আমার লেখা কি আমার?
- আবু এন এম ওয়াহিদ
- প্রকাশ: ১০ জুন ২০১৮, ০৭:৫১ PM , আপডেট: ১০ জুন ২০১৮, ০৮:০২ PM
আমার বাংলা লেখালেখির আরম্ভ বলতে গেলে মাত্র সেদিন - দু’হাজার সাত সালের গোড়ার দিকে। শুরুটা আপনাদের কাছে একটু বেখাপ্পা লাগতে পারে, তবু বলছি। অর্থবিত্ত কিংবা নামডাক হাসিল করার উদ্দেশ্যে আমি লিখতে শুরু করিনি। লেখক হওয়ার জন্য আমার মাঝে কোনো অন্তর্নিহিত আকাংক্সক্ষাও ছিল না। লিখতে ভালো লাগে তাই লিখি, তেমনটিও নয়, কারণ লেখালেখির জগৎটা আনন্দময় না বেদনাদায়ক তা আমার কাছে ষোলআনাই অজানা ছিল। সংস্কৃতিসেবা কিংবা সাহিত্য সৃষ্টির মতো কোনো যোগ্যতাই আমার ছিল না, তাই সেগুলোর দ্বারাও আমি লিখতে প্রভাবিত হইনি। এখন প্রশ্ন হলো, কেন এ পথে আমার পা বাড়ানো? শুনে হয়তো বা অবাক হবেন, প্রকৃতপক্ষে আমার কয়েকজন প্রিয় মানুষ, অতি কাছের মানুষকে খুশি করার জন্য আমার বাংলা লেখালেখিজীবনের শুরু। তাঁদের ধারণা, আমি স্কুল-কলেজে ভালো ছাত্র ছিলাম, (পরীক্ষায় ভালো ফল করা আর ভালো ছাত্র হওয়া এক কথা নয়। আমার বেলা প্রথমটিই সত্য, দ্বিতীয়টি নয়।) চেষ্টা করলেই লিখতে পারবো এবং এখন যেহেতু আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, তাই আমি কিছু লিখলে ঢাকার পত্রিকাগুলো আগ্রহ নিয়ে ছাপাবে। তাঁরা আমার লেখা দেখবে, পড়বে, আনন্দ পাবে, তাই এই আবদার! প্রিয়জনদের নিরাশ করতে চাইনি বলে আমিও শেষ বয়সে এসে আগুপিছু না ভেবে ঝোঁকের মাথায় লেখালেখি শুরু করে দিলাম। লিখতে গিয়ে দেখি হাত তো আর চলে না। একে তো আমার বাংলা ভাষাজ্ঞান, শব্দপ্রয়োগ, বাক্যবিন্যাস, বানান, ইত্যাদি গোড়াতেই কাঁচা ছিল, তদুপরি ছেলেবেলায় যাও বা একটু-আধটু শিখেছিলাম, এতোদিনে তার সব ভুলে বসে আছি। কেমন করে লিখবো? হিসেব করে দেখি, বিগত বিশ বছরের মধ্যে বাংলা লিখিনি এক পাতাও। এ রকম একটি কঠিন বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে স্রেফ গায়ের জোরে কষ্ট করে লেখার কোশেশ জারি রাখলাম। লেখা যে কিছু হচ্ছে না, নিজেই বুঝতে পারছিলাম, তবু এ নিয়ে লেগে থাকলাম, যেন এক ধরনের জেদ আমাকে পেয়ে বসল। কোন মনস্তত্ত্বের বলে এ রকম একটি বিষয়ে জেদ ধরতে গেলাম সেটা আজো আমার নিজের কাছেই রহস্য! যাই হোক, শুরুতে ঢাকার বাংলা পত্রিকার জন্য শিক্ষা ও সামাজিক বিষয়ে ছোট ছোট কলাম লিখতাম। তারপর শুরু করলাম রাজনৈতিক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ। হলে কী হবে, আফসোসের সাথে উপলব্ধি করলাম কেউই আমার লেখা ছাপাতে চায় না - অবশ্য তার কারণও ছিল। আমি একজন অপরিচিত ও নতুন লেখক। আমার ভুলে ভরা কাঁচা হাতের লেখা ছিল একেবারে দুর্বল এবং নিচুমানের। দীর্ঘদিন বাংলা না লেখার কারণে এলোমেলো চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে ধারাবাহিকভাবে ভাষায় প্রকাশ করতে রীতিমতো হিমসিম খেতে হতো। তখন আমি কম্পিউটারে বাংলা কম্পোজও করতে জানতাম না। নিবন্ধগুলো সাদা কাগজে হাতে লিখে ফ্যাক্স করে পাঠাতাম। লাইনগুলোও সোজা হতো না। গ্রামবাংলার মেঠোপথের মতো এঁকেবেঁকে যেতো। লেখাকে দৃষ্টিনন্দন করার জন্য রুলটানা কাগজে লিখতে লাগলাম। লিখতে গেলে মনে পড়তো পাঠশালার সেই হারিয়ে যাওয়া মধুর দিনগুলোর কথা, যখন