হিজাব নারীর প্রতিবন্ধকতা নয়, আত্মমর্যাদা রক্ষার অন্যতম মাধ্যম

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণীদের ভাবনা

হিজাব নিয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরেছেন শিক্ষার্থীরা
হিজাব নিয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরেছেন শিক্ষার্থীরা  © টিডিসি ফটো

হিজাব বা পর্দা মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ। এ নির্দেশ মেনে চলা প্রত্যেক মুসলমান নারীর জন্য ফরজ। এটি নারী জাতির নিরাপত্তা ও মর্যাদার অন্যতম প্রতীক। ইসলামী শরিয়ত নারীর হিজাবের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে। ‘হিজাব’ পবিত্র কুরআনের ব্যবহৃত শব্দ। হিজাব অর্থে ‘জিলবাব’ শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে পবিত্র কুরআনে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নারীরা যেন তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়।’ (সুরা আহজাব : ৫৯) এ আয়াতে ‘জালাবিব’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা ‘জিলবাব’ শব্দের বহুবচন।

এর তাফসিরে আল্লামা কুরতুবি (রহ.) বলেছেন, ‘জিলবাব’ এমন বড় কাপড় বা চাদরকে বলা হয়, যা দ্বারা নারীরা নিজেদের মুখমণ্ডল ও পূর্ণ শরীর আবৃত করতে পারেন।’ (আল-জামেউ লিআহকামিল কুরআন : ১৪/২৪৩)। তাছাড়া পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন, ইমানদার নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন সাধারণত: প্রকাশমান স্থান ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে।’ (সুরা নুর : আয়াত ৩১)। 

অতএব নারী যে পেশায় থাকুক, যেখানেই থাকুক প্রত্যেকের উচিত হিজাব পরিধান করা, আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা। হিজাব নারীর প্রফেশান বা শিক্ষায় কোনো প্রভাব ফেলে না। বরং নারীকে দেয় নিরাপত্তা,দেয় অশেষ মর্যাদা। তাছাড়া হিজাব পরিধানে রয়েছে স্বাস্থ্যের উপকারিতা। হিজাব কী আসলেই নারীকে নিরাপত্তা দেয়? আদৌ কী কোনো সুবিধা রয়েছে রয়েছে হিজাব পরিধানে? কী ভাবছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ শিক্ষার্থীরা? হিজাব পরিধানে নিত্য সুবিধা নিয়ে কথা হয় চার তরুণীর সাথে। কী ভাবছেন তারা? এসব বিষয় তুলে ধরছেন শাহ বিলিয়া জুলফিকার-

হিজাব সম্পর্কে জানতে চাইলে ইডেন মহিলা কলেজের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের মারিয়া সুলতানা বলেন, হিজাব নারীর প্রতিবন্ধকতা নয়। মহান আল্লাহ তায়ালার অনন্য ও মূল্যবান সৃষ্টির অন্যতম হলো নারী জাতি। তাদের সৌন্দর্যকে সুরক্ষিত ও নিষ্কলুষ রাখার জন্য হিজাব পরিধানের বিধান নাজিল করা হয়েছে। হিজাব নারীর সম্ভ্রম ও শুদ্ধতাকে সংরক্ষিত করে কু-চারিত্রিক স্বভাবের অধিকারী পুরুষের কলুষ ও লালসাপুর্ণ লোলুপ দৃষ্টি থেকে। হিজাব এখন শুধু নারীর ধর্মীয় পোশাকই নয়, সাংস্কৃতিক পোশাক হিসেবেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

“প্রত্যেক ধর্মেই নারীদের শালীন পোশাকে নিজেদের আবৃত করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। হিজাব হচ্ছে নারীর শালীনতা ও সদাচারের প্রতীক। তথাকথিত বিবেকবুদ্ধি হীন কিছু নারীবাদী আজকাল পর্দাকে নারী প্রগতি ও ক্ষমতায়নের পথে অন্তরায় দাবি করছেন। অথচ কতটা অযৌক্তিক চিন্তা-চেতনা তাদের। হিজাব কোনো যুগেই নারী শিক্ষা ও জাগরণের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি, বরং নারীকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা ও সাহসিকতা। যার জোরে নারীরা যুগ যুগ ধরে নিজেদের যোগ্য ও কর্মক্ষম প্রমাণ করেছে। হিজাব নারীদের সমাজে চলার পথের প্রতিবন্ধকতা নয়, বরং প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অবস্থানকে করে তুলে অত্যধিক তাৎপর্যপূর্ণ।”

তিনি আরও বলেন, যুগে যুগে পর্দাশীল নারীরা কখনো পিছিয়ে ছিল না। শিক্ষা-সংস্কৃতি, সামাজিক-রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। তাই হিজাবকে নারীর প্রতিবন্ধকতা নয়, নারী জাগরণের অন্যতম সোপান হিসেবে গণ্য করা উচিত। কেননা, হিজাব নারীকে শুধু বাহ্যিক ভাবে সুরক্ষিত রাখে না, সামাজিক অবক্ষয় রোধ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির থেকে সবাইকে হেফাজতে রাখে।

হিজাবের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রী মারিয়াম সুলতানা রিমা বলেন, হিজাব আমাদের নিরাপত্তা দেয়। হিজাব প্রত্যয়টির আক্ষরিক অর্থ “আবরণ বা পর্দা”।

