শুধু ঈদের দিন না, ভিনদেশে প্রতিটি দিনই নতুন যুদ্ধক্ষেত্র

মো. মেহেদী হাসান জয়
মো. মেহেদী হাসান জয়  © টিডিসি রিপোর্ট

বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমিয়েছেন মো. মেহেদী হাসান জয়। তিনি দেশটির ইউনিভার্সিটি অব চেস্টারে পড়ালেখা করছেন। দেশের বাইরে পরিবার ছাড়া এটা তার দ্বিতীয় ঈদ। মেহেদী দেশ ছেড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে অবস্থান করলেও তার মন পড়ে আছে দেশে। ঈদের মতো উৎসবের দিনগুলোতে তিনি পরিবারকে ভীষণ মিস করেন। এবারের ঈদুল আজহায় তার সঙ্গে কথা বলেছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। তার কথাগুলো শুনেছেন সিয়াম হাসান

* আপনার সম্পর্কে জানতে চাই।
মো. মেহেদী হাসান জয়: আমি ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব চেস্টারে স্নাতক করছি। এখানে আমার পড়াশোনার বিষয় যুদ্ধ, সংঘাত এবং সমাজ।

* কত বছর যাবৎ দেশের বাইরে ঈদ উদযাপন করছেন?
মো. মেহেদী হাসান জয়: ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে আমি মাতৃভূমি ছেড়ে উচ্চশিক্ষা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ইংরেজদের মাটিতে পাড়ি জমাই। শেষ এ দুটি ঈদ ছাড়া পরিবারের বাইরে কখনও ঈদ উৎযাপন করা হয়নি। রোজার ঈদ এবং এই কোরবানির ঈদ অচেনা এই ভূখণ্ডে আমার ভীষণ অন্যরকম কেটেছে। যা বুঝিয়ে বলার ভাষা আমার জানা নেই।

যদিও আমি নিষ্ঠুর-নিদারুণ কষ্টকে আলিঙ্গন করার দৃঢ় মানসিকতা ও প্রগাঢ় প্রস্তুতি নিয়েই দেশ ত্যাগ করেছিলাম। তবুও কেন যেন ঠিক ঈদুল ফিতরের দিন সকাল বেলায় অ্যালার্মের চিরচেনা শব্দে চোখ খুলতেই যখন উপলব্ধি করলাম যে, আজ আম্মুর হাতের বানানো সেই সেমাই খাওয়ার সুযোগটা আর নেই, তখন চোখযুগল থেকে বেয়ে নামা অশ্রুধারা উপেক্ষা করার শক্তি আমার ছিল না।

এই অনুভূতির তুলনায় আমার সেই দৃঢ়পণতা, প্রবল মানসিকতা ও কঠিন প্রতিজ্ঞা প্রবণতা এক মুহূর্তেই ধূলোয় মিশে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যা আমার কল্পনাতীত।

* ঈদের দিনে কী করেন, কেমন ব্যস্ততা থাকে?
মো. মেহেদী হাসান জয়: পরিবারের বাইরে উৎসবের দিনগুলো আমার শক্তি ও সামর্থ্যের বাইরে বলে নিজেকে আশ্বস্ত ও প্রশান্ত করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নিকট শুকরিয়া প্রকাশ করি। ঈদের দিন সকালে গোসল শেষ করে পরিপাটি হয়ে বাসার পাকিস্তানি বন্ধুদের সাথে নিয়ে ম্যানচেষ্টারের বায়তুল আমান মসজিদে নামাজ পড়তে যাই। ঈদুল ফিতরের নামাজ ও খুতবা শেষ করে পরিচিতমুখের সকলের সাথে কোলাকুলি ও কুশল বিনিময় করি।