বাঁশের বেঞ্চে বসে মাটির প্লেটে বাঁশের রুলার বসিয়ে লাইন টেনে লিখতে হতো। রুলটানা কাগজ বেঁকে যাওয়া লাইনকে সোজা করলো বটে, কিন্তু হাতের লেখা পত্রিকার পাতায় ছাপার হরফে দেখার স্বপ্ন সহসাই পুরণ হলো না, অর্থ্যাৎ লেখা পেয়েও কেউ ছাপালো না। পত্রিকার লোকদের ইমেল করি, ফোন করি, কথা বলি, সবাই লেখা পাঠাতে বলে, কিন্তু ছাপায় না কেউ। রবার্ট ব্রুসের কথা, ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার’, স্মরণে রেখে লেখা চালিয়ে যেতে লাগলাম, নিয়মিত কাগজেও পাঠাই, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। এভাবে চলে গেলো বেশ ক’টা দিন। কোনোমতেই কাগজওয়ালাদের মন জয় করতে পারলাম না। পারবো কেমন করে, মানসম্মত লেখা তো আর ছেলের হাতের মোয়া নয় যে, যাই লিখবো তাই সোনা হয়ে ফলবে আর সম্পাদকরা লুফে নেবে। হতাশা নিয়ে ভাবতে লাগলাম, যে লেখা ছাপা হবে না, যে লেখা কেউ পড়বে না, সে লেখা লিখে লাভ কী? লেখালেখি ছেড়ে দেবো কি দেবো না, মনের এমনি দোলাচলে হঠাৎ একদিন দেখলাম দৈনিক ‘সমকাল’ পত্রিকায় আমার একটা ছোট্ট লেখা ছাপা হয়েছে। এতে করে নিরাশার মাঝে এক চিলতে আশার আলো দেখতে পেলাম। লেখালেখি প্রায় ছেড়ে দিতে গিয়েও ছাড়তে পারলাম না, নবোদ্যমে চালিয়ে যেতে লাগলাম। এ ব্যাপারে ‘সমকাল’-এর সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান আমাকে বাংলা সফটওয়্যার ব্যবহার করতে বললেন। ন্যাসভিলের অগ্রজতুল্য ড. মঈন সরকারের পরামর্শে ইন্টারনেট থেকে ফ্রি ‘বর্ণ সফ্ট’ ডাউনলোড করলাম, কিন্তু ‘কিবোর্ড লে-আউট’-এর নির্দিষ্ট নিয়ম না জানার কারণে সফটওয়্যারটি কাজে লাগাতে পারলাম না। পরে নিউ ইয়র্কের ‘ঠিকানা’ পত্রিকায় কর্মরত একজন সহৃদয় বন্ধুর (দুঃখিত তাঁর নামটা এখন মনে করতে পারছি না) পরামর্শে ও সহযোগিতায় সেই শহরের এ কে এম হক সাহেবের নিকট থেকে ৫০ ডলার দিয়ে জব্বার সাহেবের ‘বিজয়’ সফটওয়্যারটি সংগ্রহ করে অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে ও অনেক কষ্ট করে বাংলা টাইপিং রপ্ত করতে লাগলাম। এটার ‘কিবোর্ড লে-আউট’-এরও কিছু কিছু জায়গা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল। ‘ঠিকানা’-র সেই বন্ধুটির সৌজন্যে সে সমস্যারও তড়িৎ সমাধান পেয়ে গেলাম। বেশ অল্প দিনেই ‘বিজয়’-কে জয় করে ফেললাম।
শুরুর আগে বাংলা ওয়ার্ড প্রসেসিংকে যতটা কঠিন ভেবেছিলাম, শিখতে গিয়ে দেখলাম ততোটা কঠিন নয়। আমি এখন আর কাগজে লিখি না। কিবোর্ডে আঙ্গুল চালিয়ে সরাসরি কম্পিউটারের স্ক্রিনে লিখি। লিখতে লিখতে দেখি, একদিকে নিজের লেখা আলো ঝলমল পর্দায় সুশৃঙ্খল ছাপার অক্ষরে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠে, আরেক দিকে আমার গোমড়া মেজাজটাকে রঙের ছটায় ফুরফুরে করে তুলে! আরো কিছুদিন পর ফুরফুরে মন-মেজাজের অন্তর্নিহিত অর্থটাও খোলাসা হয়ে গেলো। বুঝতে বাকি রইলো না যে, ছাপার হরফের দৃষ্টি-নান্দনিকতার সাথে যোগ হয়েছে নতুন এক উপলব্ধি, নতুন এক অনুভ‚তি! এর নাম কী জানি না, তবে নিজের লেখা নিজেই পড়ি, পড়তে ভালো লাগে, তাই বারবার পড়ি। একা একা পড়ি, পড়ে কখনো হাসি, কখনো কাঁদি। এইসব হাসি-কান্নায় এক রকম সুখ পাই আর তৃপ্তির সাগরে ভাসি!
