনা। তাদের শেষপর্যন্ত গন্তব্য হবে বিদেশে উচ্চশিক্ষা। আর এভাবেই মেধাশূন্য একটা জাতি আর রাষ্ট্রের পথে আগাবে এই দেশ। তাই এই মুক্তিযোদ্ধাভিত্তিক কোটা বৈষম্যকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংশোধন করা উচিত।

মো. নাজমুছ সাকিব, ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। 

মুক্তিযোদ্ধা কোটা ১০ শতাংশের বেশি নয়

কোটা সংস্কার আন্দোলন দেশের চাকরিপ্রার্থীদের জন্য বৈষম্য দূরীকরণের একটি প্রচেষ্টা। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রযোজ্য হয় যার মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, ৫ শতাংশ উপজাতি কোটা এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা এবং বাকি ৪৪ শতাংশ থাকে সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের জন্য।  চাকরিপ্রার্থীদের একটি ক্ষুদ্র অংশের জন্য এই কোটার পরিমাণ অবশ্যই বিশাল এবং অযৌক্তিক। 

আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা অনুযায়ী কোটা ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনয়ন করা। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য যোগ্য এবং মেধাবী কর্মকর্তাদের প্রয়োজন। বিশেষ সুবিধায় কাউকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল করলে দেশের তা কতটুকু কাজে লাগবে তা হর্তাকর্তারা ভেবে দেখবেন। একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। বর্তমানে বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখা মানে জাতির বৃহদাংশকে অবমূল্যায়ন করা।

জোবায়ের আহাম্মেদ ভূইয়া, টেক্সটাইল ফ্যাশন এন্ড ডিজাইন বিভাগ। 

স্বাধীনতার এত বছর পর মুক্তিযোদ্ধা কোটা যুক্তিযুক্ত নয়

প্রচলিত কোটা ব্যবস্থায় যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কাজ করার  সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চাকরি ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা  খুবই অযৌক্তিক ও বেমানান। যার ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের মেধার মর্যাদা পাবেনা এবং অযোগ্য মানুষ দ্বারা সরকারি চাকরির ক্ষেত্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাদে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা বহাল থাকা যুক্তিযুক্ত কারণ তারা সত্যিকার অর্থেই  সুবিধা বঞ্চিত। অপরদিকে নারী কোটা ও জেলা কোটা থাকার কোনো যৌক্তিকতা নেই। বাংলাদেশের মত স্বাধীন রাষ্ট্রে যেখানে মানুষ হিসেবে কোন ভেদাভেদ নেই সেখানে সরকারি চাকরির নিয়োগে সবার সমান সুযোগ ও মেধার মূল্যায়ন থাকা উচিত। তাই সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটা ব্যবস্থা বাতিল চাই।

মেহরুবা আফরিন, অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। 

কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করলে যোগ্যতার অবমূল্যায়ন হবে

বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়বস্তু হচ্ছে কোটাবিরোধী আন্দোলন। বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থার কারণে চাকরি পরীক্ষায় ভালো করা সত্ত্বেও মেধাবীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ যা মেধার অবমূল্যায়ন ও দেশের অগ্রগতির জন্য বাধা। 

মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল দেশকে  স্বাধীনতা প্রদান এর জন্যে যাতে করে সবাই তাদের ন্যায্য অধিকার পায়। কিন্তু আজ ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল থাকার কারণে আমাদের স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিবন্ধী কোটা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা নিয়ে আমাদের সমস্যা নেই। কারণ তারা সমাজের পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু  জনগোষ্ঠী।  সরকারের প্রতি অনুরোধ থাকবে, ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে যে পরিপত্র জারি করা হয়েছিলো, সেটা পুনর্বহাল করা হোক। তাহলেই দেশে মেধার মুক্তি ঘটবে, দেশে মেধার মূল্যায়ন হবে ও দেশ এগিয়ে যাবে।
  
সিফতি ইসলাম, ইয়ার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। 

কোটা পদ্ধতির কারণে বাড়ছে সামাজিক বৈষম্য 

১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের উপর অন্যায় অত্যাচার এর কারণে বাঙালিরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যারা যুদ্ধ করেছেন বা শহিদ হয়েছেন তাদের প্রতি আমাদের চিরকাল শ্রদ্ধা থাকবে। এখন আমাদের ছাত্র সমাজের সাথে যা হচ্ছে তাও বৈষম্য। প্রচলিত কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হবে। দেশের অবকাঠামোগত, প্রশাসনিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেধাবীদের দরকার আছে।

কোটার মাধ্যমে অযোগ্যরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগ পাবে যা একটি দেশের জন্য হুমকির স্বরূপ। কোটা আমাদের মতো সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য অভিশাপের মতো। দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটা বিরোধী আন্দোলন হচ্ছে। আমি তাদের সাথে সহমত পোষণ করছি। কোটা বৈষম্য জনগণ ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা মানবে না। যতদিন পর্যন্ত আমাদের দাবি মানা না হবে ততদিন পর্যন্ত আন্দোলন চালু রাখা উচিত বলে আমি মনে করি।

রিফাত মোল্লা, ডাইস এন্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। 


সর্বশেষ সংবাদ