* ঈদুল ফিতর থেকে তো ঈদুল আজহা ব্যতিক্রম। এ ঈদের উদযাপনটা কেমন?
মো. মেহেদী হাসান জয়: ঈদুল আজহার চিত্র তুলনামূলক ভিন্ন। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে গেলে, নিজ দেশে উদযাপিত ঈদের সাথে ইংল্যান্ডের কোরবানির ঈদ অত্যন্ত নিঃস্বাদ। নেই কোনো ঈদ আমোদ, নেই কোনো কোলাহল, নেই কোনো আড়ম্বর পূর্ণ পরিবেশ।

শুনেছি এখানে শহরতলি থেকে কয়েক মাইল দূরে দুম্বা, ছাগল, গরু ও উট কোরবানির কার্যক্রম হয়ে ট্রাকে বোঝাই করে যার যার ভাগের মাংস বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। এই কার্যপরিচালনায় হয়তো এখানকার মুসলিমরা অভ্যস্ত, কিন্তু আমি বিশেষ করে এতে তৃপ্তি পাইনি।

আমার খুব আফসোস হলো যে, এখানকার বাচ্চারা এই কোরবানির ঈদের আনন্দ, তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণরূপে উপভোগ ও উপলব্ধি করার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত। ঈদুল ফিতরের তুলনায় ঈদুল আজহার মাহাত্ম্য ও বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। যা এই দেশে বাসবাসরত মুসলমান ভাই-বোনেরা কখনও সম্পূর্ণরূপে উদযাপন করতে পারে না।

আমার সাথেও এর ভিন্নতা হয়নি, অফিস থেকে রওনা হয়ে মসজিদে আসতেই জানতে পারলাম ঈদের নামাজ শেষ। অতঃপর, দুঃখভরাক্রান্ত মন নিয়ে মসজিদে প্রদত্ত চকলেট, বিস্কিট ও কেক খেয়ে পরিচিতজনদের সাথে বাক্যালাপ করে ক্লান্তিময় ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হই। বাসা পরিবর্তন করায় নতুন ফ্রিজ ও রান্নাঘরেও কোনো খাবার না থাকায় পরবর্তীতে আবার বাজার করার উদ্দেশ্যে ঘর ত্যাগ করি। অবশেষে বিকেল সাড়ে ৫টায় রান্না শেষ করে মুখে খাবার তুলি।

* সাংস্কৃতিক ভাবনায় কোনো দেশের ঈদ আপনার কাছে বেশি উপভোগ্য?
মো. মেহেদী হাসান জয়: বাংলা সংস্কৃতি ও সমাজ মুসলিম অধ্যুষিত। অপরদিকে ইংল্যান্ডের সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অতএব, নিঃসন্দেহে আমাদের নিজ দেশের ধর্মীয় উৎসবসমূহ উদযাপন করা আমরা বেশি উপভোগ করবো। এক কথায় বলতে গেলে, এটা অতুলনীয়।

পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ ধরনের উৎসব তাদেরকে ছাড়া উদযাপন অসম্ভব। আমরা সামাজিক প্রাণী হিসেবে যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান ও আয়োজনে আমাদের মিত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের আমন্ত্রণ করি। একসাথে উপভোগ করি।

আমার মতে ব্রিটেনের চিত্র ভিন্ন, এখানকার মানুষরা খুবই আত্মকেন্দ্রিক এবং সামাজিক কার্যক্রমে তাদের সিংহভাগ মানুষের ভীষণ অনীহা। এদেশের ধারা, আইন ও নিয়ম অবশ্যই আমাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য ততোটা বন্ধুসুলভ না। এছাড়া পরিবারের শূন্যতা একটা বড় অপূর্ণতা। এসব বিষয়গুলোর প্রভাবে এই দেশের ঈদ নীরেশ, নিস্বাদ, ও নিষ্ঠুর।