সময় একটু গড়িয়ে গেলে আরো বুঝতে পারি নিজের অপ্রকাশিত লেখা পড়ে যে আনন্দ পাই, সে আনন্দ নিখুঁত, সে আনন্দ খাঁটি। লেখা ছাপা হোক বা না হোক, এই তৃপ্তিটাই তো এক বিশাল প্রাপ্তি! শুরুতে না হলেও এখন ধরতে পারি ওই তৃপ্তি, সৃষ্টির চিরাচরিত আনন্দবোধ ও আনন্দানুভ‚তি থেকে উৎসারিত। এখানে একটা কথা না বললেই নয়। যে লেখা একদিকে আমাকে স্বস্তিদায়ক আনন্দ দিলো, সে লেখাই অন্যদিকে আমাকে বেশ বিচলিতও করে তুলল। লেখালেখিতে সৃষ্টির আনন্দটা নিখুঁত হলেও আমার লেখাগুলো নিখুঁত হচ্ছিল না। খুঁতের মধ্যে সবচেয়ে বড় খুঁত ছিলো বানানে শুদ্ধতার অভাব। ঘরে কোনো বাংলা অভিধান না থাকায় এ সমস্যা থেকে বেরিয়েও আসতে পারছিলাম না। এভাবেই নিজের মতো করে ভুল-শুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলাম। আমি লেখা পাঠাই, পত্রিকাওয়ালারা এডিট করে, ঠিকঠাক করে ছাপায়। সময়ের সাথে সাথে পত্রিকাওয়ালাদের সাথে আমার সম্পর্কের বরফ গলতে লাগল। ধীরে ধীরে লেখা ছাপানোয় একটু একটু করে সফলতা পেতে লাগলাম, যা কিনা আমার উৎসাহের পালে লাগিয়ে দিলো দখিন হাওয়া! এই সময়ে প্রতিবেশী বন্ধু মোশাররফের মাধ্যমে ঢাকা থেকে ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ আনালাম। এটা আমার জন্য কিনে রেখেছিল ঢাকার অনুজপ্রতিম সালাহ্উদ্দিন। আমার লেখালেখিতে অভিধানটি খুব কাজে লাগল, কিন্তু বানান সমস্যা পুরোপুরি দূর হলো না। এ দুর্বলতা নিয়ে পুরোদমে লেখালেখি চলল চার-পাঁচ বছর ধরে। একটা সময়ে এসে খেয়াল করলাম ঢাকার প্রধান প্রধান সবগুলো কাগজেই আমার লেখা ছাপা হচ্ছে। এমনও হয়েছে, একই দিনে একাধিক কাগজে আমার লেখা বেরিয়েছে। নতুন নতুন কাগজ থেকে লেখা দেয়ার জন্য অনুরোধ পেতে লাগলাম। অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো আমার লেখা কপি-পেস্ট করে, আমার অনুমতির তোয়াক্কাও করে না। আমিও আপত্তি করি না। ভাবি, চলছে যখন চলুক না, ক্ষতি কী?
এই পর্যায়ে লেখালেখি আমার জীবনে একটি নতুন অভিজ্ঞতা এনে দিল। ঢাকার বাংলা দৈনিকে আমার লেখা কলাম পড়ে দেশে-বিদেশে বসবাসরত সমঝদার বাঙালি পাঠকগণ আমার সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করলেন। তাঁরা আমার লেখা পড়ে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেন, প্রশংসা করেন, এমনকি গঠনমূলক সমালোচনাও করেন। এভাবে ইতিবাচক ও গঠনমূলক পাঠক-প্রতিক্রিয়া নিয়মিত পেতে থাকলাম। বেশিরভার ক্ষেত্রে এ যোগাযোগ ছিল একতরফা, কিন্তু তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েক জনের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আমিও জবাব দিয়েছি। অনেকের সাথে এ জাতীয় দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগ চলেছে একাধিকবার। কিছু দিন পর দেখলাম, বেশ কিছুসংখ্যক পাঠকের সাথে আমার একটি চলমান কথোপকথন বিরাজমান। একসময় বুঝলাম, এ সম্পর্ক শুধুমাত্র ‘লেখক-পাঠক’-এর সীমাবদ্ধ ও একান্ত আনুষ্ঠানিকতার গন্ডি পেরিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়েও পৌঁছে গেছে। এখন শুধু ইমেল নয়, টেলিফোনেও হর-হামেশা অনেকের সাথে আমার কথা হয়। লেখালেখি ছাড়াও পারিবারিক ও ব্যক্তিগত বিষয়েও অনেকের সাথে আমার ভাবের অদান-প্রদান শুরু হয়ে গেল। এখন আমরা চাকরি-বাকরির সুবিধা-অসুবিধায়, অসুখ-বিসুখে এবং অন্যান্য পারিবারিক বিষয়ে একজন আরেকজনের খোঁজখবর নেই, সাহায্য করার চেষ্টা করি। তাঁদের সাথে আমার এই নির্লোভ ও নির্ভেজাল সম্পর্ক আজও অটুট আছে এবং আশা করি বাকি জীবনও থাকবে। এভাবে বিশেষ কিছু অজানা অচেনা মানুষ, প্রথমে পাঠক, তারপরে সমালোচক, অবশেষে বন্ধু এবং পরিশেষে বন্ধু থেকে অতি আপনজন হয়ে উঠলো! এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা! এ অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে আমার লেখালেখি জীবনের একটি উজ্জ্বলতম অধ্যায়!