তিনি মনে করেন, বর্তমানে এটি মহিলাদের পর্দা বা নারী-পুরুষের মধ্যে পৃথকীকরণের ধারণাকে বোঝায়।বিশ্বের সর্বত্র আজ নারীদের নিরাপত্তার জন্য হিজাবের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য । ইসলামের একটি ফরজ বিধান হিসেবে হিজাবকে বাধ্যতামূলক করে নেওয়া একজন মুসলিম নারীর জন্য অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালা নিজে হিজাব বা পর্দাকে একজন নারীর নিরাপত্তার হাতিয়ার হিসেবে দিয়েছেন। হিজাব নারীদের লাজুকতা ও শালীনতা রক্ষা করে। আমরা যখন হিজাব পরিধান করি, মানুষের কুদৃষ্টি এবং ইভটিজিং থেকে রক্ষা পাই। এক্ষেত্রে হিজাব একজন নারীর জন্য ঢাল হিসেবে কাজ করে।

“তাছাড়া হিজাব পরিধান আমাদের স্বাস্থ্যগতও উপকারিতা রয়েছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় হিজাব স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে , হিজাব শ্বাসনালীকে ক্ষত সৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করে। সূর্যের আলোতে বিদ্যমান অতিবেগুনী রশ্মি ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। সূর্যের আলো সরাসরি শরীরে লাগলে বিভিন্ন চর্ম রোগ হতে পারে। নারীরা ভালোভাবে হিজাব করলে স্বাভাবিকভাবেই মুখমণ্ডল ঢাকা থাকে। ফলে বিভিন্ন সংবেদনশীল চর্মরোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মেয়েদের সৌন্দর্যের এক অনবদ্য অংশ হলো চুল । হিজাবের মাধ্যমে তারা তাদের এই চুলকে বাইরের ধুলোবালি, রোগজীবাণু থেকে রক্ষা করতে পারে। হিজাবের স্বাস্থ্যগত উপযোগিতার দিকটা চিন্তা করে হলেও সকল নারীর হিজাব পরা উচিত বলে আমি মনে করি।”

বর্তমান প্রেক্ষাপটে হিজাবের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের ছাত্রী আমিনা আক্তার জানান, বর্তমান প্রেক্ষাপটে হিজাবের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, বর্তমানে সর্বত্রই নগ্নতা ও বেহায়াপনার ছড়াছড়ি। যে পোষাকে নারী ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা কখনই নারীর প্রকৃত মর্যাদার মাধ্যম হতে পারে না। 

“বেপর্দায় চলাফেরা করা নারীরা প্রতিনিয়ত ইভটিজিং ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে নষ্ট হচ্ছে হাজারো নারীর জীবন। এক্ষেত্রে হিজাব পরিধানই একমাত্র উপায় নারীকে নিরাপদ রাখার। সতীত্ব নারী জাতির অমূল্য সম্পদ। কোনো বিবেকবান নারী তার এই অমূল্য সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দিতে চাইবে না। নারীর এই অমূল্য সম্পদ রক্ষার একমাত্র হাতিয়ার হলো হিজাব। আর তাই আমি মনে করি হিজাবই নারীর মর্যাদার প্রতীক।”

হিজাব পরিধান নিয়ে জানতে চাইলে, ইডেন মহিলা কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া আক্তার হিরা জানান, ইসলামী জীবন বিধান এ নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য শালীন-লজ্জাশীল জীবন যাপনের কথা বলা হলেও নারীদের কথা বলা হয়েছে বারংবার। লজ্জা নারীর ভূষণ। লজ্জা নিবারণের জন্যই নারীরা পোশাক ও হিজাব পরিধান করে। 

“হিজাব আরবী শব্দ। এর অর্থ আবৃত রাখা, ঢেকে রাখা, গোপন করা ইত্যাদি। এই হিজাব অপরিচিত নারী - পুরুষের মধ্যে নৈতিক সীমানা প্রাচীর তৈরি করে। ইসলাম বিজ্ঞানসম্মত, সর্বজনীন ও শান্তির ধর্ম। ইসলামে পর্দার মূল উদ্দেশ্য সৌন্দর্য প্রকাশ নয় বরং গোপন রাখা। একজন নারী কতটা ভদ্র, শালীন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে পোশাকের মাধ্যমে। হিজাব পরিধান এর ফলে বদনজর, কুদৃষ্টি এবং ইভটিজিং থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। নারীর জন্য পবিত্রতার প্রতীক হলো হিজাব।”

তিনি আরও জানান, শুধু ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয় বৈজ্ঞানিক দিক থেকেও এর অনেক উপকারিতা রয়েছে। ডাক্তাররা বলেন, অতিরিক্ত তাপমাত্রায় মস্তিষ্কের ফসফরাস গলতে থাকে,সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি মাথায় পড়লে একটি নির্দিষ্ট সময় পর উচ্চ তাপমাত্রায় আক্রান্ত সহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। যার ফলে স্মরণ শক্তি কমে যাওয়া এবং কর্মপ্রক্রিয়া কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। পর্দাহীনতার কারণে সমাজে পরকীয়া, নির্লজ্জতা, ব্যভিচার, অশ্লীলতা তৈরি হয়। যার ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ, ইভটিজিং, চরিত্রহীনতা, ধর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু হিজাব পরিধানে ফলে দৃষ্টি সংযত থাকে এবং কেউ উত্ত্যক্ত করার সাহস পায় না। হিজাব নারীদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার কোনো বিষয় না। বরং ইসলামী বিধি মোতাবেক মেনে নিজের শালীনতা বজায় রাখা এবং আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্যই নারীরা হিজাব পরিধান করে।


সর্বশেষ সংবাদ