* পরিবারকে রেখে বিদেশের মাটিতে ঈদ নিশ্চয়ই বেদনাদায়ক। এ ব্যাপারটা নিয়ে কী বলবেন?
মো. মেহেদী হাসান জয়: পরিবার একটি দ্বিরুপ শব্দ। এর দুইটি বৈশিষ্ট্য শক্তিমত্তা ও দুর্বলতা। সময়, স্থান, কাল ও পাত্রভেদে এর বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়। শুধুমাত্র ঈদের দিনই না, পরিবার ছাড়া ভিনদেশের মাটিতে প্রত্যেকটি দিনই একটি নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। যেই যুদ্ধে প্রতিনিয়ত হেরে যাবো জেনেও এক ঐশ্বরিক অদম্য শক্তি নিয়ে ধৈর্যের সাথে লড়াই অব্যাহত রাখা।

প্রতিটি মুহূর্ত পরিবারের অনুপস্থিতি ও শূন্যতাটা ভোগায়, এই বিষয়টি অত্যন্ত ভয়াবহ বেদনাদায়ক। বিদেশের এই সময়ে পরিবারের অনুপস্থিতি আমাদের অন্যতম প্রধান দুর্বলতা। আল্লাহ তা’য়ালা যেন আমাদের সকলের এই ত্যাগ-তিতিক্ষার সুন্দর ও মধুর ফল দান করেন। আমাদের এই দুর্বলতাকে শক্তিমত্তায় পরিণত করেন এবং আমাদেরকে আবার একত্রিত হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন।

* শৈশবের ঈদ নিয়ে বলুন। ছোটবেলার ঈদের কোন স্মৃতি এখনো মনে পড়ে?
মো. মেহেদী হাসান জয়: দুর্ভাগ্যবশত আমার শৈশবের স্মৃতিগুলো তিক্ত। তবুও ওই তিক্ততার মাঝে যতটুকু সুমিষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল তাদের মধ্যে স্মরণীও হলো গরুর হাঁটে যাওয়া। গরু নিয়ে আসা, গরুর সেবাযত্নে অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতা করা ও চাঁদরাতের গোলাবারুদের স্মৃতি।

শুধু তাই নয়, আমি ছোটোবেলা থেকেই অত্যন্ত আগ্রহের সাথে মাংস কাটা এবং বণ্টনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে কাজ করতাম। এই স্মৃতিগুলো আমার স্মৃতিপটে আজীবন অম্লান হয়ে থাকবে।

* ঈদুল আযহার মূল শিক্ষা কী হওয়া উচিত?
মো. মেহেদী হাসান জয়: ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদের তাৎপর্য অপরিসীম। যার মাঝে রয়েছে মানবজাতির জন্য একটি অভূতপূর্ণ শিক্ষা। এই ঈদ আত্মত্যাগের ঈদ, এই ঈদ আত্মশুদ্ধির ঈদ, এই ঈদ আল্লাহর আনুগত্যে আল্লাহর জন্য সকল ধরনের ত্যাগ স্বীকারে সর্বদা প্রস্তুত থাকার শিক্ষা দেয়। এই ঈদ আমাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বুঝতে সাহায্য করে যে, আল্লাহর রাস্তায় সকল ধরনের কোরবানি আমাদের নিয়ত ও তাকওয়ার উপর বিদ্যমান।

মাংস বা রক্তই আসল কোরবানি নয়, আমাদের হৃদয়ের স্বচ্ছতা ও আত্মশুদ্ধি হলো সর্বোত্তম কোরবানি। সাধারণত মানুষ পশু কুরবানি করে, কিন্তু আল্লাহর নেক বান্দাগণ নিজেদের হৃদয়ের পশুকে কুরবানি করেন। ঈদুল আজহার মৌলিক উদ্দেশ্য এটাই হওয়া উচিত। তবে আফসোস বর্তমান যুগের কোরবানির উদ্দেশ্যে মাংস খাওয়া এবং এর সংরক্ষণ করাতে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ রাব্বুল আলআমিন আমাদেরকে সঠিক পথ অবলম্বন করার তৌফিক দিন।


সর্বশেষ সংবাদ