পত্রিকায় কলাম লিখে টাকা পাবো, শুরুতে এরকম কোনো ভাবনা আমার মাঝে ছিল না। একসময়ে এসে যখন জানতে পারলাম প্রায় সব নিয়মিত কলাম লেখককেই পত্রিকাগুলো সম্মানী দিয়ে থাকে, তখন আমি মত পাল্টালাম। ভাবলাম, অন্য সবাইকে দিলে আমাকে দেবে না কেন। পরিশ্রম করে লিখি, সম্মানী তো আমার ন্যায্য পাওনা। চাইলে ক্ষতি কী? ঢাকাস্থ আমার পুরনো বন্ধু, প্রতিষ্ঠিত কলাম লেখক অধ্যাপক আবু আহমেদের সাথে একদিন ফোনে এ বিষয়ে আলাপ করলাম। তিনিও একই রকমের মত দিলেন। তাঁর কথামতো আমি প্রতিটি কাগজের কাছে সম্মানী চাইলাম।
একটি কাগজ বাদে সবাই আমার এ প্রস্তাবে রাজিও হলো, তবে দু’একটি কাগজ টাকার পরিমাণ উহ্য রাখল। অনুজপ্রতিম সালাহ্উদ্দিন তখন ঢাকায়। আমার হয়ে সে দু’টো কাগজ থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ত্রিশ হাজার টাকার মতো পাওনা তুলে পরে আমাকে ডলারে পরিশোধ করল। বাকি সবাই তার কাছে টাকা না দিয়ে আমার নামে বাংলাদেশি টাকায় চেক লিখতে চাইল। দীর্ঘদিন দেশে না যাওয়ায় এবং অব্যবহৃত থাকার কারণে আমার পুরনো ব্যাংক এ্যাকাউন্টটি সচল না অচল হয়ে আছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারলাম না। আমি বললাম, আমার স্ত্রী, কোনো আত্মীয় অথবা বন্ধুর নামে চেক ইস্যু করে দাও। পত্রিকাওয়ালারা কেউই এতে রাজি হলো না। তাই পত্রিকাগুলোর কাছে আজ পর্যন্ত আমার পাওনা টাকা পাওনা হয়েই রইল।
এভাবে আরো বেশ কিছুদিন চলার পর, ঢাকার সংবাদপত্র থেকে আমি আস্তে আস্তে দূরে সরে আসতে লাগলাম। এখানে একটা কথা পরিষ্কার করা জরুরি। আমার এ সরে আসার পেছনে টাকা কোনো ইস্যু ছিল না। কদাচিৎ ব্যতিক্রম ছাড়া ঢাকার বাংলা কাগজে আমি এখন আর লিখি না, তবে অন্য কারণে। তাদের চাহিদার সাথে আমার ইচ্ছা ও আগ্রহের মিল হচ্ছিল না। অর্থাৎ তারা যে কিসিমের লেখা চায় সেসব লিখতে আমি উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। তারও একটি কারণ আছে, তবে সেদিকে আজ আর যাচ্ছি না। আমি আমার মনমতো লেখা চালিয়ে যেতে লাগলাম। এ-ভাবে এক সময় এসে দেখলাম আমার লেখালেখির ধরন পুরোপুরিই পাল্টে গেছে। এখন আমি আর বাঁধাধরা কোনো বিষয়ে লিখি না। যখন যেখানে যা দেখি, যখন যা মনে আসে তার ওপরই লিখি। লেখালেখি চলল ভালোই, কিন্তু দেখা দিলো পাঠক সমস্যা। আমি লিখব অথচ কেউ পড়বে না, সেটাই বা মেনে নেই কী করে?
এ সময়ে আমার জীবনে আরেকটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটলো। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু, অতি প্রিয় বন্ধু, ইংল্যান্ড প্রবাসী মাহবুবের সাথে পঁয়ত্রিশ বছর আগের হারানো সম্পর্ক নতুন করে ফিরে পেলাম! ঊনিশ শ’ সত্তর দশকের মাঝামাঝি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন সময়ে কোনো কারণ ছাড়াই তার সাথে আমার যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। আমি বিদেশে আসার পর কানাডা এবং আমেরিকা থেকে বারংবার চেষ্টা করেও মাহবুবের কোনো হদিস পাইনি। আসামের পাথারকান্দিতে তার গ্রামের বাড়িতে একাধিকবার চিঠি লিখেছি, তার ও আমার কমন বন্ধু এবং তাদের আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে উপর্যুপরি তদবির করিয়েছি। বন্ধুটির কোনো সন্ধান পাইনি। অবশেষে আমাদের প্রতিবেশী গ্রামের অনুজতুল্য ইলিয়াস আলীর সুুবাদে মাহবুবের শ্বশুরবাড়ির মাধ্যমে তার সাথে আমার সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয় ২০১১/১২ সালের দিকে।
মাহবুবের সংস্পর্শ আমার লেখালেখিতে এনে দেয় এক নতুন মাত্রা, খ্যাতি না বাড়ালেও, বাড়িয়ে দেয় লেখার গতি। কীভাবে? সে কথা আপনাদের অনেকেরই জানা। যাঁরা জানেন না, তাঁরা আস্তে আস্তে অবশ্যই জানবেন যে, আমার লেখালেখির কেন্দ্রবিন্দুতে মাহবুবের অবস্থান। প্রকৃত অর্থে সে-ই আমার লেখকসত্তার একক প্রাণপুরুষ। আমার লেখায় তার কথা বারংবার ঘুরেফিরে আসে। এখন আমি অনেক লেখা মাহবুবের কথায় লিখি, তাকে পড়ে শোনাই, তাকে দিয়ে পড়াই, এডিট করাই, তার কথায় কাটি, তার কথায় ছাঁটি, তার কথায় ছাপি। মোদ্দাকথা, মাহবুবের হাতের স্বর্ণছোঁয়া ছাড়া আমার ‘লেখা’ও আর লেখা হয়ে ওঠে না। বিনে পয়সার এই কাজে মাহবুব কখনো ধৈর্য-পরীক্ষায় ফেল মারে না, কখনো বিরক্তি প্রকাশ করে না। মাহবুবের কাছে আমি এমনভাবে আবদার করি, যেন তার ওপর আমার সীমাহীন অধিকার! বন্ধুত্বের মহিমায় ‘আবদার’ এবং ‘দাবি’ যে এভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে, সে অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আর হয়নি, হবেও না! কোন অজানা ‘যুক্তি’, কোন অদৃশ্য ‘চুক্তি’বলে, বন্ধুর কাছে বন্ধু ক্রমাগত এমন অযৌক্তিক ‘দাবি’ পেশ করতে পারে, এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই! মাহবুবকে নিয়ে বৃহৎ পরিসরে আরো লেখার ইচ্ছা আছে, আজ এ পর্যন্তই থাক।
মাহবুবের কাছেই জানতে পারলাম তিন খন্ড ‘বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’-এর কথা। অভিধানটি যে আমার খুব প্রয়োজন, সেকথা জানতে পেরে আমার আরেক প্রিয় মানুষ, ঢাকার অনুজপ্রতিম রানা আমার জন্য উপহার হিসেবে পুরো সেটটি কিনে রাখে। পরে আমার স্ত্রী বইগুলো দুই বারে ঢাকা থেকে ন্যাশভিল নিয়ে আসে। এটা আমার লেখালেখির জন্য অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে। তার পরও এ কাজে মাহবুবের ওপর আমার নির্ভরতা কাটেনি, অর্থাৎ লেখক হিসেবে আমি স্বাবলম্বী হতে পারিনি।
লেখালেখিতে মাহবুব ছাড়াও আমার ঋণ আছে আরো কয়েকজনের কাছে, যেমন ঢাকার জাভেদ, রানা, তওফিক, মুস্তাফা, সাম্য শরীফ ও জাহাঙ্গীর হোসেন, ময়মনসিংহের মুজিব, কিশোরগঞ্জের তানভীর, সিলেটের নাজমুল, মুকুল ও মাহমুদ, মায়ামির নেসার, হিউস্টনের আনিস ভাই, ক্লার্ক্সভিলের মানিক ভাই, ক্যামেরুনের (টেক্সাস) মুশতাক ভাই, টরন্টোর সালাহ্উদ্দিন, ন্যাশভিলের আজমত ভাই, জামান ও মাসুম, ব্রিজবেনের তারিকুল ইসলাম, সিডনির আনিস, মোল্লা ইব্রাহিম ও মাকসুদ ভাই, পার্থ-এর আরিফ ও সিদ্দিক ভাই, বার্মিংহামের হাফিজ খান, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার বেলায়েত ভাই, আনিসুল ও হাসনাত, অটোয়ার মুস্তাফা ভাই, আনোয়ার ভাই, ও নজরুল, পিটারবরোর সাউদ, নরওয়ের তারিক আসকারী এবং আরো অনেকে। ইতিমধ্যে আমিও বুঝলাম, লেখালেখি আমার নেশায় পরিণত হয়ে গেছে, তবে পেশা হয়নি এবং আগামীতে এমন সম্ভাবনা দেখি না।
বন্ধুদের পরামর্শে ও উৎসাহে এখনো লিখি, বরং বেশিই লিখি, কিন্তু কোনো কাগজে পাঠাই না, তাই নিজেই নিজের পাঠক সৃষ্টির উদ্যোগ নিলাম। প্রথম প্রথম কয়েকজন ঘনিষ্ট বন্ধু ও আমার প্রিয় প্রাক্তন শিক্ষকের সাথে স্বপ্রণোদিত হয়ে ইমেল মারফত আমার নতুন কিসিমের লেখা শেয়ার করতে লাগলাম। তাঁদের মৌখিক মন্তব্য ও লিখিত প্রতিক্রিয়া থেকে বুঝতে পারলাম, উৎসাহ নিয়ে তাঁরা আমার লেখা পড়েন। তাঁদের আগ্রহ দেখে আরো বৃহত্তর পরিসরে অজানা অচেনা মানুষের কাছেও আমি লেখা পাঠাতে লাগলাম।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, উপযাচক হয়ে নিজের লেখা অপরিচিতজনদের পড়াতে গেলাম কেন? প্রশ্নটির উত্তর আমার জন্য একটু জটিল এবং কঠিন। এর উত্তর আমি দু’ভাবে দেবো। প্রথমত, ইতিমধ্যে যেহেতু কিছু বোদ্ধা পাঠক আমার লেখা পড়ে ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন, ফলে আমার মনে একটি বিশ্বাস জন্মেছিল যে, আমার লেখা পড়ে সবার না হলেও কোনো কোনো পাঠকের ভালো লাগলেও লাগতে পারে। আমার লেখা একজন মানুষও যদি উপভোগ করে, যদি এ থেকে কোনো উপকার পায়, তার কোনো কাজে লাগে, তবে ক্ষতি কী! কষ্ট করে যখন লিখলাম, তখন মানুষের সাথে শেয়ার করে দেখি-ই না, কী হয়! শেষতক আমার এই প্রচেষ্টা সফল হয়েছে বলেই মনে করি। সুখের কথা, এভাবেই আমি আমার লেখার পাঠক সৃষ্টি করেছি এবং এর সংখ্যা নিয়েও আজ আমার অসন্তুষ্টির কোনো কারণ নেই। এখানে যে-বিষয়টি আমি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করিনি সেটা হলো, এক জনের ভালো লাগলেই বা কী? আরো দশ জনের তো খারাপ লাগতে পারে, তারা বিরক্ত হতে পারে। একজনের সুখের জন্য দশ জনের বিরক্তি সৃষ্টির কি আমার কোনো অধিকার ছিল? নিশ্চয়ই না, তবে সেসময় পাঠকদের কাছে পৌঁছার কার্যকর কোনো বিকল্প পথও আমার জানা ছিল না। কেউ কেউ বলেছিলেন, নিজের নামে অনলাইন ব্লগ তৈরি করে লেখা আপলোড করে দিতে। আমি সে পথে যাইনি, কারণ আমার মতো অজানা অচেনা মানুষের ব্লগে পাঠকেরা যাবেই বা কেন এবং আমার লেখা পড়বেই বা কেন। কিছু মানুষকে বিরক্ত করে নিজের জন্য কিছু পাঠক তৈরি করা যে স্বার্থপরের মতো একটি কাজ হয়েছে, এ কথা আমি অস্বীকার করি না এবং এর দায়ও আমি এড়াতে চাই না।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে আরেকটি প্রশ্ন উঠতেই পারে। সেটা হলো, পাঠকদের কাছ থেকে বাহবা কুড়ানো কি কোনো ব্যাপার ছিল? এর উত্তরে আমি যা বলবো তা হলো, বাহবা পাওয়া উদ্দেশ্য না হলেও, তাদের প্র্রশংসা পেলে যে খুশি হইনি সে কথা বললে মিথ্যা বলা হবে। অনেক পাঠকের কাছ থেকে গঠনমূলক মন্তব্য ও সমালোচনা পেয়েছি, তাতে আমার লেখা আরো সুন্দর ও সাবলীল হয়েছে, সমৃদ্ধ হয়েছে। আর পাঠকদের বাহবা কুড়ানো প্রসঙ্গে অন্য যে কথাটি বলতে চাই তা হলো, গড়ে বিশজনের প্রশংসার সাথে অন্তত একজনের তিরস্কারও আমাকে হাসিমুখে বরণ করে নিতে হয়েছে। আশীর্বাদ যদি বা কিছু আহরণ করেও থাকি, তার জন্য আমাকে মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে।
এ বার আমার পাঠক প্রতিক্রিয়ার অন্য একটি দিক নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই। ইমেল মারফত অযাচিতভাবে আমার লেখা পেয়ে অনেকে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন, কেউ কেউ আবার অবাঞ্ছিত মেল পাঠানো পছন্দ করলেন না। যাঁরা যাঁরা বিরক্তি প্রকাশ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে আমি আমার পাঠক তালিকা থেকে তাঁদেরকে অব্যাহতি দিলাম। অনেককেই বিনা অনুমতিতে আমি আমার ‘পাঠক গ্রুপ’-এ যোগ করেছি। দু’একজন যে স্বেচ্ছায় আমার দলে এসে যোগ দেননি এমনও নয়। এভাবে যোগ-বিয়োগ করতে করতে এক পর্যায়ে দেখলাম পাঠক সংখ্যা পনেরো শ’ পেরিয়ে গেছে। আমি নিয়মিত লিখি এবং সবার সাথে ভাগাভাগি করি। কতোজন পড়েন কতোজন পড়েন না, তা ঠিকমতো বুঝতে পারি না, কারণ বেশিরভাগ পাঠকই নীরব। তাঁরা ভালো-মন্দ কোনো মন্তব্য করেন না। তবে মাঝে মাঝে কারো কারো মন্তব্য পাই। অন্য প্রসঙ্গে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ হলে, স্বপ্রণোদিত হয়ে তাঁরা আমার লেখার কথা পাড়েন, প্রশংসা করেন। এমনও হয়েছে দেশের বাইরে কনফারেন্স-এ গেছি, অজানা লোকদের সাথে দেখা হয়েছে। আমার পরিচয় জানার পর তাঁরা নিজে থেকেই আমার লেখালেখির প্রসঙ্গ তুলেছেন, উৎসাহ যুগিয়েছেন। তার মানে এই নয় যে, আমার কোনো পাঠক আমার ওপর ত্যক্ত-বিরক্ত ছিলেন না। ছিলেন বটে, তবে সংখ্যায় নগণ্য। তাঁরা সামনাসামনি কিছু বলেননি। শক্ত ভাষায় ইমেল মারফত আমার প্রতি কঠিন ও নির্মম ভাষা প্রয়োগ করেছেন। এতে আমি কোনো কষ্ট পাইনি। এ সব কিছুকেই আমি পুরোপুরি ইতিবাচকভাবেই নিয়েছি। এভাবে চলল আরো বেশ কিছুদিন। এতোদিন আমার মাঝে কাজ করছিল নিজের লেখা ছাপার হরফে দেখার আনন্দ, নিজের লেখা নিজে পড়ার আনন্দ, নিজের লেখা প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকদের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেয়ার আনন্দ, পাঠকদেরকে পাঠক থেকে বন্ধু ও আপনজন বানানোর আনন্দ! এবার আরেকটা বিষয় আমার অভিজ্ঞতার ভান্ডারে এসে যুক্ত হলো। বিষয়টি বাহ্যত বেদনাদায়ক, কিন্তু এ থেকে আমি অর্জন করেছি সবচেয়ে বেশি আত্মোপলদ্ধি ও আত্মতৃপ্তি! এটাকে আমি মনে করি আমার লেখকজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান প্রাপ্তি! এ পর্যন্ত আমার ইমেল পাওয়ার পর মাত্র গোটা কয়েক পাঠক (কেউ লেখা পড়ে, কেউ না পড়ে) অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও নির্মম ভাষায় আমাকে বিস্ফোরক উত্তর দিয়েছেন, যে উত্তরগুলো ছিল অত্যন্ত ক্ষুরধার অপমান ও গালাগালিতে ভরপুর। এইসব গালাগালিকে আমি হাসিমুখে ‘গলাগলি’ হিসেবেই সহজভাবে বরণ করে নিয়েছি! উত্তরদাতাদের সঙ্গে কোনো প্রকার বাক-বিতন্ডায় কিংবা বিতর্কে না জড়িয়ে বিনীতভাবে ক্ষমা চেয়ে উত্তর দিয়েছি এবং পাঠক তালিকা থেকে তাঁদের বাদ দিয়েছি। আমার অপ্রত্যাশিত উত্তর পেয়ে এর মাঝে দু’একজন তাঁদের ভুল বুঝতে পেরে পাল্টা আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে সাথে সাথে ইমেল করেছেন এবং ‘পাঠক-গ্রুপ’-এ থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। আমি তাঁদের অনুরোধ রেখেছি। তাঁরা আজও আমার সমঝদার পাঠক এবং ভালো বন্ধু। কোনো অপরিচিত মানুষের অপমান ও গালাগালির প্রতিউত্তরে ‘ক্ষমা’ চাওয়ার মতো মানুষ আমি ছিলাম না। কী করে, কার ইশারায়, কোন উৎস থেকে এমন সাহস ও ধৈর্য আমার ভিতর সৃষ্টি হলো, এ-ও আমার কাছে রীতিমতো এক রহস্য! এ পর্যায়ে এসে আমি গভীরভাবে অনুভব করলাম, লেখালেখি আমাকে একজন লেখক না বানালেও তিলে তিলে একজন সহনশীল ও ধৈর্যশীল ‘মানুষ’ হিসেবে গড়ে তুলছে, তারচেয়েও বেশি, যতখানি আমার জন্মদাতা মা-বাবা, মক্তব ও স্কুলের ওস্তাদরা গড়েছেন।
পাঠকদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা আমাকে বারবার বিব্রত করেছে, কষ্ট দিয়েছে, ক্ষতবিক্ষত করেছে। আপাতদৃষ্টিতে গ্রুপ ম্যানেজমেন্টে এটা একটা মামুলি প্রযুক্তিগত সেটিং ইস্যু ছিলো, কিন্তু প্রযুক্তি না জানার কারণে এটাই একটি বড় সমস্যা হয়ে গ্রুপের সবাইকে জ্বালিয়েছে! আমার গুগল গ্রুপে ইমেল পাঠানোর আগে, আমি গ্রুপ সেটিংসয়ে গিয়ে গ্রুপ সদস্যদের ফ্রি পোস্টিং অ্যাবিলিটি ডিএক্টিভেট করিনি, যার ফলে বাই-ডিফল্ট, সবাই সবার সাথে উন্মুক্তভাবে যোগাযোগ করতে পারত। যে কেউ যখন আমার কাছে ফিডব্যাক দিত, সেটা বিনা প্রয়োজনে অন্য সবার কাছেও চলে যেতো। এতে গ্রুপ সদস্যরা দারুণভাবে ক্ষিপ্ত হতেন। এর ফলে এক সময় আমার গ্রুপে একটি মারাত্মক ঝড় উঠেছিল, যে ঝড় আমাকে ও আমার গ্রুপকে লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায়। এর ওপর পৃথকভাবে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে।
এবার তলিয়ে দেখতে চাই আমার পাঠক প্রতিক্রিয়ার আরো একটি মাত্রা। প্রথমত, আগেই বলেছি বেশিরভাগ পাঠক কোনো রকম প্রতিক্রিয়াই দেখাননি এবং এখনো দেখান না। যাঁরা দেখান তাঁদেরকে ‘ইতিবাচক’ এবং ‘নেতিবাচক’ এই দু’ভাগে ভাগ করা যায়। ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আবার দুই রকমের। একটায় থাকে শুধু প্রশংসায় ভরা এবং আরেকটায় থাকে গঠনমূলক সমালোচনা। ইতিবাচক ক্যাটাগরিতে সমালোচনার চেয়ে প্রশংসা আসে বহুগুণ বেশি। প্রশংসা কী কী আসে সে সব কথা বিস্তৃত করা আর আত্মপ্রচারণা একই কথা, তাই সেদিকে আর আলো ফেলে লাভ নেই। এবার আসি সমালোচনার কথায়। সমালোচনা যা পাই তার সবই গঠনমূলক মন্তব্য - যা সব লেখকই পেতে চান এবং পানও। এ রকমের মন্তব্য লেখকের লেখালেখির জন্য খুবই সহায়ক। এর দ্বারা লেখা উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়। আমার বেলাও তাই হয়েছে। নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া যা পাই তা আরো বিচিত্র, তবে সংখ্যায় অল্প। এর মাঝে আবার অধিকাংশ পাঠকই ভদ্রলোক। তাঁরা বলেন, 'Please unsubscribe me'- ব্যাস এটুকুই। আমি সবিনয়ে একটি Apology দিয়ে পাঠক তালিকা থেকে তাঁদের নাম কেটে দেই। যাঁরা আমার লেখা পছন্দ করেন না এবং পড়তে চান না, এঁদের সবাই যে ভদ্রলোক তেমনটি বলা যায় না। এই ক্যাটাগরিতে কদাচিৎ অনাকাক্সিক্ষত লোকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তাঁরা যা লিখেন, তাকে আমি নেতিবাচক সমালোচনা বলব না, তিরস্কার কিংবা নিন্দাবাদও বলব না। এ যে অকথ্য ভাষায় গালাগাল! ‘শিক্ষিত’ মানুষ এমন কাজ করতে পারেন এটা আমার জন্য আজীবন একটি স্মরণযোগ্য শিক্ষা হয়ে থাকবে। এ পর্যন্ত আমার লেখালেখি-জীবনে পাঠকদের কাছ থেকে যা কিছু পেয়েছি তার সবই আমি সমানভাবে হাসিমুখে গ্রহণ করে নিয়েছি এবং আগামীতেও নেব। এ-সব বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে পথ চলতে চলতে আরো পরে এসে বুঝলাম, আমার অনেক পাঠক আমার লেখালেখির সাথে বেশ আন্তরিক ও গভীরভাবে জড়িয়ে গেছেন। তাঁরা আমার সাথে নিয়মিত ঘন ঘন যোগাযোগ রাখেন, এক সপ্তাহ লেখা না পেলে কেউ কেউ আমার খোঁজখবর নিতে বিচলিত হয়ে ওঠেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন আমার লেখাকে কীভাবে আরো শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করা যায় তা নিয়ে সব সময় ভাবেন, খোলামেলা বুদ্ধি-পরামর্শ দেন, লেখাগুলো বই আকারে ছাপাবার তাগিদ দেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এঁদের মধ্যে কয়েকজন তো এমনও আছেন, যাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে লেখার জন্য ফরমায়েশ করেন, কেউ কেউ আবদার করেন, কেউ কেউ দাবি জানাতেও দ্বিধাবোধ করেন না। এ-ভাবে আমি আরো বুঝতে পারি আমার লেখা আমার একার নয়, এ যেন, দুইজন, তিনজন, এমনকি বহুজনের যৌথ প্রয়াসের ফল। তাই তো বলি, আমার লেখা একার নয়, আমার লেখা আমার নয়, তবে হ্যাঁ, এর দায়-দায়িত্ব সবই আমার, কেবলই আমার।
The Author is an Economics Professor and an Academic Journal Editor in the U.S. Email: wahid2569@gmail.com